সাম্প্রতিক সময়ে ‘মব’ তথা সংঘবদ্ধ উচ্ছৃঙ্খলতা এমন উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত, অতীতের সকল মাত্রা অতিক্রম করিয়াছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এতটা অসহায় হইয়া পড়িয়াছে, অনেক সময় দেখিয়াও না দেখিবার ভান করিতেছে। আবার পুলিশের ঔদাসীন্য ও নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে অনেকে দলবদ্ধ হইয়া আইন স্বহস্তে তুলিয়া লইতেছে। রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক স্বার্থে যদ্রূপ এহেন অরাজকতা চলিতেছে, তদ্রূপ এই অবকাশে ব্যক্তিগত বিরোধেও মব উন্মাদনার মাধ্যমে অনেকেরই প্রতিশোধ গ্রহণের ঘটনা উড়াইয়া দেওয়া যায় না। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিরপরাধ ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী– এমনকি বিদেশি নাগরিকরাও ইহা হইতে রক্ষা পাইতেছে না। আমরা মনে করি, এই প্রকার পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলার জন্য অশনিসংকেত। মব সহিংসতা থামাইতে না পারিলে সাধারণ নাগরিক নিরাপত্তার হুমকির মুখে পড়িবে।
সমকালের প্রতিবেদনে প্রকাশ, অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে দেশে গণপিটুনির শতাধিক অঘটনে প্রায় সোয়াশত মানুষ প্রাণ হারাইয়াছে, যেইখানে এক দশকে মারা গিয়াছেন প্রায় আটশত মানুষ। মব সহিংসতা অনেকটা সংক্রামক ব্যাধির ন্যায়; এক স্থানে হইলে অন্যত্র উহার প্রভাব পড়িয়া থাকে এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করিতে না পারিলে দ্রুত বিস্তার ঘটে। সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে সাম্প্রতিক এইরূপ কতিপয় মবের সাক্ষী আমরা হইয়াছি, যেইগুলি হতাশাব্যঞ্জক। মঙ্গলবার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ‘ছিনতাইকারী’ আখ্যা দিয়া মব তৈয়ার করিয়া দুই ইরানি নাগরিকসহ তিনজনকে বেদম প্রহার করা হইয়াছে। একই দিবসের মধ্যরাত্রিতে গুলশানে সাবেক এক সংসদ সদস্যের সাবেক স্ত্রীর বাসায় প্রবেশ করিয়া তল্লাশির নামে মালপত্র তছনছ, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হইয়াছে। গত সোমবার চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় লুটপাট ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করিয়া গণপিটুনিতে দুইজনকে হত্যা করা হয়। একই দিবসে গাজীপুরে যাত্রীবাহী বাসকে জায়গা ছাড়িয়া দেওয়া লইয়া বাগ্বিতণ্ডার জেরে এক অটোরিকশাচালকের হাত ও পায়ের রগ কাটিয়া হত্যা করা হইয়াছে। চুরির অভিযোগে বর্বরোচিত হামলা কিংবা সন্দেহের বশে গণপিটুনির অঘটন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়াছে, যাহা যে কাহাকেও নিরাপত্তা লইয়া শঙ্কিত করিবে।
আমরা জানি, গণপিটুনি মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। কোনো অপরাধের তথ্য বা কাহারও বিরুদ্ধে মামলা অথবা অভিযোগ থাকিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করাই নাগরিক দায়িত্ব। ইহার বিপরীতমুখী আচরণ রাষ্ট্রীয় আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের শামিল। যে কোনো অপরাধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করিলে তাহারাই ন্যায়ানুগ ব্যবস্থা লইতে তৎপর থাকে। তাহা না করিয়া, আইন স্বহস্তে লইবার এই প্রবণতা কেন? ইহাতে নাগরিকগণ আইনের প্রতি ভরসা হারাইবে। আবার অত্যুৎসাহী বা ক্রুদ্ধ হইয়া কাহারও বিরুদ্ধে দলবদ্ধভাবে সহিংসতা করিবার পরও তাহাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না লইলে আইন ভঙ্গকারীরা আরও প্রশ্রয় পাইবে।
আমরা মনে করি, জননিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে মব সহিংসতা কঠোর হস্তে দমন করিতে হইবে। এই ক্ষেত্রে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয়তার বিকল্প নাই। সরকারের দিক হইতেও তাহাদের প্রতি কঠোর হইবার বার্তা দিতে হইবে। কোনো সভ্য সমাজে এই প্রকার বেআইনি কর্মকাণ্ড চলিতে পারে না।
গত বৎসর ৫ আগস্ট হইতে মব নামক উচ্ছৃঙ্খল আচরণ চলিতেছে। মধ্যখানে এই প্রবণতা হ্রাস পাইলেও সাম্প্রতিক সময়ে উহা পুনরায় বৃদ্ধির দায় অন্তর্বর্তী সরকার পরিহার করিতে পারে না। ইতোমধ্যে মবসৃষ্ট যেই সকল হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়াছে, সেইগুলির বিচার হইলেও সকলের নিকট কঠোর বার্তা যাইবে। বস্তুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনয়নে ইহার বিকল্প নাই। কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবহেলা থাকিলে উহাও খতাইয়া দেখা দরকার। নাগরিকদিগকেও উৎকর্ণ থাকিতে হইবে। কোথাও মব সহিংসতা দেখিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিতকরণ কিংবা সুসংগঠিত হইয়া উহাকে রুখিয়া দিতে হইবে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
‘কৃষির উন্নয়নে জাপানের অংশীদারিত্ব আরও বৃদ্ধি করা হবে’
