নারীর প্রতিবাদের ভাষা শক্তি ও সাহসের প্রতীক
Published: 20th, February 2025 GMT
‘দ্রৌপদীর কালো শরীর আরো কাছে আসে। দ্রৌপদী দুর্বোধ্য, সেনানায়কের কাছে একেবারে দুর্বোধ্য এক অদম্য হাসিতে কাঁপে। হাসতে গিয়ে ওর বিক্ষত ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরে এবং সে রক্ত হাতের চেটোতে মুছে ফেলে দ্রৌপদী কুলকুলি দেবার মত ভীষণ আকাশচেরা, তীক্ষ্ণ গলায় বলে, কাপড় কি হবে, কাপড়? লেংটো করতে পারিস, কাপড় পরাবি কেমন করে? মরদ তু?’
মহাশ্বেতা দেবীর ‘দ্রৌপদী’ গল্পে একটি চরিত্র আমাদের চোখে ধরা দেয়, যা নারীর প্রতিবাদের এক অনন্য রূপ। এই উদ্ধৃতিতে আমরা দেখতে পাই, দ্রৌপদী তার নিজের শরীরকেই প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। মহাভারতের দ্রৌপদীর মতো সে কোনো দৈবী শক্তির সাহায্য চায় না। বরং সে নিজেই তার অধিকারের জন্য লড়াই করে। এই চরিত্রের মাধ্যমে মহাশ্বেতা দেবী ‘পুরুষ নারীর রক্ষক’ এই প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। নারীর প্রতিবাদের ভাষা শুধু শব্দে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি বহুমাত্রিক প্রকাশ, যা সমাজের গভীরে প্রভাব ফেলে। যেমনটা দেখা যায় মহাশ্বেতা দেবীর দ্রৌপদী মেঝেন– আদিবাসী এক সাঁওতাল নারী তার শরীরকেও প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এই ধরনের প্রতিবাদ শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী উপায়। বর্তমান সমাজে নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্র– যেমন শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, রাজনীতিতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। এই লড়াই শুধু তাদের নিজেদের জন্য নয়, বরং সমগ্র সমাজের জন্য একটি সুস্থ ও সমতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে।
বাংলাদেশ তার অর্ধশত বছর অতিক্রম করলেও নারীর জন্য পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ক্রুর থেকে ক্রুরতর হয়েছে। রাষ্ট্র, সমাজ বিনির্মাণ কালে নারীকে পাশে চায়, কিন্তু নারীর অধিকার নিশ্চিন্তকরণের বেলায় নারীকে তখন ‘শরীর’, ‘অপর’ করে তোলার প্রক্রিয়াও দেখা যায়। একাত্তর থেকে চব্বিশ– সংগ্রামে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও ফলভোগী হয়ে উঠতে চায় পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোটি। এই পদ্ধতি কাজ করে নারীকে বেশ্যাকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, অমানবিকীকরণের ভেতর দিয়ে; কেননা মানুষ শব্দের সমার্থক হয়ে ওঠে শুধু একা পুরুষ। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এক নারী শিক্ষার্থীকে ‘হানি ট্র্যাপ’ বলেছেন। নারীর প্রতিবাদের স্বরকে বন্ধ করতে তার শরীরকে সামনে নিয়ে আসা হয়। তাকে অসম্মান করার হাতিয়ার হিসেবে তার যৌনাঙ্গকে বেছে নেওয়া হয়। অতীতের দিকে ফিরে তাকালে দেখতে পাব নারীকে পুলিশ কর্মকর্তা ‘রাতের রানী’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। ভালো নারীরা রাতে বাইরে থাকে না, কেননা তাদের একটি যৌনাঙ্গ আছে, ভালো নারীরা রাতে বাইরে থাকে না, কেননা তাদের স্তন আছে কিন্তু তাদের মগজ দেখা যায় না, মেধা দেখা যায় না। কারণ পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো দেখতে দিতে চায় না। সে ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি নারীর প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে পাল্টা ডিসকোর্স দিয়ে নয়, বরং নারী ঘুরে দাঁড়িয়ে দৃঢ় গলায় বলতে পেরেছে– হ্যাঁ আমিই রাতের রানী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় উঠেছে ‘রাতের রানী; স্লোগানে। শুধু উচ্চারণে নয়, নারীর প্রতিবাদ প্রকাশ পায় তাদের চোখের দৃষ্টিতে, তাদের কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তায়, তাদের পদক্ষেপের শক্তিতে। এটি প্রকাশ পায় তাদের সাহসে, তাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান কালপর্বে আমরা দেখেছি মধ্যরাতে হলের গেট ভেঙে বেরিয়ে এসেছে নারী শিক্ষার্থীরা। বাহবা জুটেছে কিন্তু অভ্যুত্থান পেরিয়ে যখন সমতার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে তারা, তখন এসে নারীকে শুনতে হচ্ছে ‘হাফ প্যান্ট পরে ফুটবল খেলা যাবে না’, ‘স্যানিটারি ন্যাপকিন গোপনীয় বস্তু’। অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে হাজার হাজার সেমিনার-সিম্পোজিয়াম অথচ নারীশূন্য মঞ্চ, কোথাও বা টোকেন নারী বক্তা। অথচ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। এটি প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নারীরা সমানভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
