ইসলামের বিধানগুলো কেবল বাহ্যিক প্রথা, রীতি ও আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়, বরং এর রয়েছে আধ্যাত্মিক ও অন্তর্নিহিত নানা তাৎপর্য। ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ রোজাও বহুবিদ আধ্যাত্মিক উপকার ও কল্যাণে পরিপূর্ণ। বুজুর্গ আলেমরা বলেন, রমজান হলো আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গিন হওয়ার মাস। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর রং, রঙ্গের বিবেচনায় আল্লাহর চেয়ে উত্তম কে আছে। আর আমরা তাঁর ইবাদতকারী।’ [সুরা বাকারা, আয়াত : ১৩৮]
উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহর রং ধারণের পদ্ধতিও বলা হয়েছে। তা হলো, আল্লাহর ইবাদতে আত্মমগ্ন হওয়া। রমজান মাসে মহানবী (সা.
আলোচ্য হাদিস থেকে জানা যায়, রমজানে আধ্যাত্মিক উন্নতির উপায় তিনটি: ক. অধিক পরিমাণ নামাজ আদায় করা, খ. দোয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া এবং তাতে মিনতি ও রোনাজারি করা, গ. অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করা। যে ব্যক্তি এই তিনটি আমল করবে তাদের ব্যাপারে আশা করা যায়, সে আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গিন হতে পারবে এবং রমজানে তার আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধিত হবে।
আরো পড়ুন:
যেসব কাজে রোজা হালকা হয়
রমজানের আমলগুলো যেভাবে ফলপ্রসূ হবে
মুমিন ব্যক্তি রমজান মাসে তারাবি ও তাহাজ্জুদসহ অন্যান্য নফল নামাজের প্রতি যত্নবান হবে। বিশেষত গুরুত্বের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করবে এবং শেষ রাতে তাহাজ্জুদ আদায় করবে। নফল নামাজের মধ্যে তাহাজ্জুদের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। তাহাজ্জুদ আদায় করা ছাড়া কোনো ব্যক্তি আল্লাহর ওলি হতে পারে না। ফরজ নামাজের পর পবিত্র কোরআনে তাহাজ্জুদ নামাজের আলোচনায় সবচেয়ে বেশি এসেছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়বে। এটা তোমার অতিরিক্ত দায়িত্ব। অচিরেই তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’ [সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৭৯]
অন্যত্র এসেছে, ‘আর আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়।’ [সুরা ফোরকান, আয়াত : ৬৪]
আল্লাহ তাহাজ্জুদ আদায়কারীদের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘তারা শয্যা ত্যাগ করে তাদের প্রতিপালককে ডাকে আশায় ও আশঙ্কায়। আর আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে।’ [সুরা সাজদা, আয়াত : ১৬]
রমজানে আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গিন হওয়ার দ্বিতীয় উপায় আল্লাহর কাছে অধিক পরিমাণে দোয়া করা। মূলত দোয়ার মাধ্যমেই বান্দা আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের চাদরে আবৃত হয়। আল্লাহর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গভীর হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’ [সুরা মুমিন, আয়াত : ৬০]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যখন কোনো প্রার্থনাকারী আমাকে ডাকে, তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিই।’ [সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৬]
রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়ার কল্যাণ ও উপকারিতা তুলে ধরে বলেন, ‘আল্লাহর কাছে দোয়ার চেয়ে উত্তম কোনো ইবাদত নেই।’ [জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩৩৭০]
রোজাদার ব্যক্তি অধিক পরিমাণে দোয়া করবে। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) তার দোয়া কবুলের ঘোষণা দিয়েছেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া কবুল হয় : রোজাদারের দোয়া, অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া ও মুসাফিরের দোয়া।’ [সুনানে বায়হাকি]
মাহে রমজানের আধ্যাত্মিক কল্যাণ অর্জনের তৃতীয় অবলম্বন হলো, অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করা। এটা সিয়াম সাধনার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা আল্লাহভীতি অর্জন করতে পারো।’ [সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩]
বান্দার অন্তরে আল্লাহভীতি জাগ্রত আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে, আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর আলোচনার মাধ্যমে। বান্দা আল্লাহর নাম ও গুণাবলী যত বেশি আলোচনা করবে সে আল্লাহর পরিচয় তত বেশি জানতে পারবে। পাশাপাশি আল্লাহর জিকির বান্দার মনে আল্লাহর ভালোবাসা তৈরি করে। আল্লাহর ভালোবাসা বান্দাকে তাঁর পুরস্কারের প্রতি উৎসাহিত করে এবং শাস্তির ভয় জাগ্রত করে।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বিন মাওলানা জামিল আহমদ কাসেমি রোজার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ও কল্যাণ সম্পর্কে বলেন, রোজার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জিত হয়। অন্তরের পশুত্ব ও প্রবৃত্তির তাড়না প্রশমিত হয়, যা মানুষের ভেতর পার্থিব মোহ তৈরি করে ও পরকাল থেকে বিমুখ করে। রোজা অন্তর ও আত্মার উত্তম খোরাক এবং আত্মিক পরিশুদ্ধি লাভের উত্তম মাধ্যম। রোজা মানুষের ভেতর আল্লাহর আনুগত্যের আগ্রহ তৈরি করে। তা মানুষের ভেতর ফেরেশতার স্বভাব তৈরি করে। ফলে সে আল্লাহর নৈকট্য ও ভালোবাসা লাভ করে।
