গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কারের ধারা শুরু হয়েছে, যা দেশে উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক নীতি এবং সুশাসনের প্রতি গভীর আকাঙ্ক্ষাকে উজ্জীবিত করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক সংস্কারের পরিকল্পনাগুলো সুসংহত করার পাশাপাশি শাসন ব্যবস্থার সংস্কার, অর্থনৈতিক উদারীকরণ এবং নাগরিককেন্দ্রিক নীতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, এসব সংস্কার বাংলাদেশকে স্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করবে এবং টেকসই উন্নয়ন প্রসারে ভূমিকা রাখবে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষত বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্তি বাড়ানোর মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্টের পথ সুগম হয়েছে। 

নিঃসন্দেহে এফডিআই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রযুক্তি স্থানান্তর, মূলধন সংগ্রহ, বাজারে প্রবেশাধিকার এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অত্যন্ত কার্যকর উপায় হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে এফডিআই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বিশেষত বিদেশি অংশীদারদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ এবং অন্যান্য করপোরেট কাঠামোতে সফল সহযোগিতার মাধ্যমে বিভিন্ন খাতের বিকাশে সহায়ক হয়েছে। তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতে এফডিআইর অবদান অপরিসীম। দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প বিশ্ববাজারে শক্তিশালী অবস্থান অর্জন করেছে। 

এফডিআই আকর্ষণের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালে মাত্র ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এফডিআই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, যা ভিয়েতনামের ১৮ বিলিয়ন এবং ভারতের ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তুলনায় অনেক কম। উপরন্তু, আইএমএফের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী গত চার বছরে দেশের এফডিআই সংগ্রহের পরিমাণ প্রায় ৫.

৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিরিক্ত ধরা হয়েছে, যা থেকে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহে এক ধরনের অনিশ্চয়তা এবং হ্রাসের সংকেত মেলে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনে আরও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা এবং রপ্তানি পণ্য ও বাজারের বহুমুখীকরণ। এসব পদক্ষেপ দেশের অর্থনীতির গতি ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সেই সঙ্গে এফডিআই প্রবাহ বাড়ানোর জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের দিকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

এ প্রেক্ষাপটে বন্দরভিত্তিক লজিস্টিক অবকাঠামো উন্নয়ন রূপান্তরমূলক প্রভাব ফেলতে সক্ষম। কারণ এটি সংযোগ বাড়ায় এবং সামগ্রিক লজিস্টিক ব্যয় ও লিড টাইম কমায়। এর মাধ্যমে উচ্চ পর্যায়ের এফডিআই আকর্ষণ করার জন্য একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের লজিস্টিক অবকাঠামো যথেষ্ট উন্নত না হওয়ায় শিল্প খাত এবং অর্থনীতিকে তার পূর্ণ সম্ভাবনা পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে।

চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ এবং প্রায় ৯৮ শতাংশ কনটেইনার বাণিজ্য পরিচালনা করে। বিশ্বব্যাংকের কনটেইনার পোর্ট পারফরম্যান্স ইনডেক্স ২০২৩ অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান বিশ্বের ৪০৫টি বন্দরের মধ্যে ৩৩৭তম। একই রিপোর্ট অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজগুলোর টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম গড়ে ৩.২৩ দিন, যা কলম্বোতে মাত্র ০.৮৬ দিন। এ ছাড়া বন্দরটিতে আমদানি ক্লিয়ারেন্সে গড় ১১ দিন এবং রপ্তানি বর্ডার কমপ্লায়েন্সে গড়ে ৩৬ ঘণ্টা সময় লাগে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে কিছুটা উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে; বন্দর খাতে আরও দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে।

