একটি অসুস্থ বুনো পুরুষ হাতিকে পাওয়া গেল রাঙামাটির লংগদু এলাকায়। হাতিটির পায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল। ভালো করে চলাফেরা করতে পারছিল না। এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। খাবারের অভাবে হাতিটি মারা যাওয়ার উপক্রম। এ রকম এক অবস্থায় বন অধিদপ্তর আর স্থানীয় হাতি সংরক্ষণ দল হাতিটির চিকিৎসায় এগিয়ে এল। তাকে অজ্ঞান করে চিকিৎসা দিয়ে বনে আবার ছেড়ে দেওয়া হলো। সুস্থ হয়ে গত দুই মাসে হাতিটি বনের ভেতর স্বাভাবিক চলাফেরা করছে। মানুষের আঘাতে হাতিসহ অন্য বুনো প্রাণীদের এ রকম অনেক ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। বেশির ভাগ সময়ই আহত বুনো প্রাণীরা মারা পড়ে। লংগদুর হাতিটির জীবন ফিরে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
এ দেশে হাতির বসবাস উপযোগী বন নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ এলাকায় হাতি–মানুষের দ্বন্দ্ব হচ্ছে। গত এক যুগে মারা গেছে শতাধিক হাতি। হাতি মারা পড়লে খবরটি পাওয়া যায়; কিন্তু অন্য প্রাণীর খবর পাওয়া বিরল। ২০১৬ সালে এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, আমাদের বনে হাতি এখন টিকে আছে মাত্র ২৬৮টি। গত দশ বছরে কত হাতি মারা গেল সেই তথ্য জানা আছে; কিন্তু কী পরিমাণ হাতির বাচ্চা আমরা পেয়েছি সেই তথ্যটি অজানা। কেবল হাতি গণনা করলেই তা আবার জানা যাবে।
ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ টাঙ্গুয়ার হাওরে গেলাম পাখিশুমারি করতে। ১০ হাজার হেক্টরের এই হাওরটি পৃথিবীবাসীর কাছে বুনো হাঁসের স্বর্গ নামে পরিচিত। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে এই হাওরে লক্ষাধিক বুনো হাঁস দেখা যায়। এ বছর পাখিগণনায় পাওয়া গেল তার উল্টো ফল। পাখি দেখা গেল মাত্র ২২ হাজার। এত পাখি কমে যাওয়ার বড় কারণ হাওরটি ভালো নেই। চায়না জাল দিয়ে সারা হাওরে অবৈধ উপায়ে মাছ ধরা আর সঙ্গে পাখি শিকার। এ কারণে কমে গেছে পাখি। তাই এবার শীতের পাখিশুমারিতে যেকোনো বছরের তুলনায় সবচেয়ে কম পাখি পাওয়া গেছে।
এ বছরের প্রথম দিকে সোনাদিয়ায় গিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বিরল পাখি চামুচঠুঠো বাটানের দেখা পাইনি। তবে জানুয়ারির শেষ ভাগে মহেশখালীর সোনাদিয়ায় দেখা গেছে তিনটি আর দুটি পাখির দেখা মিলেছে সন্দ্বীপের কাছাকাছি গাংগুরিয়া চরে। সোনাদিয়া ছিল এই পাখিটির সবচেয়ে ভালো আবাস। আস্তে আস্তে এই দ্বীপটিও পাখিটির অনুপোযোগী হয়ে গেল।
গত দুই বছর আরেকটি পাখির গবেষণাকাজে নিয়মিত সুন্দরবন যাচ্ছি। এ সময়ের মধ্যে সুন্দরবনের ৩-৪টি খালে সুন্দরী হাঁস নামের এই পাখির উপস্থিতি পেয়েছি মাত্র ৬-৮টি। বাসার সন্ধান মিলেছে ২টি। এ বনে শতাধিক সুন্দরী হাঁস টিকে আছে বলে ধারণা করা হয়, যা গোটা পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ। কিন্তু এখন এর অবস্থাও ভালো না। আমরা আসলে জানি না পাখিটি কী কারণে এত দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘দ্য লিভিং প্লানেট’ রিপোর্টে বলা হয়েছে, গোটা পৃথিবীর ৭৩ শতাংশ বুনো প্রাণীর সংখ্যা কমেছে। তারা বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন ঝুঁকির মধ্যে আছে। আমাদের দেশে বন্য প্রাণীর সংখ্যা ১১০০–এর কাছাকাছি। এত প্রজাতির বন্য প্রাণীর জন্য বন আছে আছে মাত্র ২.
