দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশ বা ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ কৃষি খাতে নিয়োজিত। জিডিপিতে কৃষির সরাসরি অবদান ১১ শতাংশ হলেও প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন ও বাণিজ্য মিলে কৃষি অর্থনীতির অবদান ২৩ শতাংশ। অথচ নগরকেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি অবহেলিত। রপ্তানিমুখী শিল্পে যে রকম গুরুত্ব দেওয়া হয়, গ্রামীণ কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্পে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না।

এর একটি কারণ হলো, দেশের রাজনীতিতে কৃষকের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, অংশীদারিত্বও নেই। দেশের রাজনীতি-অর্থনীতিতে কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর এমন আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের জন্য কৃষি খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও নীতিনির্ধারকদের কাছে কৃষকের স্বার্থ প্রাধান্য পায় না। এমনকি রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেড় দশকের স্বৈরশাসনের অবসানের পরও না। দেশে কত রকমের সংস্কারের কথা হচ্ছে; কাজ করছে কত রকম কমিশন! কিন্তু কৃষি সংস্কারের কোনো কমিশন করা হলো না। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের রিপোর্টে কৃষিবিষয়ক একটি অধ্যায় রাখা হয়েছে। ওই রিপোর্টে কৃষিবিষয়ক বেশ কিছু সুপারিশ থাকলেও অনেক জরুরি বিষয় বাদ পড়ে গেছে।

ওই রিপোর্টে বাংলাদেশের কৃষি খাতের বিকাশে কতগুলো অন্তরায় চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো– কৃষিজমির পরিমাণ ও উর্বরতা হ্রাস, শ্রমিক সংকট, ক্ষুদ্রচাষিদের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রবেশে সীমাবদ্ধতা, কৃষিপণ্যের দামে অস্থিতিশীলতা, কৃষিতে আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তির তুলনামূলক কম ব্যবহার, পুঁজি ও ঋণের সংকট, সীমিত সংখ্যক কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি। 

এসব সমস্যার সমাধান হিসেবে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য– কৃষির যান্ত্রিকীকরণ বাড়ানো, সেচের জন্য লো-লিফট পাম্পের বদলে এক্সিয়াল ফ্লো পাম্পের ব্যবহার, ফসল কাটার জন্য দুই চাকার রিপার মেশিন ব্যবহার, পর্যায়ক্রমে ভেজা ও শুকনো পদ্ধতিতে (অল্টারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রাইয়িং-এডব্লিউডি) সেচ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ, সৌরশক্তিচালিত সেচ, নিমের আস্তরণযুক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার, দেশীয় রাসায়নিক সার কারখানার উৎপাদন ও মজুত সক্ষমতা বাড়ানো, শস্য বহুমুখীকরণ, মানসম্পন্ন উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করা, মাছ চাষ, গবাদি পশু ও পোলট্রি পালনের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত জাতের ব্যবহার, স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে কোল্ডস্টোরেজ ও প্রসেসিং সেন্টার স্থাপন, কৃষিপণ্য পরিবহনে আধুনিক লজিস্টিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা ইত্যাদি।
টাস্কফোর্স রিপোর্টে উন্নত বীজ, জাত ও প্রযুক্তি ব্যবহারে গুরুত্ব আরোপ করা হলেও কৃষির বেশকিছু গুরুতর সমস্যা বিষয়ে কোনো সুপারিশ নেই। যেমন সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি, গবাদি পশু, মাছ, পোলট্রি খাদ্যসহ সব কৃষি উপকরণের ওপর বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে এসব উপকরণ কৃষককে চড়া দামে কিনতে হয়। অন্যদিকে উৎপাদিত ফসলের এমন একটি বিপণন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যার ওপরে কৃষকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে উৎপাদিত ফসল তাকে বিক্রি করতে হয় সবচেয়ে কম দামে। এ সমস্যা সমাধানে কৃষি উপকরণের বাজারে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, কর্তৃত্ব ও নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশ করা যেত। সেই সঙ্গে কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে প্রতিবেশী ভারতের মতো কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক দাম ঘোষণা করার কথা বলা যেত। 

ভারত সরকার প্রতিবছর মৌসুমের শুরুতে ২৩টি কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক দাম ঘোষণা করে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে ৭ ধরনের শস্য, ৭ ধরনের তেলবীজ, ৫ ধরনের ডাল ও ৪ ধরনের বাণিজ্যিক কৃষিপণ্য। ন্যূনতম সহায়ক দাম নির্ধারণ করা হয় ফসল উৎপাদন খরচের দেড় গুণ হারে। কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্ট অ্যান্ড প্রাইস (সিএসিপি) এই খরচের হিসাবটি করে প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি বাবদ খরচের সঙ্গে কৃষকের পারিবারিক শ্রমের দাম যোগ করে। ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ফুড করপোরেশন অব ইন্ডিয়া ও ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল কো-অপারেটিভ মার্কেটিং ফেডারেশনের মাধ্যমে ন্যূনতম সহায়ক দামে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের একটা অংশ সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিনে এবং নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে রেশন হিসেবে বিতরণ করে। এভাবে সরকার উৎপাদিত ধানের ৪০-৫০ শতাংশ এবং গমের ৩৫-৪০ শতাংশ কৃষকের কাছ থেকে কেনে। বাংলাদেশের কৃষককুলের জন্য উৎপাদন খরচের দেড় গুণ দরে কেনার কোনো ব্যবস্থা নেই। সরকার উৎপাদন খরচের সামান্য বেশি দামে মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ ধান ও চাল কেনে, তাও তার সুবিধা সাধারণত মিলাররাই পায়। 

