‘গণপরিষদ’ ও ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ নিয়ে যে কারণে বিএনপিতে সন্দেহ
Published: 5th, March 2025 GMT
ছাত্র-তরুণদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) স্বাগত জানালেও তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে ভিন্ন অবস্থানে বিএনপি। বিশেষ করে নতুন দলের নেতাদের সেকেন্ড রিপাবলিক ও গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি নিয়ে বিএনপিতে ‘সন্দেহ’ তৈরি হয়েছে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা মনে করছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিলম্বিত করার লক্ষ্য নিয়ে এ দাবি সামনে আনা হয়েছে।
বিএনপির নেতাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে—এখন পর্যন্ত ছাত্র-তরুণদের যে তৎপরতা, তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে তাঁদের মূল লক্ষ্য সংবিধান পুনর্লিখন বা আমূল পরিবর্তন। এর জন্য তাঁরা গণপরিষদ নির্বাচনের কথা সামনে আনছেন। এর সূত্র ধরে সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা সামনে আনা হচ্ছে; কিন্তু ছাত্র-তরুণেরা সংবিধানের আমূল পরিবর্তনের যে ভাবনা বা লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন, তাতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। এটি রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া কখনোই সম্ভব হবে না।
সংবিধানের মৌলিক সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য না হলে রাজনীতিতে বড় ধরনের বিভক্তি তৈরি করবে বলেও মনে করছেন বিএনপির নেতারা। এতে শেষবিচারে ছাত্র-তরুণদের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলেও ওই নেতারা মনে করেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের রাজনৈতিক দল এনসিপি গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। সেদিন দলটির ঘোষণায় বলা হয়, এনসিপির লক্ষ্য—একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন দলটির অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আবারও বলেছেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নতুন প্রজাতন্ত্র করতে হবে। তার জন্য নতুন সংবিধান এবং গণপরিষদ নির্বাচনের প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, গণপরিষদ নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনও একসঙ্গে হতে পারে।
নতুন দলটির ঘোষণায় সেকেন্ড রিপাবলিক ও গণপরিষদ নির্বাচনের দাবির বিষয়টি আসার পর বিএনপির নেতারা এ দুটি বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করে বক্তব্য দেন।
এর মধ্যে গত রোববার রাজধানীর লেডিস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘নতুন দল এসেছে, আপনারা সাবধান থাকবেন। আমি কিন্তু তাদের স্লোগান বুঝি না। আমি কিন্তু বুঝিনি কাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে। আমি এখনো বুঝিনি সেকেন্ড রিপাবলিক কী। কী বোঝায়, আপনার বুঝেছেন কি না, জানি না। অর্থাৎ একটা অসিলা ধরে জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে।’
এর আগের দিন শনিবার দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ এক অনুষ্ঠানে সেকেন্ড রিপাবলিক ও গণপরিষদ নির্বাচনের দাবির বিষয়ে কথা বলেন। তিনি এটাকে আরও দীর্ঘায়িত অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে করেন।
বিএনপির নেতারা বলছেন, সংবিধান সংস্কারে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি কেন, সেটি তাঁদের কাছে বোধগম্য নয়। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, সরকার সংবিধান সংস্কার কমিশন করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো এই কমিশনে তাদের পৃথক সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এখন সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে কোন কোন জায়গায় রাজনৈতিক দলগুলো একমত, কোথায় কোথায় ভিন্নমত, সে বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা হবে। তাহলে নতুন সংবিধানের কথা বলে গণপরিষদ নির্বাচনের প্রশ্ন আসছে কেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যার একটি সংবিধান আছে। সেই সংবিধানে শপথ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। যার প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেই সরকারের বয়স ছয় মাস পার হয়েছে। তাহলে এত দিন পর গণপরিষদের প্রয়োজন দেখা দিল কেন।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা বলছেন, ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি চরম স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে, তারা জনরোষের মুখে পালিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কোনো নতুন রাষ্ট্র হয়নি, নতুনভাবে দেশ স্বাধীনও হয়নি। যে সময়ে দেশে কোনো সংবিধান রচিত থাকে না, তখন নতুন রাষ্ট্রের জন্য গণপরিষদের প্রয়োজন হয়। গণপরিষদের সদস্যরা সংবিধান প্রণয়ন করেন, যে সংবিধানের ভিত্তিতে পরে সংসদ নির্বাচন হয়। বাংলাদেশে সে রকম কিছু হয়নি; বরং বিগত আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে, সংবিধানকে নিজেদের মতো তৈরি করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার বন্দোবস্ত করেছে। এখন সংবিধানকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের যে প্রত্যাশা, সেটির ভিত্তিতে তৈরি করতে হবে। এর জন্য গণপরিষদের প্রয়োজন পড়ে না।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে গণপরিষদ কেন? সংসদ কি সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না? আর সেকেন্ড রিপাবলিকের মানে কী, তাহলে তারা কি স্বাধীনতা স্বীকার করে না? তারা হয়তো ভেবেছে, তারা যা বলবে, দেশের মানুষ তা-ই মেনে নেবে। ব্যাপারটা সে রকম নয়। আমরা তাদের এত কথার জবাব দিতে ইচ্ছুক নই। তারা যা খুশি বলুক, করুক, আমরা একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই, দেশের মানুষ নির্বাচন চায়। এটাই আমাদের কথা।’
