মুক্তিযুদ্ধ নিছক শাসক বদলের যুদ্ধ ছিল না
Published: 28th, February 2025 GMT
আধুনিক যুগে বেতার যে কত শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ, তার প্রমাণ একাত্তরে পাওয়া গেছে। হানাদারদের আচমকা আক্রমণে মানুষ যখন দিশেহারা তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যে ভূমিকা নিয়েছিল, সেটা কোনো দিক দিয়েই সামান্য নয়। বোঝা গিয়েছিল, সবকিছু হারিয়ে যায়নি, প্রতিরোধ তৈরি হচ্ছে। বিশ্বে খবর ছড়িয়ে পড়ল–স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। যুদ্ধ চলছে। প্রবাসী সরকারের নির্দেশ পৌঁছে যাওয়া শুরু করল মানুষের কাছে। পাকিস্তান সরকার তাদের বেতারে দিনরাত যেসব মিথ্যা কথার প্রচার চালাচ্ছিল, তার জবাবও আসছিল এই বেতার কেন্দ্র থেকে। কিন্তু যে বিপ্লবী সম্ভাবনা নিয়ে বেতার কেন্দ্রটি আত্মপ্রকাশ করেছিল, তা টেকেনি। নাম থেকে বিপ্লবী অভিধার প্রস্থান কোনো দুর্ঘটনা ছিল না; জাতীয়তাবাদী লড়াইটা সমাজতান্ত্রিক লড়াইয়ে পরিণত হোক– এমনটা প্রভাবশালী দুটি মহলের কোনোটিই চায়নি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সামরিক নেতৃত্ব, এই দুই মহলের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব ছিল, এটা ঠিক; সামরিক নেতৃত্বের কোনো কোনো অংশ এমনও চিন্তা করেছে যে, যুদ্ধের নেতৃত্ব একচ্ছত্ররূপে আওয়ামী লীগের হাতে থাকা উচিত নয়। কারও কারও এমনও ইচ্ছা ছিল যে, যুদ্ধ শেষ হলে ক্ষমতা চলে যাবে সামরিক বাহিনীর হাতে; তারা নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করে ক্ষমতা তুলে দেবে নির্বাচিতদের হাতে। কিন্তু সামরিক-বেসামরিক সব পক্ষই এক মত ছিল সামাজিক বিপ্লবের বিরোধিতার ব্যাপারে। যুদ্ধের সময়ে সামরিক আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্বপরায়ণতা প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে তারা ভয়াবহ সব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। নিজেরাও নিহত হয়েছে। ওদিকে যে জাতীয়তাবাদী শক্তি যুদ্ধকালে নেতৃত্বে ছিল এবং পরে যারা রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করেছে, তাদের নিজেদের ভেতর বিরোধ ছিল অমীমাংসেয়। যে জন্য তারা পারস্পরিক শত্রুতায় লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু তাদের প্রধান শত্রু ছিল জনগণের বিপ্লবী চেতনা।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে বিপ্লবী নাম দেওয়া কিন্তু কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। স্বাধীনতা মানুষ আগেও একবার পেয়েছিল, সে স্বাধীনতা ছিল শুধু নামেরই; দেশের বেশির ভাগ মানুষের জন্য তা কিছুই বহন করে আনতে পারেনি, দুর্ভোগ ভিন্ন। জনগণের উপলব্ধিতে একাত্তরের যুদ্ধ তাই শাসক বদল না, ছিল সমাজ বদল, অর্থাৎ বিপ্লবের। বেতারকর্মীর অগ্রসর অংশ সে উপলব্ধিকেই ধারণ করত।
৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, সেদিন থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নামও বদলে যায়। নতুন নাম দাঁড়ায় বাংলাদেশ বেতার। অর্থাৎ সেদিন থেকেই এটি পুরোপুরি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। বিপ্লবী তো নয়ই, বিদ্রোহী চরিত্রটাও আর অবশিষ্ট রইল না। বেতারের নিয়মিত কর্মীরা আগেই সরকারি কর্মচারী হয়ে গিয়েছিলেন, এখন পুরোপুরি বেতনভুক হয়ে পড়লেন। দেশে ফেরার পর পোস্টিং, প্রমোশন, ট্রান্সফার– এসব বিষয় সামনে চলে এলো। মুজিবনগরী হাজি এবং দেশীয় অ-হাজিদের ভেতর পার্থক্য দেখা দিল। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরে তো বেতারের নামই বদল করে দেওয়া হয়েছিল। নতুন নাম হয়েছিল রেডিও বাংলাদেশ; পাকিস্তানি স্টাইলে। সেই নাম অবশ্য টেকেনি। তবে রাষ্ট্রীয় বেতার ক্রমশ তার গুরুত্ব হারিয়েছে। প্রাইভেট এফএম রেডিও চলে এসেছে, একের পর এক। রাষ্ট্রীয় বেতার জনগণের থাকেনি; মুখপাত্র হয়েছে সরকারের।