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল সুন্দরবন দিবস। সম্প্রতি সুন্দবনের বাঘ গণনার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের জাতীয় প্রাণী বাঘের সংখ্যা বেড়ে এখন ১২৫টি হয়েছে। বিপন্ন একটি প্রাণীর সংখ্যা বনে বেড়েছে, যা নিশ্চয় ভালো খবর। এক বাঘ ছাড়া অন্য কোনো বুনো প্রাণীর বেড়ে যাওয়ার খবর আমরা শুনি না। বাঘ গবেষণায় সরকার বেশ ভালো কাজ করেছে। বন রক্ষার পাশাপাশি বাঘের নিরাপদ আবাস তৈরি করা হয়েছে।
আজ বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘বন্য প্রাণী সংরক্ষণে অর্থায়ন, মানুষ ও ধরিত্রীর উন্নয়ন’। বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণে সরকারের ভূমিকা বাড়ানোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারলেই নিরাপদ বন হবে সব প্রাণীর।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বন য প র ণ আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে
দেশে এক দশকে বনভূমি হ্রাস পেয়েছে ১ লাখ ১ হাজার হেক্টর, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় সাড়ে তিন গুণ। গত এক দশকে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির গাছ।
সারা দেশে বনাঞ্চলে যে পরিমাণ গাছ আছে, গ্রামাঞ্চলে গাছের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তবে গ্রামে গাছের ঘনত্ব কম। আর বন উজাড় বেশি হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। সেখানে একমুখী প্রজাতির ফসল চাষের প্রসার ও সড়ক সম্প্রসারণের কারণে বন উজাড় হচ্ছে।
বনের সার্বিক চিত্র জানতে ২০২৪ সালে বন অধিদপ্তরের করা জাতীয় বন জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়২০১৫ সালে জাতীয় বন জরিপে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সেটি এখন কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বন জরিপে দেশে বনভূমি আছে ১৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর। আগের বন জরিপে যেটির পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।’
‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা, অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা’র আহ্বান জানিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবসের মর্যাদা দেয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে বন উজাড়ীকরণের হার ১ দশমিক ১ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে সেটি ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
বন অধিদপ্তরের ২০টি দল মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে ২০২৪ সালের মার্চে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়। উপকূলীয় বন, শালবন, সুন্দরবন, পার্বত্যাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় মোট ১ হাজার ৮৫৮টি নমুনা প্লটের ভিত্তিতে এ জরিপের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে।
জরিপে দেশে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব পাওয়া গেছে ১১৭টি। সবচেয়ে বেশি গাছের ঘনত্ব আছে সুন্দরবনে। এখানে গাছের ঘনত্ব প্রতি হেক্টরে ৭০২টি। বনাঞ্চলের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় গাছের ঘনত্ব কম হলেও মোট গাছের পরিমাণ বেশি। গ্রামীণ এলাকায় মোট গাছের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি।
২০১৫ সালের বন জরিপে গাছের সংখ্যা ছিল ১৬৯ কোটি। সাম্প্রতিক জরিপে সেটা কিছুটা কমে হয়েছে ১৫৭ কোটি। গত এক দশকে হ্রাস পাওয়া গাছের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। জরিপে সারা দেশে ৩২৬টি গাছের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪২টি প্রজাতি পাওয়া গেছে পার্বত্যাঞ্চলে। সুন্দরবনে পাওয়া গেছে ২২ প্রজাতির গাছ। এর আগে বন জরিপে (২০১৫) ৩৯০ প্রজাতির গাছ শনাক্ত করেছিল বন অধিদপ্তর। গত এক দশকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ।
কেন কমছে পার্বত্যাঞ্চলের বন
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এক গবেষণায় পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশের মোট বন আচ্ছাদনের ৪০ শতাংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দ্রুত প্রসার ঘটছে অর্থকরি ফলের চাষ (হর্টিকালচার) ও একমুখী প্রজাতির বনায়ন (মনোকালচার), যেমন রাবারবাগান।
জানতে চাইলে জাতীয় বন জরিপের সঙ্গে যুক্ত থাকা বন অধিদপ্তরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) জহির ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বৈধ ও অবৈধভাবে বন উজাড় হয়ে আসছে। এখানে একদিকে বন উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে বনায়ন করা যায় না। যার কারণে এখানে বনভূমি হ্রাস পাওয়ার পরিমাণ বেশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বন বিভাগ কিছু করতে পারে না। পাহাড়িরা কিছু গামার আর সেগুনগাছের বাগান করেন। পুরো পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক সম্প্রসারণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। যেমন সীমান্ত রোড হয়েছে।
কামাল হোসাইন বলেন, এ ছাড়া এখানে বিনোদনকেন্দ্র ও রিসোর্টের সংখ্যা বাড়ছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে অনেক প্রভাবশালী এখন ড্রাগন, কাজু ও আমের চাষ করছেন প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে। এ অঞ্চলের বনের ওপর বহুমুখী চাপের কারণে এখানে বনাঞ্চল হ্রাস পাওয়ার হার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি।
কামাল হোসাইন আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেউ বনকে ভালোবাসে না। মানুষের লোভের শিকার হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক বন। এটাই আমাদের সর্বনাশ করেছে।’