বন্দরে লজিস্টিক ইকোসিস্টেমের প্রতিবন্ধকতা দূর করা না হলে সক্ষমতা উন্নয়নে যে কোনো পদক্ষেপ অকার্যকর বিবেচিত হবে। বন্দর, কার্গোর সঙ্গে সড়ক, রেল, অভ্যন্তরীণ জলপথের অপ্রতুল সংযোগের কারণে পরিবহন ব্যয় যেমন বাড়ছে, সরবরাহে বিলম্ব হচ্ছে। সম্প্রতি চালু হওয়া ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (এনএসডব্লিউ) ব্যবস্থা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, যা নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া সহজ করবে এবং কর্মদক্ষতা বাড়াতে সহায়ক হবে। বাংলাদেশের বন্দরের সীমিত ক্ষমতা এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার কারণে দেশ এখনও তার ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা ও শক্তিশালী উৎপাদন ভিত্তি সম্পূর্ণ কাজে লাগাতে সক্ষম হয়নি। এই অদক্ষতা বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতার দুর্বলতা, উচ্চ ব্যবসা ও লেনদেন ব্যয় এবং বাণিজ্য বিলম্বের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে লজিস্টিক ব্যয় খাতভেদে ৪.৫ থেকে ৪.৮ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে, যা বাণিজ্য অংশীদার এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। লজিস্টিক খাতে লক্ষ্যভিত্তিক স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি সংস্কারের মাধ্যমে জাতীয় রপ্তানি আয় ১৯ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব। লজিস্টিক খাতে ব্যয় ১ শতাংশ কমানোর মাধ্যমে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি চাহিদা প্রায় ৭.৪ শতাংশ বাড়তে পারে। 
বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, জাতীয় অর্থনীতি ২০৪১ সাল নাগাদ ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে এবং রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা হবে ৩০০ বিলিয়ন ডলার, বৈদেশিক বিনিয়োগ হবে ৬০ থেকে ৭০ বিলিয়ন ডলার ও বার্ষিক অবকাঠামোগত বিনিয়োগের পরিমাণ হবে ১০ বিলিয়ন ডলার। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে লজিস্টিক খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রামের বে টার্মিনালের মতো পরিকল্পনাধীন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনায় নতুন দ্বার উন্মোচন করতে সক্ষম হবে। এসব উদ্যোগ বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, রপ্তানির সময় কমানো এবং শিপিং খরচ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। উদাহরণস্বরূপ, বে টার্মিনাল বিশেষভাবে বৃহদাকার জাহাজ পরিচালনার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে এবং ২০৩৬ সালের মধ্যে এর কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বর্তমান ৩.২ মিলিয়ন টিইইউ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬ মিলিয়ন টিইইউতে পৌঁছানোর আশা করা হচ্ছে।
এসব প্রকল্পের সাফল্য নির্ভর করবে প্রাথমিক প্রস্তুতি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি ও মানের ওপর। বিশেষ করে এসব উদ্যোগের সঙ্গে সহায়ক অবকাঠামো যেমন ব্রেক ওয়াটার, নেভিগেশনাল চ্যানেলের পর্যাপ্ত ড্রেজিং, আন্তঃদেশীয় সংযোগ, ওয়্যার হাউজিং ও ডিজিটালাইজেশনে পরিপূরক বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

এ ছাড়া বৈশ্বিক উদাহরণ থেকে বাংলাদেশের শিক্ষালাভের সুযোগ রয়েছে। ভিয়েতনামের এফডিআইভিত্তিক লজিস্টিক কৌশল শুধু বন্দরের দক্ষতা বাড়ায়নি, বরং রপ্তানি বহুমুখীকরণকে সহজতর করেছে। সিঙ্গাপুরের পোর্ট কমিউনিটি সিস্টেমের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম কাস্টমস প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও দ্রুত করেছে, যা বাণিজ্য প্রবাহ সহজ করেছে এবং বন্দর ব্যবস্থাপনাকে অধিক কার্যকরী করে তুলেছে।
বাংলাদেশের সামনে আরেকটি বৃহত্তর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উন্মোচিত হচ্ছে এবং এই পথ চলতে সরকারকে একটি স্পষ্ট ও কার্যকর কৌশল অবলম্বন করতে হবে। বন্দর কার্যক্রমে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারকে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অপারেটরদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এটি শুধু দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নিয়ে আসবে না, বরং বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতেও সাহায্য করবে, যখন সরকারকে আর্থিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সরকারি ব্যয় কমানোর প্রয়োজন হবে। শুল্ক পদ্ধতি সরলীকরণ, নিয়ন্ত্রক বাধা কমানো এবং আধুনিক ডিজিটাল টুলস যেমন এআই এবং ব্লকচেইনের ব্যবহার লজিস্টিক সেক্টরের কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে পারে।

এ ছাড়া মাল্টিমোডাল লজিস্টিক সিস্টেমের উন্নয়ন প্রয়োজন, যা বন্দরকে শিল্পাঞ্চল ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্ত করবে এবং তা বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা উন্মোচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউএন-এসকাপের তথ্য অনুযায়ী, উন্নত অবকাঠামো ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত ৩৫.৫ বিলিয়ন ডলার আয় এনে দিতে পারে। 

একটি আধুনিক, দক্ষ এবং স্বচ্ছ লজিস্টিক ব্যবস্থা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করে দেশকে বৈশ্বিক বাজারে নির্বিঘ্নে একীভূত এবং একটি স্থিতিস্থাপক ও প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম করবে। সাহসী সংস্কার ও কৌশলগত বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার প্রকৃত সম্ভাবনা উন্মোচন করতে সক্ষম হবে এবং ভবিষ্যতে একটি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারবে। 

