আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ: ইফতারির থালা ঘিরে সৌহার্দ্য
Published: 4th, March 2025 GMT
মসজিদের এক পাশে শামিয়ানা টানিয়ে সাজানো হচ্ছে প্লেট। একটা বড় টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে স্বেচ্ছাসেবকেরা প্লেটে প্লেটে বেড়ে দিচ্ছিলেন পেঁয়াজু, বেগুনি, ছোলা, মুড়ি, আলুর চপ, পাকোড়া ও জিলাপি। বড় টেবিলের পাশেই বিশাল এক ড্রামে রুহ আফজা, লেবু আর চিনি মিশিয়ে শরবত তৈরি করছিলেন একজন। বরফের বড় খণ্ড ভেঙে টুকরা করে দেওয়া হচ্ছিল ড্রামে। রোজাদারেরা এই হৃদয়জুড়ানো ঠান্ডা শরবত পান করেই ইফতার শুরু করবেন।
২৪ বছর ধরে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদে এমন গণ–ইফতারের আয়োজন চলছে। এর মধ্যেই এটি নগরের অন্যতম ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এখানে ইফতারে শামিল হতে দূরদূরান্ত থেকে যেমন লোকজন আসেন, তেমনি পথচারী, শ্রমজীবীসহ নানা পেশার মানুষও থাকেন। ইফতারির থালায় ধনী-গরিবের ব্যবধান ঘুচে যায়।
বরফের বড় খণ্ড ভেঙে টুকরা করে দেওয়া হচ্ছিল ড্রামে। রোজাদারেরা এই হৃদয়জুড়ানো ঠান্ডা শরবত পান করেই ইফতার শুরু করবেন।গতকাল সোমবার বিকেল সাড়ে চারটায় আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদের মূল ফটকের পর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলে চোখে পড়ে অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপত্যে গড়া মূল ভবন, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতবর্ষের মোগল শাসকদের অন্যতম গর্বের ইতিহাস—চট্টগ্রাম বিজয়ের ঘটনা। সাড়ে তিন শতাব্দীর পুরোনো আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ এখনো তার মহিমা হারায়নি এতটুকু। হাজারো ধর্মপ্রাণ মুসল্লি এখানে নামাজ আদায় করেন প্রতিদিন।
মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এই মসজিদ সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট ওপরে পাহাড়চূড়ায় নির্মিত হয়েছে। মূল মসজিদের নকশা অনুযায়ী এটি ১৮ গজ দীর্ঘ, সাড়ে ৭ গজ প্রশস্ত। মসজিদের পশ্চিমের দেয়াল পোড়ামাটির ইটে তৈরি, বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের। ছাদের মধ্যে একটি বড় গম্বুজ ও দুটি ছোট গম্বুজ। চারটি অষ্টভুজাকৃতি বুরুজের মধ্যে পেছন দিকের দুটি এখনো টিকে আছে।
খোলা বড় চত্বর আর জাফরিকাটা খিলানের সাবেকি মসজিদে বিকেলের আলো এসে পড়ায় এক মায়াময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে প্লেটে প্লেটে ইফতারি পরিবেশনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন স্বেচ্ছাসেবকেরা।
আবুল হোসেন জানালেন, আজকের (সোমবার) আয়োজনে ৭০ কেজি ছোলা, ২৫ কেজি পেঁয়াজু, ২৫ কেজি বেগুনি, ৪০ কেজি আলুর চপ তৈরি করেছেন তাঁরা। সকাল সাতটা থেকে শুরু হয় রান্নার কাজ। চলে দুপুর পর্যন্ত। রান্নার কাজে তাঁর সঙ্গে ১০ জন সহযোগী ছিলেন।মসজিদের ইফতার আয়োজনের জন্য রান্নার কাজটা সামলান বাবুর্চি আবুল হোসেন। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিন বছর ধরে শাহি মসজিদে ইফতার আয়োজনে যুক্ত তিনি। আবুল হোসেন জানালেন, আজকের (সোমবার) আয়োজনে ৭০ কেজি ছোলা, ২৫ কেজি পেঁয়াজু, ২৫ কেজি বেগুনি, ৪০ কেজি আলুর চপ তৈরি করেছেন তাঁরা। সকাল সাতটা থেকে শুরু হয় রান্নার কাজ। চলে দুপুর পর্যন্ত। রান্নার কাজে তাঁর সঙ্গে ১০ জন সহযোগী ছিলেন।
মসজিদের এক কোণে প্রতিবছরের মতো এবারও বড় ড্রামে শরবত তৈরি করছিলেন মো.
বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মসজিদ প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সিকিউরিটি গার্ড, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে রিকশাচালক—কে নেই এই গণ-ইফতার আয়োজনে। মসজিদের খতিবের একান্ত সচিব মো. হাসান মুরাদ এই আয়োজনের খুঁটিনাটি দেখভাল করেন। তিনি জানান, প্রতিবছর ইফতার আয়োজন চলে। বছর বছর এখানে মুসল্লি আর রোজাদারের সংখ্যা বাড়ছে।
চারজনই ভিন্ন বয়সের, পোশাকেও ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু সব ব্যবধান হঠাৎ যেন ঘুচে গেছে। ইফতারির থালা ঘিরে এক অনন্য সৌহার্দ্য তৈরি হয়েছে। এটাই এই গণ–ইফতারের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। আর এর টানেই এখানে রোজাদারেরা ছুটে আসেন।অনেকে এখানকার ইফতার আয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিজে থেকে যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে আলাপ হলো মো. তারেক, মাইনুদ্দিন ও জয়নাল আবেদিনের সঙ্গে। তারেক এলাকারই একটি স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। রোজার মাসে সে মসজিদে ইফতারি পরিবেশনের কাজ করবে বলে জানায়। বাকি দুজন মাইনুদ্দিন ও জয়নাল শ্রমজীবী। দিনভর কাজে ব্যস্ত থাকার পর তাঁরা বিকেলে এখানে আসেন ইফতার আয়োজনে শামিল হতে।
বড় দস্তরখানা বিছিয়ে সারি করে বসেন রোজাদারেরা। ভ্যানচালক রবিউল হোসেন আর ব্যাংকার নিজাম উদ্দিন বসেন পাশাপাশি। তাঁরা দুজনেই আন্দরকিল্লা এলাকায় কাজে এসেছিলেন। বাসা দূরে বলে এখানে ইফতার সেরে নিচ্ছেন। দুজনের পাশেই একটা বড় থালায় চারজন বসেছেন। চারজনই ভিন্ন বয়সের, পোশাকেও ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু সব ব্যবধান হঠাৎ যেন ঘুচে গেছে। ইফতারির থালা ঘিরে এক অনন্য সৌহার্দ্য তৈরি হয়েছে। এটাই এই গণ–ইফতারের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। আর এর টানেই এখানে রোজাদারেরা ছুটে আসেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইফত র র থ ল মসজ দ র ২৫ ক জ
এছাড়াও পড়ুন:
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বংশে তিনি প্রথম, তাই এত আয়োজন
চীনে উচ্চশিক্ষার জন্য অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে বেইজিংয়ের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া দেশটির যেকোনো শিক্ষার্থীর জন্য দারুণ সম্মানের। এ বছর পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন লি গুওইয়াও।
লির বাড়ি জেজিয়াং প্রদেশের ওয়েনজউ শহরে। এর আগে তাঁর বংশে শত বছরের ইতিহাসে কেউ পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাননি। এত বড় সম্মানের উপলক্ষ উদ্যাপন করতে তাই বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি লির পরিবার ও গ্রামের বাসিন্দারা। রীতিমতো লালগালিচা বিছিয়ে, মোটর শোভাযাত্রা করে, ব্যান্ড বাজিয়ে পরিবার ও গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করা লিকে সংবর্ধনা দেন তাঁরা, সঙ্গে ছিল ভূরিভোজের ব্যবস্থা। চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইবোতে এই সংবর্ধনার ছবি ও ভিডিও রীতিমতো ভাইরাল হয়ে যায়।
চীনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। যেটি ‘গাওকাও’ নামে পরিচিত। তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই পরীক্ষা বেশ কঠিন। পরীক্ষায় মোট ৭৫০ নম্বরের মধ্যে লি পেয়েছেন ৬৯১।
লির গ্রামের এক প্রতিবেশী জানান, লির বাবা নির্মাণশ্রমিক। লির মা মাত্র ২ হাজার ৮০০ ইউয়ান বেতনে একটি সুপারশপে কাজ করেন। সত্যি বলতে, ছেলেটি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমে এটা অর্জন করেছেন।
প্রতিবেশী আরেক গ্রামবাসী বলেন, লি তাঁর বাবার কাছ থেকে পাওয়া একটি পুরোনো মুঠোফোন দিয়ে প্রশ্নোত্তর অনুশীলন করতেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় গ্রামের গ্রন্থাগারে বসে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতে লিখে তারপর সেগুলো অনুশীলন করতেন। মাধ্যমিকে তিনি কখনো কোনো প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়েননি।
লিকে সংবর্ধনা দিতে শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য ভেঙে তাঁদের গ্রামের পূর্বপুরুষদের মন্দিরের প্রধান ফটক খোলা হয়, যা একটি বিশেষ সম্মানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
লিকে সংবর্ধনা দেওয়ার ছবি ও ভিডিও চীনজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
অনলাইনে একজন লেখেন, ‘পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ৬৯১ নম্বর! এটা অবিশ্বাস্য। সত্যিই পুরো পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করেছে!’
তবে কেউ কেউ এই জমকালো উদ্যাপন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তাঁরা বলেছেন, এটা কি একটু বাড়াবাড়ি নয়? উৎসবটা খুবই জাঁকজমকপূর্ণ, এতে ছেলেটার ওপর অকারণ চাপ তৈরি হতে পারে। স্নাতক হওয়ার পর কি পরিবার তাঁর কাছ থেকে অনেক বেশি কিছু প্রত্যাশা করবে না?