জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলন যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই হঠাৎ সারা দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইন্টারনেটহীন সময়টায় সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগে ব্যাংকিং খাতে। অনলাইন লেনদেন বন্ধ থাকায় ব্যাহত হয় ব্যবসায়িক কার্যক্রম, পেমেন্ট প্রসেসিং থমকে যায়, গ্রাহকেরা জরুরি লেনদেন করতে না পেরে চরম দুর্ভোগে পড়েন। বিকাশ, নগদ বা রকেট কার্যত অচল হয়ে পড়ে।

শুধু তা–ই নয়, দেশের ই-কমার্স খাতও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ে। ক্রেতারা অনলাইনে কেনাকাটা করতে না পারায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হন হাজারো উদ্যোক্তা। সবচেয়ে করুণ অবস্থা হয় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সারের, যাঁরা আন্তর্জাতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

এককথায়, মোট ১১ দিন ধরে গোটা অর্থনীতি যেন স্তব্ধ হয়ে পড়ে। শহর থেকে গ্রাম—সর্বস্তরের মানুষকে এই ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতার জন্য চরম ভোগান্তি সহ্য করতে হয়। প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান বিশ্বে এমন সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর মানুষের মধ্যে একটি প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। যদি একান্ত প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে ইন্টারনেট শাটডাউনের মতো চরম পদক্ষেপগুলো যেন নিয়মতান্ত্রিক স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় গ্রহণ করা হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো আলোচনাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সংশোধিত টেলিযোগাযোগ আইন শিগগিরই অধ্যাদেশ আকারে আসার কথা। শোনা যাচ্ছে, সেখানেও ইন্টারনেট শাটডাউন করার বিষয়ে কিছু উল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি।

কর্তৃত্ববাদী সরকারের শৃঙ্খল ভেঙে দেশ এগিয়ে যাওয়ার মূল ভিত্তি হচ্ছে স্বচ্ছতা। এ বিষয়ে আমরা খুব সহজেই পৃথিবীর নানা দেশের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিতে পারি।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ইন্টারনেটের সহজলভ্যতাকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ যথেচ্ছভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রতিটি দেশের নিজস্ব আইনি বিধান রয়েছে। তার বেশির ভাগই নির্দিষ্ট কিছু অভিন্ন মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। বিভিন্ন দেশের ইন্টারনেট বন্ধের উদাহরণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরকার যত বেশি স্বেচ্ছাচারী হবে, এসব ক্ষেত্রে অস্বচ্ছ হওয়ার আশঙ্কা তত বেশি হবে।

এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ কীভাবে অনুমোদিত হবে, কোন প্রক্রিয়ায় তা গ্রহণ করা উচিত, এবং কারা ও কোন পরিস্থিতিতে এসব আদেশ দিতে পারবেন—এসব বিষয়ে আমাদের একটি সুস্পষ্ট ও কাঠামোবদ্ধ নিয়ম থাকা প্রয়োজন।

ভারতে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৯৭৩–এর ধারা ১৪৪ এবং টেম্পোরারি সাসপেনশন অব টেলিকম সার্ভিসেস রুলস, ২০১৭-এর ওপর ভিত্তি করে ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ জন্য কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারকে ২০১৭ বিধির অধীনে উপযুক্ত কারণ উল্লেখ করে এবং রাজ্য বা কেন্দ্রীয় পর্যায়ের যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে লিখিতভাবে আদেশটি জারি করতে হবে। পরিস্থিতি জরুরি হলে কমপক্ষে একজন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা আদেশ জারি করতে পারেন, তবে অবশ্যই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটি কমিটি দ্বারা এর যৌক্তিকতা পর্যালোচনা করতে হবে।

সাইবারস্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব চায়না চীনে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ। সাইবার নিরাপত্তা আইন (২০১৭), রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন এবং জাতীয় নিরাপত্তা আইন অনুসারে চীনের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি পরিচালিত হয়। ‘দ্য গ্রেট ফায়ারওয়াল’ নামের চীনের কঠোর ইন্টারনেট সেন্সরশিপ ব্যবস্থা গুগল, ফেসবুক, টুইটারের মতো অনেক বিদেশি ওয়েবসাইট ও প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে রেখেছে। কর্তৃপক্ষ বিচার বিভাগীয় তদারকি ছাড়াই ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ বা ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে পারে।

পাকিস্তানে ইন্টারনেট বন্ধ বা নিষিদ্ধকরণ কার্যকর করার কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ হলো পাকিস্তান টেলিকমিউনিকেশন অথরিটি। ইন্টারনেট বন্ধের আদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা প্রাদেশিক সরকার দ্বারা জারি করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় তদারকি খুবই সীমিত। এ ছাড়া আদালতের অনুমোদন ছাড়াই শাটডাউনের আদেশ দেওয়া যেতে পারে। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে ইন্টারনেট বন্ধের পরে বিষয়টি আদালতে উত্থাপন করা হয়েছে।

ইরানের ‘সুপ্রিম কাউন্সিল অব সাইবারস্পেস’ কম্পিউটার অপরাধ আইন (২০০৯)–এর অধীনে জাতীয় নিরাপত্তা বা ইসলামিক মূল্যবোধ রক্ষার জন্য ইন্টারনেট–সুবিধা নিষিদ্ধ বা সীমাবদ্ধ করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি দেশের শীর্ষনেতাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্তে বিচার বিভাগীয় তত্ত্বাবধান খুবই কম এবং এসব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার কোনো বালাই নেই বললেই চলে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ বা জাতীয় জরুরি অবস্থার সময়ে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করতে পারেন। ১৯৩৪ সালের যোগাযোগ আইন (ধারা ৭০৬)-এর মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এ জরুরি ক্ষমতা প্রদান করা হয়। বিক্ষোভের মতো ঘটনা বা নিরাপত্তা হুমকির প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্রে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনা কম।

মিয়ানমারের টেলিযোগাযোগ আইন (২০১৩)-এর অধীন সরকার ইন্টারনেট পরিষেবা সীমিত বা স্থগিত করতে পারে। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের সময়, সামরিক সরকার বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তথ্যের প্রবাহ সীমিত করতে ঘন ঘন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। সামরিক বা রাজনৈতিক নেতারা প্রায়ই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এসব সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতা বা বিচারিক পর্যালোচনা খুবই সামান্য।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে ভবিষ্যতে আর কখনো ইন্টারনেট বন্ধ হবে না—এমন আশা করা অবাস্তব। বিশেষ করে, কোনো নির্দিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার স্বল্প সময়ের জন্য ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে যদি ভবিষ্যতে কর্তৃপক্ষ আবারও ইন্টারনেট বন্ধের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চায়, তাহলে একটি আধুনিক ডিজিটাল সমাজের নাগরিক হিসেবে আমরা অবশ্যই একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থার দাবি জানাব, যাতে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি বা ক্ষমতার অপব্যবহারের কোনো সুযোগ না থাকে।

এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ কীভাবে অনুমোদিত হবে, কোন প্রক্রিয়ায় তা গ্রহণ করা উচিত, এবং কারা ও কোন পরিস্থিতিতে এসব আদেশ দিতে পারবেন—এসব বিষয়ে আমাদের একটি সুস্পষ্ট ও কাঠামোবদ্ধ নিয়ম থাকা প্রয়োজন। সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে, যদি হাইকোর্টের বেঞ্চ বা বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি পর্যালোচনা কমিটিকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত অনুমোদনের ক্ষমতা দেওয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে একটি গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে, যা পরবর্তী সংসদ দায়িত্ব গ্রহণের পর আইনে পরিণত হবে।

যদি ভবিষ্যতে আবারও ইন্টারনেট বন্ধ করার প্রয়োজন হয়, তবে বিষয়টি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। যতটা সম্ভব সীমিত পরিসরে প্রয়োগ করতে হবে। অযৌক্তিকভাবে ইন্টারনেট শাটডাউন করলে তার ভয়াবহ পরিণতি কতটা গভীর হতে পারে, তা আমরা এরই মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি। তাই অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের দ্রুত ভবিষ্যতের জন্য উপযোগী ও সুসংগঠিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

সাহেদ আলম টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর স থ ত এ ধরন র আম দ র অন ম দ র জন য সবচ য় সরক র ব যবস ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে

রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।

এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন। 

পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।

এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়। 

এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে। 

মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়। 

জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।

এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়। 

এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।

যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।

তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে। 

ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই। 

অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়। 

এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।

এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে। 

এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়। 

এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে। 

বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