ড. মাসরুর রিয়াজ: চেয়ারম্যান, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক অবক ঠ ম ক র যকর ব যবস থ পদক ষ প অন য য় র জন য সহ য ক সরক র ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

খেলাপি ঋণে বাংলাদেশ এশিয়ায় কেন শীর্ষে

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে মন্দ বা খেলাপি ঋণ অনেক দিনের বিরাট সমস্যা। শুরুতে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় এ ব্যাধি বিদ্যমান হলেও পরবর্তী সময়ে বৃহৎ ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকেও ছড়িয়ে পড়ে। এটি, তথা ঋণখেলাপির সংস্কৃতি ধীরে ধীরে এক মহিরুহ আকার ধারণ করেছে।

গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের লুকানো খেলাপি ঋণ বের হয়ে আসছে। আবার অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ও তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তাতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ এক বছরের ব্যবধানে মোট ঋণের ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি এখন খেলাপি।

 সম্প্রতি প্রকাশিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শীর্ষে উঠে আসার বিষয়টি সামনে এসেছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর আর্থিক বিভিন্ন সূচকের অবস্থা নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। অবশ্য খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে ২০২৩ সালের তথ্য। তাতেই বাংলাদেশ শীর্ষে। এটি যে ২০২৫ সালে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তা আমরা জানি।

আগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কায়দায় বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হতো। অন্যদিকে সহজে ঋণ পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠন করার কারণেও খেলাপি ঋণ কম ছিল। এখন ঋণমানে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করা শুরু হয়েছে। আবার ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ও আওয়ামী রাজনীতি–সমর্থিত ব্যক্তিদের ব্যবসা খারাপ হয়ে পড়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

খেলাপি ঋণ এভাবে বাড়তে থাকলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, সন্দেহ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে উদ্যোগ নিতে হবে। যাঁরা ভালো ব্যবসায়ী, তাঁরা যেন আবার ব্যবসা শুরু করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। সেটি নিয়ে সরকার কাজও করছে।

 এডিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। ২০২৩ সাল শেষে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল থেকে প্রতিবছরই বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল ৮ শতাংশ, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মতো ২০২১ সাল থেকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কার।

দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর খেলাপি ঋণ কমেছে। যেমন ভুটানের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০২২ সালে কমে হয়েছে ৩ শতাংশ। ভারতের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। মালদ্বীপের খেলাপি ঋণ এই সময়ে ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। একই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম খেলাপি ঋণ তাইওয়ান ও কোরিয়ার। দেশ দুটির খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে শূন্য দশমিক ১ ও শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০২৪ সাল শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ছিল ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২৫ সালের জুন শেষে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকায়, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের চার ভাগের এক ভাগের বেশি খেলাপি হয়ে গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বলতে শুনেছি, গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। আগেই বলেছি, ঋণখেলাপি হওয়ার নিয়ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণেও দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেসব ঋণ নবায়ন করা হয়, তার অনেকগুলো আদায় হচ্ছে না। অনিয়মের কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা সামনে আরও বাড়তে পারে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন, বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়ে যাচ্ছেন, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।

সূত্রগুলো বলছে, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ও বহুল সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলোর ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে। এই পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই কাজ বাস্তবায়ন করতে এরই মধ্যে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্তও হয়ে গেছে। পাশাপাশি সরকারি খাতের জনতা ও রূপালী এবং বেসরকারি খাতের ইউসিবি, আইএফআইসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ট্রাস্ট ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে।

পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি হয়ে পড়া প্রায় ১ হাজার ২৫০ প্রতিষ্ঠান বিশেষ ব্যবস্থার অধীন ঋণ পুনর্গঠনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়মিত করার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন একটি বিস্তৃত নীতিমালা তৈরি করে ব্যাংকগুলোকে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দিতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানা গেছে, এই নীতিমালায় নির্দিষ্ট অর্থ জমা দিয়ে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হবে। তবে ঋণ পরিশোধে যতটা সময় অবকাশ পাবে, ওই সময়ে সুদ পরিশোধ করতে হবে। এর ফলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলে আশা করছেন অনেকে। তবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী না করলে কিংবা ব্যবসা পরিচালনায় মনোযোগী না হলে তার উল্টোটাও ঘটতে পারে। সুযোগের অসৎ ব্যবহারের উদাহরণ বাংলাদেশে অনেক।

সামগ্রিক ঋণখেলাপির সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে গেলে আমাদের দুষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি তথা স্বজনতোষী পুঁজিবাদ থেকে যেমন বেরিয়ে আসতে হবে, তেমনি ঋণ সম্প্রসারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। কমাতে হবে পরিচালকদের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ।

মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