বর্তমান সমাজে নারীর প্রতিবাদের ভাষা বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। ইরানে মাশা আমিনির মৃত্যুর পর নারীরা হিজাব খুলে ফেলে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এটি শুধু একটি পোশাক খোলার ঘটনা নয়, এটি একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। নারীরা তাদের শরীরের ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছে। কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নারীরা ঘর ছেড়ে রাতের রাস্তা দখল করেছে। যে রাতের রাস্তা তাদের জীবনে সান্ধ্য আইন বয়ে নিয়ে এসেছিল তাকেই তারা দখল করে নিতে চাইল। প্যারাডাইম শিফটের ভেতর দিয়ে রাতকে করে নিতে চাইল নিজের করে, এটাই তাদের প্রতিবাদ।
নারী তার প্রতিবাদের ভাষা শুধু কথার মধ্যেই সীমিত করে রাখতে চায় না। এটি তাদের কর্মে, তাদের সাহসে এবং তাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে প্রকাশ পায়। নারীর প্রতিবাদের ভাষা বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেতে পারে। কখনও তা হতে পারে একটি কবিতা, কখনও একটি চিত্রকর্ম, কখনও একটি গান, আবার কখনও একটি মিছিল। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর মূল উদ্দেশ্য একটাই– সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
নারীর প্রতিবাদের ভাষা শুধু বর্তমানের জন্য নয়, ভবিষ্যতের জন্যও। প্রতিটি প্রতিবাদ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উজ্জ্বল পথ তৈরি করে। যাতে তারা একটি সমতাপূর্ণ সমাজে বেড়ে উঠতে পারে। এ ভাষা কখনও হিংসাত্মক নয়, বরং এটি সৃজনশীল ও রচনাত্মক। এটি ধ্বংসের নয়, নির্মাণের। এটি ঘৃণার নয়, ভালোবাসার। এটি বিভেদের নয়, ঐক্যের। নারীর প্রতিবাদের ভাষা একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি পরিবর্তনের বাহক। এটি সমাজকে নাড়া দেয়, চিন্তা করতে বাধ্য করে। এটি প্রশ্ন তোলে, চ্যালেঞ্জ করে প্রচলিত ধারণাগুলোকে।
শেষ পর্যন্ত নারীর প্রতিবাদের ভাষা হলো স্বাধীনতার ভাষা, মুক্তির আহ্বান। এটি সমতার দাবি, ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা, মানবাধিকারের ঘোষণা। নারীর প্রতিবাদের ভাষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রতিটি নারী একজন মানুষ, তার নিজস্ব পরিচয় আছে, তার স্বপ্ন আছে, তার আকাঙ্ক্ষা আছে। সে শুধু কারও মা, বোন, স্ত্রী বা কন্যা নয়– সে নিজের অধিকারে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। তাই যখনই কোনো নারী প্রতিবাদ করে, তখন সে শুধু নিজের জন্য নয়, সমগ্র নারী সমাজের জন্য কথা বলে। তার প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে সকল নারীর কণ্ঠস্বর। এই প্রতিবাদের ভাষা ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে, ব্যাপক হচ্ছে। এটি এখন আর থামানো যাবে না। কারণ এটি শুধু একটি ভাষা নয়, এটি একটি আন্দোলন– একটি বিপ্লব। নারীর প্রতিবাদের ভাষা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে এবং আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এটি এখন শুধু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রকাশ নয়, বরং একটি সামষ্টিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। সামাজিক মাধ্যম, শিল্পকলা, সাহিত্য, খেলাধুলা, রাজনীতি– সব ক্ষেত্রেই নারীরা তাদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরছে। এই প্রতিবাদের ভাষা শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে নয়, এটি একটি নতুন, ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনের আহ্বান। প্রতিটি প্রতিবাদ তা যতই ছোট হোক না কেন, একটি বৃহত্তর পরিবর্তনের দিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়।
লেখক
চলচ্চিত্রকার
লেখক ও শিক্ষক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত র বর ত দ র পদ র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ করছে চীন
মাকিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে চুক্তি বাতিলকারী দেশগুলোর জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা নিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক প্রচারণা চালাচ্ছেন। আর তার সেই বার্তাটি হচ্ছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি দাঙ্গাবাজ দেশ, যাকে বিশ্বাস করা যায় না।
শুল্ক স্থগিতাদেশের সময় চীন ছাড়া সবদেশকে বাণিজ্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্য ট্রাম্প যে ৯০ দিনের সময়সীমা দিয়েছেন, সেই সময়ের মধ্যে চীনা কর্মকর্তারা বিদেশী সরকারগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঠেলে দেওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন। মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট জানিয়েছেন, একবার এই চুক্তিগুলো কার্যকর হয়ে গেলে, তিনি চান মার্কিন মিত্ররা ‘একটি দল হিসেবে চীনের সাথে যোগাযোগ করুক’, যাতে মার্কিন পক্ষ আলোচনায় আরো বেশি সুবিধা পায়।
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যন্ত মার্কিন মিত্ররা নিরাপত্তার জন্য ওয়াশিংটনের উপর নির্ভর করে এবং অর্থনৈতিকভাবে ট্রাম্পকে সন্তুষ্ট করার জন্য তাদের উৎসাহ রয়েছে। অবশ্য চীন আরো সমান তালে শুল্ক যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্পের শেষ বাণিজ্য যুদ্ধের পর থেকে বেইজিং মার্কিন রপ্তানি থেকে তার অর্থনীতিকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেশটিতে নিবেদিতপ্রাণ এবং সক্রিয় সৈন্য সংখ্যার বিচারে বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক বাহিনী রয়েছে।
শি ট্রাম্পের সাথে ফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং তার সরকার ‘পাল্টাপাল্টি’ শুল্ক বাতিলের দাবি জানাচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র জোর দিয়ে বলছে যে, অন্য পক্ষ, অর্থাৎ চীনকে উত্তেজনা কমানোর প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে, চীন নিজেকে নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থার একজন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে উপস্থাপন করছে এবং অন্যান্য দেশকে ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে বেইজিংয়ের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছে।
সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর আমেরিকান স্টাডিজের পরিচালক উ জিনবো বলেন, “এটি কেবল চীন-মার্কিন সম্পর্কে নয়। এটি আসলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে।”
গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিবিদদের সাথে দেখা করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়া উ জানান, অন্যান্য সরকারেরও বুঝতে হবে বেইজিংয়ের প্রচেষ্টা তাদের উপকার করেছে।
তিনি বলেন, “যদি চীন আমেরিকার বিরুদ্ধে না দাঁড়াত, তাহলে আমেরিকা কীভাবে তাদের ৯০ দিনের বিরতি দিত। চীনের উপর শুল্ক আরোপের ফলে ট্রাম্প অন্যান্য দেশের উপর শুল্ক আরোপ বন্ধ করার জন্য আবরণ পেয়েছেন। তাদের এটা উপলব্ধি করা উচিত।”
চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই সোমবার ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ব্রিকস ব্লকের দেশগুলোকে ট্রাম্পের দাবি প্রতিহত করার জন্য বেইজিংয়ের সাথে যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, “আপনি যদি নীরব থাকেন, আপস করেন এবং পিছু হটতে চান, তাহলে এটি কেবল বুলিকে আরো আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।”
তার এই বক্তব্যের কয়েক ঘন্টা পরে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইংরেজি সাবটাইটেলসহ একটি ভিডিওতে ওয়াশিংটনকে ‘সাম্রাজ্যবাদী’ শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে। সেখানে দাবি করা হয়েছে, গত শতাব্দীতে জাপানি রপ্তানি সীমিত করার মার্কিন পদক্ষেপ তোশিবার মতো কোম্পানিগুলোকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ওয়াং ই বলেছেন, “একজন ধর্ষকের কাছে মাথা নত করা ঠিক তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বিষ পান করার মতো, এটি কেবল সংকটকে আরো গভীর করে তোলে। চীন পিছু হটবে না যাতে দুর্বলদের কণ্ঠস্বর শোনা যায়।”
ঢাকা/শাহেদ