স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেছেন, “জাপান বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্যতম প্রধান অংশীদার ও পরীক্ষিত বন্ধু। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)-এর মাধ্যমে দেশটি বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে আসছে। আগামী দিনে বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে জাপানের অংশীদারিত্ব আরও বৃদ্ধি করা হবে।”
বুধবার (৩০ এপ্রিল) সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাঁর অফিসকক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত Saida Shinichi-এর সাক্ষাৎকালে তিনি এসব কথা বলেন।
বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে কৃষি খাতে সহযোগিতা বিশেষ করে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ, ফসলের পোস্ট হার্ভেস্ট ম্যানেজমেন্ট ও সংরক্ষণ, জলবায়ু ও স্মার্ট কৃষি, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা, ২০২৭ সালে জাপানের ইয়োকোহামাতে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক হর্টিকালচার এক্সপো’তে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ, কৃষি বিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা, নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পুলিশ সংস্কার, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যু সহ পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকের শুরুতে রাষ্ট্রদূতকে স্বাগত জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, “জাপান বাংলাদেশের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আগামী দিনগুলোতে এ সম্পর্ক আরও জোরদার হবে।”
উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, “২০২৭ সালে জাপানের ইয়োকোহামা'তে ‘আন্তর্জাতিক হর্টিকালচার এক্সপো’ অনুষ্ঠিত হবে। আন্তর্জাতিক এ এক্সপো'তে বাংলাদেশকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ।”
উপদেষ্টা বলেন, “বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। আর জাপান কৃষি খাতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারী দেশ। তাই জাপান বাংলাদেশের কৃষি খাতে বিশেষ করে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ, ফসলের পোস্ট হার্ভেস্ট ম্যানেজমেন্ট ও সংরক্ষণ, জলবায়ু ও স্মার্ট কৃষি, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি খাতে সহযোগিতা করতে পারে।”
তিনি বলেন, “জাপান বাংলাদেশের কৃষি পণ্য সংরক্ষণে আধুনিক হিমাগার স্থাপন ও কুলিং ভ্যান সরবরাহ করে সহযোগিতা করতে পারে। তাছাড়া জাপান আমাদেরকে আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি দিয়ে সহায়তা করতে পারে।”
তিনি এসময় রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে সহযোগিতার আহ্বান জানান।
রাষ্ট্রদূত বলেন, “কৃষি বিষয়ক দু'দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সর্বশেষ সভা ২০২৪ সালের মে মাসে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দ্রুত এ সংক্রান্ত পরবর্তী সভা আয়োজন করা দরকার।”
উপদেষ্টা জানান, জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের পরবর্তী সভা এ বছরের অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে পারে। এ সভা আয়োজনের বিষয়ে বাংলাদেশ সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূতের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “বর্তমানে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে। তবে এটির আরও উন্নতির সুযোগ রয়েছে এবং আমরা এ ব্যাপারে চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন হবে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, “তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কোনো সুযোগ নেই, বরং দিন দিন এটির উন্নতি ঘটবে বলে আমি আশা করছি।”
পুলিশের সামর্থ্য ও গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, “৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতির তুলনায় বর্তমানে পুলিশের সামর্থ্য, মনোবল ও বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেশি বেড়েছে।”
তিনি এসময় আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় জাপানের সহায়তা কামনা করেন। তাছাড়া তিনি নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ডকে পেট্রোল ভেসেল ও আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সহযোগিতা এবং অধিক সংখ্যক পুলিশ সদস্যকে জাপানে উন্নত প্রশিক্ষণে প্রেরণের জন্য রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ করেন।
রাষ্ট্রদূত জানান, আগামী ইন্টারপোল নির্বাচনে নির্বাহী কমিটির সদস্য পদে জাপানের পক্ষ থেকে মনোনয়ন প্রদান করা হবে। উপদেষ্টা এ পদে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাপানকে পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস প্রদান করেন।
বৈঠকে কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাপান দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এস