যুদ্ধের সময় এটা অস্পষ্ট ছিল না যে, ভারতের রাজনৈতিক আগ্রহ কেবল শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোতে সীমাবদ্ধ ছিল না; ছিল ঘোষিত শত্রু পাকিস্তানকে ভাঙা পর্যন্ত। ভারতের জন্য যা ছিল শত্রুকে পর্যুদস্ত করা, আমাদের জন্য সেটাই দাঁড়িয়েছিল স্বাধীনতা। এক যাত্রায় পৃথক ফল। ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতির অনুপস্থিতিটা লক্ষ্য করবার মতো ঘটনা বৈ কি; তার প্রতীকী মূল্যও কম নয়।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার যদি বিপ্লবী হতো তাহলে নেতাদের কাজটাও হতো ভিন্ন রকমের। বিপ্লবের সম্ভাবনার ভেতরে যেমন প্রতিশ্রুতি ছিল মৌলিক পরিবর্তনের, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক মুনাফালোলুপতা তথা শোষণের পরিবর্তে মানবিক করা; স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভেতরও তেমনি সম্ভাবনা ছিল বেতারকে কেবল পাকিস্তানিদের হটিয়ে দেওয়ার জন্য নয়; দেশপ্রেমকে উচ্চতর স্তরে নিয়ে গিয়ে দেশবাসীর ভেতর সর্বক্ষেত্রে নতুন সৃষ্টিশীলতাকে উৎসাহিত করার। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে তো খুব বড় রকমের পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করতে পারত ওই বেতার কেন্দ্র। পরে টেলিভিশন এসেছে। টেলিভিশনও পারত রেডিওর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে, রেডিও যদি দৃষ্টান্ত স্থাপন করত। কিন্তু রেডিওর বিপ্লবী সম্ভাবনা তো নিঃশেষ হয়ে গেছে সূচনাতেই। আড়াই দিনের মাথায়, মার্চ মাসের ২৮ তারিখেই, যেদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিপ্লবী শব্দটাকে নামিয়ে ফেলা হয়। ওটি তো কেবল একটি শব্দ ছিল না, ছিল একটি স্বপ্ন। সমষ্টিগত স্বপ্ন।
স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পার্থক্য বিস্তর। কিন্তু মিল নেই, এমনটা বলার উপায় নেই। হয়তো বলা যাবে, পাকিস্তানি শাসকরা ছিল অবৈধ, আর বাঙালি শাসকরা বৈধ। কিন্তু সকল বাঙালি শাসকই কি বৈধ? সামরিক শাসন কি আসেনি? প্রহসনমূলক বৈধ নির্বাচন কি ঘটেনি? এই প্রসঙ্গে বেলাল মোহাম্মদের বইতে উল্লিখিত একটি গল্পের কথা বলা যেতে পারে। গল্পটি তিনি মওলানা ভাসানীর মুখে শুনেছিলেন। সেটা এই রকমের: ‘একটা ছাগলকে তাড়া করেছিল একটা হিংস্র বাঘ। একজন মৌলভী তখন বাঘের হাত থেকে ছাগলটিকে রক্ষা করেছিলেন। মৌলভী ঘাস-পাতা খেতে দিয়ে ছাগলটিকে তাজা করে তুলেছিলেন। একদিন ছাগলটিকে জবাই করতে উদ্যত হলে ছাগলটি বলেছিল: আপনি সেদিন আমাকে বাঘের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। এখন নিজেই আমাকে খাবেন কেন? উত্তরে মৌলভী বলেছিলেন: বাঘ তোমাকে হারাম খেতে চেয়েছিল। আমি তো তোমাকে হালাল করেই খাব।’
গল্পটির কথা তাঁর মনে পড়েছে ১৬ ডিসেম্বরের পরে, বাংলাদেশে আসা ভারতীয় সেনাদের লুণ্ঠন তৎপরতা দেখে। কিন্তু এটি বাংলাদেশি লুটপাটকারীদের বেলাতেও পুরোপুরি প্রযোজ্য বৈ কি।
বেলাল মোহাম্মদ স্মরণ করেছেন, ভারতীয় অফিসাররা তাদেরকে বলত, তোমাদের ওখানে তো দেখছি অনেক উন্নতি হয়েছে, তোমরা খামোখা গোলমালের মধ্যে গেলে কেন? তারা খেয়াল করেনি যে, উন্নতির রূপকথার ভেতর একটা দৈত্যও ছিল। রূপকথার ভেতর দৈত্যরা সাধারণত থাকেই। সেই দৈত্যটার নাম বৈষম্য। বাঙালিরা সেদিন ওই দৈত্যটার বিরুদ্ধেই লড়ছিল। সে সময়ে ওই দৈত্যটা ছিল আঞ্চলিক বৈষম্যের, এখন দাঁড়িয়েছে শ্রেণি বৈষম্যের। শ্রেণি বৈষম্য সেদিনও ছিল, কিন্তু সেটা চাপা পড়ে গিয়েছিল পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্যের নিচে; বাঙালি অর্থনীতিবিদরা যার সময়োপযোগী নাম দিয়েছিলেন দুই অর্থনীতি। এখন এক অর্থনীতির ভেতর পরিষ্কারভাবে দেখা দিয়েছে দুই শ্রেণি– ধনী ও দরিদ্র। এখনকার সংগ্রাম তার বিরুদ্ধেই। এই সংগ্রাম চলছে, চলবে। দেশপ্রেমিকরা লড়বে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
স্বচ্ছতার জন্য ডিএনসিসির প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে:
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সব প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।
