একচুলার মুখে শুকনা কলাপাতা। তাতে আগুন লাগিয়ে চোঙায় ফুঁ দিচ্ছেন। চুলার ওপর কড়াইয়ে একমুঠো চাল। খড়ের মোড়ায় বসে কড়াইয়ে থাকা সেই চালে বাঁশের লাকড়ি নাড়ছিলেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা ধাত্রী মোছা. বেগম।
কী করেন জিজ্ঞাসা করতেই একগাল হেসে নিজের বসা মোড়া এগিয়ে দিয়ে বেগম বলেন, ‘বইসো। ইফতার করমো ওই জন্য আনা চাল ভাজি। ভাজা চাউলোত মরিচ–পেয়াজ মাখি লবণ দিয়া রোজা ভাঙমো। এ ছাড়া যে হামার উপায় নাই।’
বেগমের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের মেনানগর গ্রামে। আজ শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় তাঁর বাড়িতে গিয়ে এমনি দৃশ্য দেখা যায়। রাজকীয় পদবির নাম বেগম হলেও তাঁর জীবনের এর ছিটেফোঁটাও নেই। টানাপোড়নের মধ্যে চলছে তাঁর জীবন।
বেগম জানান, ফুটফুটে সুন্দর হওয়ায় মা–বাবা তাঁর নাম রেখেছিলেন বেগম। কিন্তু বেগমের যে সুখ তাঁর কপালে তা নেই। অভাবের কারণে অল্প বয়সেই তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। দিনমজুর স্বামীর সংসারে অভাব তাড়াতে ধাত্রীর কাজ শুরু করেন তিনি। বয়সের ভাড়ে ন্যুব্জ হওয়ায় সেই কাজ এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ৯ বছর আগে তাঁর স্বামী সমশের উদ্দিন মারা যান। স্বামী-সন্তানহীন জীবনে সংসার খরচ চালাতে টানাপোড়েনে পড়েন তিনি। এখন এবাড়ি–ওবাড়ি ঘুরে চলে তাঁর সংসার। সহায়সম্বল বলতে অন্যের জমিতে ছয় হাত টিনের চালায় ভাঙা একটি চৌকি আর রান্না বাসনপত্র।
রমজান মাসে ইফতারি বা ভালোমন্দ খাবারের চিন্তা নয়; জীবনের পড়ন্ত বেলায় কে ধরবে সংসারে হাল, কে ধরবে খাটিয়া—এমন চিন্তাই পেয়ে বসেছে তাঁকে।
দুই হাত তুলে মোছা.
প্রতিবেশী জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের তিন ভাই–বোনের জন্ম বেগমের হাতে। কিন্তু তাঁর কোনো সন্তান নেই। এবাড়ি–ওবাড়ি খুঁজে তাঁর সংসার চলে।’
ওই গ্রামের বৃদ্ধা সোমেদা খাতুন বলেন, বেগমের চেহারা বেগমইরই মতো। কিন্তু তাঁর পুরো জীবনে শুধু কষ্ট আর কষ্ট। ধাত্রী কাজ, দিনমজুরি কাজ করে তাঁকে জীবন চালাতে হয়েছে। এখন বয়সের ভাড়ে কিছু করতে পারেন না। জীবনের শেষ সময়ে এমন অবস্থা খুবই কষ্টের।
ওই গ্রামের বাসিন্দা ইউপি সদস্য জিয়াউর রহমান বলেন, ‘বেগম নিঃসন্তান। তাঁর স্বামীও মারা গেছে। তাঁর মতো অসহায় এ গ্রামে নেই। তাঁকে বয়স্কভাতা করে দিয়েছি। কিন্তু যে সামান্য টাকা তা দিয়ে সংসার চালানো কষ্ট কর। এলাকার সাহায্যে তিনি ঠিকে আছে।’
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ড্রোন ও উড়ুক্কু যানে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চীনের
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির দৃশ্যপট যেন বাস্তবে রূপায়ণ করছে চীন। শহরজীবনের পরিবহন ও লজিস্টিকস খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে স্বল্প উচ্চতার আকাশ অর্থনীতির বিস্তার ঘটাচ্ছে দেশটি। চীনের মাটিতে যেকোনো বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের পেছনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। স্বচালিত উড়ন্ত গাড়ি ও ডেলিভারি ড্রোনের ব্যবহার বাড়িয়ে আকাশপথকে নাগরিক জীবনের নিয়মিত যাতায়াত ও সেবার অংশ করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে চীনের সরকার ও বেসরকারি খাত।
ইতিমধ্যে স্বচালিত উড়ন্ত গাড়িকে বাণিজ্যিক যাত্রী পরিবহনের লাইসেন্স বা অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়েছে; তৈরি করা হয়েছে অনুকূল নীতিমালা। ড্রোনের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহেও দ্রুত প্রসার ঘটছে। চীনের এই উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ শুধু দেশীয় বাজারেই নয়, বৈশ্বিক পর্যায়েও তাদের আকাশপথে যাতায়াতের উদ্ভাবনে নেতৃত্বে নিয়ে যেতে পারে—এমনটাই ধারণা করছেন প্রযুক্তিবিদেরা।
বিশ্বের অনেক দেশেই ড্রোন ডেলিভারি ও উড়ন্ত গাড়ির ব্যবহার এখন পরীক্ষামূলক পর্যায়ে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ সালের পর থেকে ওয়ালমার্ট পণ্য সরবরাহে দেড় লাখ বার ড্রোন ব্যবহার করেছে। কিন্তু চীনে এই প্রযুক্তি এখন আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন নয়, হয়ে উঠছে বাস্তবতার অংশ।