অবশ্য জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২২ অক্টোবর ‘সেকেন্ড রিপাবলিকের’ বিষয়টি প্রথম আলোচনায় এনেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সেদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা ও রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে ‘বিপ্লবী ছাত্র-জনতার গণজমায়েত’ থেকে পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়েছিল। সেটিরই একটি ছিল জুলাই বিপ্লবের চেতনার আলোকে ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে নতুন করে প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক ঘোষণা।
এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম রিপাবলিক হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের পর যে সংবিধান প্রণীত হয়েছে, সেই সংবিধানে কিছু কাঠামোগত ত্রুটির কারণে সরকার ও প্রধানমন্ত্রী কর্তৃত্বপরায়ণ ও ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে। এই কাঠামো বারবার সংশোধন করা হয়েছে।’
আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে নাগরিকেরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জনগণের রক্ষক হয়। এই পরিবর্তনগুলো করতে হলে সংবিধানে খুব র্যাডিকেল পরিবর্তন প্রয়োজন। এটিকেই আমরা “সেকেন্ড রিপাবলিক” বলছি।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ক ন ড র প বল ক ব এনপ র ন ত র জন ত ক র জন য এনস প প রথম সরক র সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
৯ ঘণ্টা ধরে শাহবাগ অবরোধ, জনভোগান্তি চরমে
জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং দ্রুত স্থায়ী বিধানে যুক্ত করার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় ৯ ঘণ্টা ধরে অবরোধ করে রেখেছেন ‘জুলাই যোদ্ধারা’। আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে জুলাই শহীদ পরিবার ও জুলাই যোদ্ধাদের (আহত) ব্যানারে তাঁরা এ ‘অবস্থান কর্মসূচি’ পালন করছেন।
রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই মোড় দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ে আশপাশের সড়কগুলোতে। এসব সড়কে দিনভর ব্যাপক যানজট তৈরি হয়। ফলে বৃষ্টির মধ্যে জীবনের তাগিদে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষদের বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়। বাধ্য হয়ে বিকল্প পথে চলে গণপরিবহন, অনেক যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেখা গেছে হেঁটে হেঁটে। বিশেষ করে অফিসফেরত মানুষকে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
বেলা ১১টায় শাহবাগ মোড়ের সঙ্গে যুক্ত সব সড়কের মুখ আটকে দিয়ে সড়কের মাঝখানে অবস্থান নেন অবরোধকারীরা। এ সময় তাঁরা জুলাই সনদ দ্রুত বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন দাবি জানান। অবরোধকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জুলাই যোদ্ধা সংসদ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম ওই কর্মসূচির উদ্যোগ নেয়। এ সময় অবরোধকারীরা ‘জুলাই নিয়ে টালবাহানা, চলবে না চলবে না’, ‘জুলাইয়ের চেতনা দিতে হবে ঘোষণা’, ‘জুলাই সনদ দিতে হবে, দিতে হবে, দিতে হবে’ স্লোগান দিতে থাকেন।
বন্ধ হয়ে পড়ে শাহবাগ থেকে ফার্মগেট, সায়েন্স ল্যাব ও গুলিস্তানগামী প্রধান সড়কগুলোও। ফলে সকাল থেকেই এসব এলাকায় যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এসব সড়কে চলাচলকারী গণপরিবহনগুলো বিকল্প পথে চলাচল করে।
বেলা তিনটার দিকে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ–সংলগ্ন মূল সড়কে পুলিশের ব্যারিকেড ও বাঁশ ব্যবহার করে সড়ক আটকে রেখেছেন অবরোধকারীরা। শাহবাগ থানার সামনের সড়কেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন তাঁরা।
বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ষাটোর্ধ্ব নূরে আলম বলেন, ‘কেরানীগঞ্জে যাব। কোনো বাস পাচ্ছি না। রিকশায় যে কিছু দূর যাব, তারাও ভাড়া বেশি চাচ্ছে।’ একপর্যায়ে হেঁটেই রওনা দেন তিনি।
এক পথচারী ইমরান হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দুই দিন পরপর সড়ক অবরোধ হয়। এর ভোগান্তি পোহাতে হয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের।’
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শাহবাগ থানার সামনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হতে দেখা যায় মোটরবাইক আরোহীদের। শাহবাগ থানার সামনে সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশাকে বাধা দিলে চালক বলেন, ‘এত দাবিদাওয়া এত দিন আছিলো কই।’ তবে গণপরিবহন আটকে দেওয়া হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যানবাহন এবং তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স শুরু থেকেই চলাচল করতে দেখা গেছে।
অবরোধকারীদের দাবি
অবরোধকারীদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে জুলাই শহীদ ও জুলাই যোদ্ধাদের স্বীকৃতি; শহীদ পরিবার ও আহতদের আজীবন সম্মান; চিকিৎসা, শিক্ষা ও কল্যাণের পূর্ণ নিশ্চয়তা প্রদান করা; শহীদ পরিবার ও আহতদের প্রতি দায়িত্ব গ্রহণ করা; আহতদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন, কর্মসংস্থান ও কল্যাণমূলক ব্যয় রাষ্ট্রকে বহন করা; আহত ও শহীদ পরিবারের জন্য আজীবন সম্মানজনক ভাতা নিশ্চিত করা; শহীদ পরিবার ও আহতদের জন্য বিশেষ আইনি সুরক্ষা ও সহায়তাকেন্দ্র গঠন করা; শহীদ ও আহতদের ওপর সংগঠিত দমন-পীড়নের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিচারকাজ সম্পন্ন করা এবং একটি স্বাধীন সত্য ও ন্যায় কমিশন গঠন করা।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খালিদ মনসুর বলেন, সকাল থেকেই শাহবাগে অবরোধের কারণে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। শাহবাগ থানা-পুলিশ আলোচনার মাধ্যমে অবরোধকারীদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
তবে জুলাই যোদ্ধা সংসদের মুখ্য সংগঠক মাসুদ রানা জানান, তাঁদের আন্দোলন চলছে। সনদ ঘোষণা না আসা পর্যন্ত তাঁরা এখানেই থাকবেন।