সোমবার (২৮ এপ্রিল) ডিএনসিসির ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত পশ্চিম শেওড়াপাড়া, পশ্চিম কাজীপাড়া ও সেনপাড়া পর্বতা এলাকায় ৪ কিলোমিটার রাস্তা, ৫ কিলোমিটার নর্দমা ও দেড় কিলোমিটার ফুটপাত নির্মাণকাজের উদ্বোধন ও গণশুনানি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ কথা জানান।
ডিএনসিসির প্রশাসক বলেন, ডিএনসিসির সব প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। প্রকল্পটি কবে শুরু হবে, কবে শেষ হবে, কতা টাকা বরাদ্দ আছে—এসব তথ্য ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। এছাড়া, রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণ হলে নির্মাণ সামগ্রী কী, সেটা জনগণের জানা দরকার। যখন জনগণ জানবে, তখন তারা জবাবদিহি করতে পারবে।
তিনি বলেন, “আমি গত সপ্তাহে কাউকে না জানিয়ে ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে চলমান কাজ পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম, রাস্তাকে ধরে রাখার জন্য যে ওয়াল (বিশেষ দেয়াল) দেওয়া হয়েছে, সেটার পিলার বানানোর কথা ছিল স্টোন দিয়ে; কিন্তু বানিয়ে রেখেছে ব্রিক দিয়ে। এটা বড় দুর্নীতি। স্থানীয় মানুষ যদি না জানে, কী নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হবে, তাহলে দুর্নীতি করাটা সহজ। তথ্যের যত বেশি আদান-প্রদান হবে, তথ্য যত বেশি পাবলিক করা হবে, জনগণ তত বেশি জবাবদিহি করতে পারবে। আমি ঠিকাদারকে জানিয়ে দিয়েছি, সঠিক নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার না করলে বিল দেব না। তারা বলেছে, এটা ঠিক করে দেবে।”
মোহাম্মদ এজাজ বলেন, যার যার এলাকার কাজ তারা বুঝে নেবেন। বুঝে নেওয়ার জন্য যত তথ্য ও সহযোগিতা লাগবে, সেটা আমরা দেব। ডিএনসিসির ওয়েবসাইটে প্রকল্পের সব তথ্য ও ঠিকাদারের ফোন নম্বরসহ দেওয়া থাকবে। স্থানীয় জনগণ স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ বুঝে নেবেন। আমরা চাই, সকলের অংশগ্রহণে উন্নয়নকাজ সম্পন্ন হবে। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।”
তিনি বলেন, “আমরা বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় সোসাইটি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সহযোগিতা পাচ্ছি। সবার অংশগ্রহণ বাড়াতে আমি বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের নিয়ে গণশুনানি করছি। প্রতি মাসে ফেসবুক লাইভে দেশে-বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সাথে যুক্ত হচ্ছি। ডিএনসিসির সবার ঢাকা অ্যাপ আছে, সেটির পাসওয়ার্ড পর্যন্ত আমাদের দিচ্ছে না। আগে যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা ৪ কোটি টাকা খরচ করে এই অ্যাপ বানিয়েছে। পাসওয়ার্ড না দিলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।”
ডিএনসিসির প্রশাসক বলেন, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় হকারদের জন্য হাটা যায় না। মানুষের অবাধ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। ঢাকা শহরে মানুষের চলাচলের অধিকার সবার আগে, সেই অধিকার আমরা বাস্তবায়নের চেষ্টা করব। মিরপুর-১০ এর প্রধান সড়কের যত হকার ও অটোরিকশা আছে, সেগুলো আমরা বন্ধ করে দেব। যারা এ ধরনের ইনফরমাল পেশায় যুক্ত আছেন, তাদের পুনর্বাসনের জন্যও আমরা প্ল্যাটফর্ম করব। তাদের জন্যও বিকল্প ব্যবস্থা আমরা তৈরি করব। এই শহরটা সবার, সবাই একসাথে বসবাস করব; কিন্তু অন্যদের কষ্ট না দিয়ে, অন্যের অধিকার নষ্ট না করে।
বক্তৃতা শেষে ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন এবং মোনাজাতে অংশ নেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুর রহমান, অঞ্চল-৪ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খন্দকার মাহাবুব আলম, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হকসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
ঢাকা/এএএম/রফিক