এখন পর্যন্ত এই অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও এটির বিস্তার ঘটছে দ্রুতগতিতে। চীনের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অনুমান, ২০২৫ সালের মধ্যে এই খাতের বার্ষিক আয় দাঁড়াবে ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন বা দেড় লাখ কোটি ইউয়ান বা ২০ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। ২০৩৫ সালের মধ্যে তা ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন বা সাড়ে তিন লাখ ইউয়ানে উঠতে পারে।
চীনের জনপ্রিয় খাদ্য সরবরাহকারী কোম্পানি মেইতুয়ান একাই ২০২৪ সালে ড্রোন ব্যবহার করে ২ লাখের বেশি পণ্য সরবরাহ করেছে। , যেটি আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এই খাত যে সম্প্রসারণ হচ্ছে, তার আরেকটি নজির হলো, উড়ুক্কু গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানি ইহ্যাংয়ের শেয়ারদর গত দুই বছরে প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
চীনের অনেক কোম্পানি এখন এই খাতে কাজ করছে। চায়না লো অল্টিটিউড ইকোনমি অ্যালায়েন্সের প্রধান লো জুন এক সম্মেলনে জানিয়েছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে চীনে কমপক্ষে ১০০টি কোম্পানি এ ধরনের যান উৎপাদন করবে। ২০২৪ সালের শেষে চীনে বেসরকারি ব্যবহারে নিয়োজিত ড্রোনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ।
চীনের শহর ও গ্রাম, সীমান্ত ও দ্বীপ—সবখানেই এখন ড্রোনের ছোঁয়া। খাবার ছাড়া শুধু গত এক বছরে ড্রোনে পণ্য সরবরাহ হয়েছে ২৭ লাখেরও বেশিবার। দ্য ইকোনমিস্ট-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্দান্ত গতিতে এগোচ্ছে এক নতুন আকাশ অর্থনীতি। চীনের ডাক বিভাগ চায়না পোস্টও পণ্য সরবরাহে ড্রোন ব্যবহার শুরু করেছে। শহরের হাসপাতালগুলোয় জরুরি ভিত্তিতে রক্ত পৌঁছানো হচ্ছে, কৃষিজমিতে সার ও কীটনাশক ছিটাচ্ছে লাখ লাখ কৃষিড্রোন। ড্রোনের বিচিত্র ব্যবহারও হচ্ছে। যেমন কোথাও উঁচু ভবনে আগুন নিয়ন্ত্রণে হাজির হচ্ছে ড্রোন। সীমান্ত এলাকায় মাদক চোরাচালানের ওপর নজরদারিতেও ব্যবহৃত হচ্ছে ড্রোন। আবার রোগের পরীক্ষার নমুনা দ্রুত ল্যাবে পৌঁছে দিতেও ব্যবহৃত হচ্ছে আকাশপথ।
২০২৩ সালের শুরুর দিকে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং বার্ষিক সরকারি কর্মপরিকল্পনায় ‘লো অল্টিটিউড ইকোনমি’কে ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির প্রধান খাত হিসেবে ঘোষণা করেন। এ কারণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের পাশে জায়গা করে নেয় ড্রোন ও উড়ুক্কু যান। গত বছরের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা সংস্থা এই নতুন আকাশ অর্থনীতির জন্য আলাদা বিভাগও চালু করেছে। চীন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ড্রোন ও উড়ুক্কু গাড়ি এখন আর কল্পনা নয়, নতুন বাস্তবতা।
এদিকে ড্রোনের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও উড়ুক্কু গাড়ি উৎপাদনেও গতি এসেছে। দেশটির বড় বড় গাড়ি কোম্পানি এখন উড়ুক্কু যান তৈরির দিকে ঝুঁকছেন।
চীনের আকাশপথে দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীর কড়া নিয়ন্ত্রণে ছিল। আকাশপথের প্রায় ৯০ শতাংশ জায়গা সামরিক কাজের জন্য বরাদ্দ থাকায় বেসামরিক যাত্রার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। স্বল্প উচ্চতার এই আকাশ অর্থনীতির জন্য সরকার আকাশপথ বাণিজ্যের জন্য খুলে দিতে শুরু করেছে। ৬০০ মিটারের নিচের আকাশপথ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য শেনজেন, হেফেইসহ ছয়টি শহরকে বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়েছে। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও নতুন করে ‘লো অল্টিটিউড প্রযুক্তি ও প্রকৌশল’ বিষয়ে কোর্স চালু করছে। অর্থনৈতিক মন্দায় জর্জরিত অনেক জেলা প্রশাসন এখন এই নতুন শিল্প নিয়ে আগ্রহী। ড্রোন ও উড়ুক্কু গাড়ি খাতের বদৌলতে তারা অর্থনৈতিক সাফল্য আশা করছে।
[দ্য ইকোনমিস্ট-এর প্রতিবেদন অবলম্বনে অনুবাদ করা]