এ ছাড়াও রোজা মানুষের প্রবৃত্তি দমন করে, মানুষকে আত্মনিয়ন্ত্রণের দীক্ষা দেয়, মানুষকে ভেতর ধৈর্য্য ও সহনশীলতা শেখায়। রোজা রাখার মাধ্যমে মানুষ ক্ষুধা-পিপাসার যন্ত্রণা অনুভব করতে পারে, ফলে অসহায় ও দরিদ্র মানুষের প্রতি সহানুভূতি জাগ্রত হয় এবং জনকল্যাণমূলক কাজের তাগিদ অনুভব করে। রোজা মানুষকে পরনিন্দা, গালমন্দ, অশ্লীলতা ও অর্থহীন কাজ থেকে দূরে রাখে। এতে রোজাদারের ভেতর উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতা তৈরি হয়। সর্বোপরি রোজা মানুষের ভেতর ইখলাস ও নিষ্ঠা তৈরি করে। কেননা রোজাদার একান্ত নির্জনেও রোজা নষ্ট হয় এমন কিছু করে না।
আল্লাহ সবাইকে রোজার আধ্যাত্মিক সুফল লাভের তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস, সাঈদিয়া উম্মেহানী মহিলা মাদরাসা, ভাটারা, ঢাকা
শাহেদ//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স য় ম স ধন রমজ ন গ ন হওয় আল ল হ দ য় কর পর ম ণ কল য ণ রমজ ন
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে যাক
লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকটি নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, তার অবসান হবে আশা করা যায়। নির্বাচনের দিনক্ষণের বিষয়ে দুই পক্ষই নীতিগতভাবে একমত হয়েছে যে ২০২৬ সালের রোজার আগে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।
সাম্প্রতিক কালে নানা বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপি নেতৃত্বের বিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছিল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে বিএনপি–দলীয় প্রার্থী ইশরাক হোসেনের শপথ ইস্যু সেই বিরোধকে আরও বাড়িয়ে দেয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সর্বশেষ বৈঠকে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি ও আকাঙ্ক্ষা পুনর্ব্যক্ত করে।
কিন্তু ঈদুল আজহার আগের রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার ব্যাপারে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়। এর আগে বিএনপির নেতৃত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এনে তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে।
এমনই একটি পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফরের সময় লন্ডনে তাঁর সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বৈঠকের ঘোষিত যৌথ বিবৃতিতে নির্বাচনের দিনক্ষণের বিষয়টি সামনে এলেও দুই পক্ষের আলোচনা কেবল এর মধ্যে সীমিত ছিল না। প্রধান উপদেষ্টার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান ও সংস্কারের ধারাবাহিকতার ওপরও জোর দেন তঁারা।
বৈঠকের ফলাফলকে প্রায় সব দলই স্বাগত জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি ঘোষণার ধরন নিয়ে আপত্তি জানালেও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সরাসরি বিরোধিতা কেউ করেনি। আমরাও মনে করি, কোনো বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমেই তা সমাধান করতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ যারা সংস্কার ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে, সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। লন্ডন বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার ও বিচারকাজ দৃশ্যমান করার ওপর জোর দিয়েছেন। ভবিষ্যতে যাতে দেশে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনরাগমন না ঘটে, সে জন্য রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটি ত্বরান্বিত করা জরুরি। আবার অপরাধ করে যাতে কেউ পার না পায়, সে জন্য জুলাই-আগস্টের হত্যার বিচারও অপরিহার্য। কিন্তু এই দুটি বিষয়কে কোনোভাবে নির্বাচনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা সমীচীন হবে না।
যেসব সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে নির্বাচন ও সংবিধানের বিষয়টি জড়িত নয়, সেগুলো সরকার নির্বাহী আদেশেও বাস্তবায়ন করা যায়। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তেমন বাধা আসার কথা নয়। তবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার অর্থ এই নয় যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এখন নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করাই বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক দলগুলোর সার্বিক সহযোগিতা না থাকলে সরকার একা কাজটি করতে পারবে না।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তর্দলীয় ও আন্তদলীয় সংঘাতের যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা উদ্বেগজনক। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে না চললে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না। আমরা আশা করি, দিন-তারিখের বিষয়ে সমঝোতার পর নির্বাচনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন। রাজনীতিতে মত ও পথের পার্থক্য থাকবে; তাই বলে একে অপরকে ‘শত্রুজ্ঞান’ করার পুরোনো সংস্কৃতি থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে।