ছিলেন স্থপতি, বানাতে চেয়েছিলেন সিনেমা, এখন ক্রিকেটে ভারতের জয়ের নায়ক
Published: 3rd, March 2025 GMT
আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভারতের প্রাথমিক স্কোয়াডে ছিলেন না তিনি। চূড়ান্ত স্কোয়াড ঘোষণার একদম শেষ দিনে গিয়ে নেওয়া হয় তাঁকে। সেই বরুণ চক্রবর্তীই এখন চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়ের পথে বড় ভরসা!
দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে গত রাতে নিউজিল্যান্ডকে ৪৪ রানে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে ভারত। ৪২ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছেন বরুণ, যা মাত্রই ওয়ানডে ক্যারিয়ার শুরু করা এই রহস্য-স্পিনারের সেরা বোলিং। গত চার মাসে আরও দুবার ৫ উইকেট করে নিয়েছেন; দুটিই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে। মূলত সাম্প্রতিক সময়ে টি-টোয়েন্টির পারফরম্যান্স আর দুবাইয়ের মন্থর পিচের কথা মাথায় রেখে তাঁকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির দলে নেওয়া হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩৩ বছর বয়সী বরুণ একাদশে ছিলেন না। কাল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাড়তি একজন স্পিনার খেলানোর ভাবনা থেকে একাদশে রাখা হয় তাঁকে। কুলদীপ যাদব, অক্ষর প্যাটেল, রবীন্দ্র জাদেজার পর চতুর্থ স্পিনার হিসেবে খেলা বরুণই হয়ে ওঠেন দলের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। অথচ এই বরুণের পেশাদার ক্রিকেটারই হওয়ার কথা ছিল না!
বরুণ ছিলেন স্থপতি, অভিনয় করেছেন ‘জিভা’ নামে একটি তামিল চলচ্চিত্রে। এমনকি চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিতও করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ২৬ বছর বয়সে আবারও ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। সব ছেড়ে ছুড়ে ক্রিকেটেই মনোনিবেশ করেন।
বরুণের জন্ম ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের বিদার জেলায়। বেড়ে উঠেছেন চেন্নাইয়ের শহরতলি আদিয়ারে। সেখানে সেন্ট প্যাট্রিক’স অ্যাংগো ইন্ডিয়ান উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন।
স্কুল ও কলেজজীবনে উইকেটকিপার ছিলেন বরুণ। কিন্তু লেখাপড়ায় আরও মনোযোগী হতে খেলা ছেড়ে দেন। এরপর ভর্তি হন তামিলনাড়ুর এসআরএম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক সম্পন্ন করেন। একটি কোম্পানিতে স্থপতি হিসেবে চাকরিও শুরু করেন। কিন্তু ২৬ বছর বয়সে এসে মনে হলো আবার ক্রিকেটে ঝুঁকবেন। তাই চাকরিটা ছেড়ে দেন।
স্কুল-কলেজে উইকেটকিপার থাকলেও এবার বরুণ ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করেন পেসার হিসেবে। কিন্তু ২০১৭ সালের শুরুর দিকে হাঁটুর চোটে ছয় মাসের জন্য মাঠের বাইরে চলে যান। পুরোপুরি সেরে উঠে ফেরার পর বনে যান স্পিনার!
৩৩ বছর বয়সী বরুণ গতকাল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে দেরিতে পেশাদার ক্রিকেটে আসার সেই গল্পই শুনিয়েছেন, ‘ক্যারিয়ার নিয়ে আমার নানা ধরনের আকাঙ্ক্ষা ছিল। ২৬ বছর বয়সে এসে ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। তার আগে ছিলাম স্থপতি, চেয়েছি সিনেমা বানাতে। ভিন্ন পথে হেঁটেছি তখন।’
ভারতের জার্সিতে বরুণের অভিষেক ২০২১ সালে। সে বছর এই দুবাইয়েই খেলেছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের তিনটি ম্যাচ। কিন্তু ছিলেন উইকেটশূন্য। এরপর সেই যে দল থেকে বাদ পড়েন, ফেরেন গত বছর অক্টোবরে বাংলাদেশের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ দিয়ে। সেই সিরিজের সব ম্যাচই হয়েছে ব্যাটিং-স্বর্গে। এরপরও বরুণের ইকোনমি রেট ছিল ৬.
যে দুবাই ২০২১ সালে বরুণকে খালি হাতে ফিরিয়েছিল, চার বছর পর সেই দুবাইয়ে ভারতের হয়ে আবারও খেলতে নেমেই নিয়েছেন ৫ উইকেট। তবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মতো বড় মঞ্চে অভিষেকের দিনে কিছুটা স্নায়ুচাপে ভুগেছেন, তা স্বীকার করেছেন বরুণ।
এটাও জানিয়েছেন বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, হার্দিক পান্ডিয়ার মতো অভিজ্ঞরা স্নায়ুচাপ কাটিয়ে উঠতে তাঁকে অনেক সহায়তা করেছেন, ‘সত্যি বলতে, শুরুর দিকে আমি নার্ভাস ছিলাম। কারণ, ভারতের হয়ে আমি বেশি ওয়ানডে খেলিনি। তবে খেলা কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর ভালো বোধ করতে থাকি। তারা (কোহলি, রোহিত ও পান্ডিয়া) বলের পর বল আমার সঙ্গে কথা বলেছে এবং উদ্বেগ দূর করতে সাহায্য করেছে।’
সতীর্থরা অনেক সাহায্য করলেও কালকের পিচ থেকে খুব বেশি সহায়তা পাননি বলে জানিয়েছেন বরুণ, ‘বল খুব বেশি বাঁক খাচ্ছিল না। তবে সঠিক জায়গায় বল ফেলতে পারলে সহায়তা পাওয়া যাচ্ছিল। কুলদীপ, জাড্ডু (জাদেজা) এবং অক্ষর যেভাবে বল করেছে, এমনকি পেসাররাও...আসলে এই জয় পুরোপুরি দলীয় প্রচেষ্টার ফসল।’
আগামীকাল দুবাইয়েই ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হবে রোহিত শর্মার দল। এর আগে কাল ম্যাচসেরা হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও একাদশে রাখার জোরালো দাবি জানিয়ে রাখলেন বরুণ।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বছর বয়স ৫ উইক ট কর ছ ন বর ণ র ন বর ণ স থপত
এছাড়াও পড়ুন:
সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস
বাবা সন্তানের ওপর ছায়ার মতো স্নেহময় এক উপস্থিতি। নিঃশর্ত ভরসার প্রতীক। সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনের প্রয়োজনে নিজের বর্তমান, এমনকি নিজের স্বপ্নও নীরবে উৎসর্গ করে দিতে পারেন যিনি– আজ তাদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর দিন। বাবা দিবস উপলক্ষে সমতা’র বিশেষ আয়োজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা বৃহত্তর বরিশালে। এখন সেই জায়গাটা পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি পৌরসভার সমুদয়কাঠি গ্রাম। তখনকার সামাজিক পরিসরে আমাদের পরিবারের অবস্থা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভালো ছিল। আমার বাবা বিজয় কুমার আইচ তখন পিরোজপুরে কাজ করতেন। তাঁর রেশনের দোকান ছিল। প্রতি শনিবার বাড়ি আসতেন। আমরা বাবার আশায় বসে থাকতাম। এটি ছিল আমাদের জন্য একরকম আশীর্বাদের মতো।
বাবার একটি ব্যবসাও ছিল। এ থেকে মূলত আমাদের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের চেয়ে সম্ভবত বাবার জ্ঞান বা বোধ উন্নততর ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য দশ গ্রামের লোকজন তাঁকে মানত। গ্রামে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকত। বাবার সঙ্গে কথা না বলে কেউ থানা-পুলিশ করতে যেত না। বাবা সবাইকে খুব বুঝিয়ে বলত– মামলা করলে কে জিতবে, কে হারবে– এটি অনেক পরের কথা। মামলা নিয়ে বরিশাল-পিরোজপুরে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে দুই পক্ষই নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তারচেয়ে বরং তোমরা নিজেরা মিটমাট করে ফেল।
গ্রামের পণ্ডিতরা তখন তালপাতায় অ-আ-ক-খ শেখাতেন হাত ধরে ধরে। আমার সেটি একদম পছন্দ হতো না। বাবা কী করলেন, তিনি একটা স্লেট ও পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। অ-আ-ক-খ দিয়ে যত ছবি আঁকা হয়, তা শেখাতেন। এর মধ্যে আমার যে ছবিটা পছন্দ হতো, সেটি আমি মনের মধ্যে গেঁথে নিতাম। যার ফলে বাবার মাধ্যমে অত্যন্ত আনন্দদায়ক এক শিক্ষা পেয়েছি আমি।
আমার বাবারা ছিলেন ৪ ভাই। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দু’জন পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আমার বাবা ও এক কাকা বাড়ি ছেড়ে যাননি। আমরা ছিলাম ৬ ভাই ৩ বোন। কাকাতো ভাই ৪ জন, বোন একজন। মোট ১৪ ভাইবোন। কাকা কম বয়সেই গত হন। বিলাসী জীবন আমাদের ছিল না। তবে গ্রামের মানুষের কাছে আমরা ছিলাম বড়লোক। পরিবারে অনেক সদস্য থাকলেও খাবারের অভাব হতো না কখনোই। এমনকি দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থায়ও খাবারের কষ্ট করতে হয়নি। আমাদের একটা গুদামঘর ছিল। সেখানে বাবা পাশের বন্দর কাউখালী থেকে সারা বছরের চাল, ডাল, পাউডার দুধ, চিনি, লবণ, গুড় এনে ড্রামে ভরে রাখতেন। বাইরে যত সংকটই থাকুক না কেন, বছরজুড়ে খাবারের অভাব হতো না। সমস্যা হতো ঝড়ের সময়। উপকূলীয় অঞ্চলে এমন ঝড় মাঝে মাঝেই আসত। কখনও ঘরের চাল উড়ে গেলে আমরা সমস্যায় পড়ে যেতাম।
অন্যদের সামনে বাবা নিজের অবস্থানের জন্যই বেশি হাসি-তামাশা করতেন না। যখন আমাদের সঙ্গে থাকতেন, তখন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো হাসি-খুশি থাকতেন। তখনকার বাবাদের আমরা মারধর করতে দেখেছি, এমনকি খড়ম দিয়ে পেটাতে দেখেছি। বাবা আমার গালে জীবনেও একটা চড় মারেনি। কোনো ভাইবোনকেও মারধর করতে দেখিনি। তখন হয়তো আরও এমন বাবা ছিলেন। তবে গ্রামে আমি এমন বাবা আর দেখিনি। সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলেও তিনি কখনও জিজ্ঞেস করতেন না, কেন দেরি করে ঘরে ফিরেছি।