দেশের কৃষি খাতের আরেকটি অনালোচিত বিষয় হলো কৃষিজমির মালিকানায় ব্যাপক বৈষম্য। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইএফপিআরআই) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫৬ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারের কোনো জমি নেই। সেই সঙ্গে শূন্য দশমিক ৫ একরের কম জমির মালিক প্রান্তিক চাষির হার ৪১ শতাংশ, যারা মাত্র ১১ শতাংশ ভূমির মালিক। অন্যদিকে ২ দশমিক ৫ একরের বেশি জমির মালিক বড় কৃষকের হার ৬ শতাংশ, যারা মোট কৃষিজমির এক-চতুর্থাংশের মালিক। ৪০ শতাংশ চাষি জমি বর্গা নিয়ে বা ভাড়া নিয়ে চাষাবাদ করেন। এই ভূমিহীন কৃষকদের জমির মালিকদের অনেক ক্ষেত্রেই উৎপাদনের অর্ধেক দিয়ে দিতে হয়। ফলে তাদের আর তেমন কিছু থাকে না। ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে অনুৎপাদক ও অনুপস্থিত ভূমি মালিকদের হাত থেকে বাড়তি কৃষিজমি ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বণ্টন করা হলে কৃষির উৎপাদন যেমন বাড়ত, সেই সঙ্গে গ্রামীণ দারিদ্র্য ও বৈষম্যও কম হতে পারত। এ ছাড়া সারাদেশে ৬২ হাজার একরের বেশি খাসজমি অবৈধ দখলে রয়েছে, যেগুলো উদ্ধার করে ভূমিহীনদের মাঝে বণ্টন করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সরকারই কার্যকর ভূমি সংস্কার করেনি। ভূমি সংস্কারে আইন হয়েছে; বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৭২ সালে আইন করে পরিবারপ্রতি জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা ১০০ বিঘা করা হয়। ১৯৮৪ সালে ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশে সিলিং করা হয় ৬০ বিঘা। সব শেষ ২০২৩ সালের ভূমি সংস্কার আইনে সিলিং ৬০ বিঘাই। কোনোটাই কার্যকর না হওয়াই ভূমির মালিকানায় বৈষম্যও দূর হয়নি।

অথচ যেসব উন্নয়নশীল দেশে যথাযথভাবে ভূমি সংস্কার করা হয়েছে, সেসব দেশের পক্ষেই গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণ, দ্রুত শিল্পায়ন ও টেকসই কৃষি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। ভূমি সংস্কারের সফল কয়েকটির উদাহরণ হলো চীন, ভিয়েতনাম, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ইত্যাদি। এসব দেশে সিলিং ঘোষণার মাধ্যমে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণের জন্য জমি উদ্ধার করে সেই উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন গ্রামীণ পরিবারের মাঝে বণ্টন করা হয়েছিল। পাশাপাশি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এসব দেশে কৃষককুলের অনুকূলে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তার মধ্যে রয়েছে– ফসলের ন্যায্য দাম প্রণোদনানীতি, কৃষি উপকরণে ভর্তুকির নীতি, উদার কৃষিঋণ নীতি, দক্ষ কৃষি সম্প্রসারণ সেবা, গ্রামীণ ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ, গ্রামীণ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ, কৃষি থেকে কর আহরণ কমানো ইত্যাদি।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বৈষম্য নিরসনে কৃষি খাতে এসব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। শুধু উন্নত বীজ, জাত ও প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়িয়ে কৃষি খাতের বিদ্যমান অসমতা দূর করা যাবে না। দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পর বাংলাদেশে নানা ধরনের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, এই পরিবর্তনের হাওয়ার মধ্যে কৃষি ও কৃষকের প্রতি অবহেলার সংস্কৃতির অবসান ঘটে কিনা।

কল্লোল মোস্তফা: লেখক ও গবেষক
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব যবহ র ক ষকদ র উৎপ দ ত র উৎপ দ র জন য ব যবস সরক র খরচ র ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

‘লিচুর বাগানে’ যে কারণে ‘পিরিতের বেড়া’ দিতে হয়

‘তাণ্ডব’ সিনেমার গান ‘লিচুর বাগানে’ প্রকাশের পর রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে। কফি শফ থেকে বাস, মেট্রোরেল আশপাশে কান পাতলে গানটা শোনা যাচ্ছে। কেউ না কেউ শুনছেন। সামাজিক মাধ্যমের স্টোরি ও রিলসেও গানটি ভেসে বেড়াচ্ছে। চরকি ও এসভিএফের অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত গানটির আজ পর্যন্ত (১২ এপ্রিল ২০২৫) ভিউ হয়েছে যথাক্রমে ১২ মিলিয়ন ও ৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন।

উচ্ছ্বসিত অনেক দর্শক গানটি নিয়ে মন্তব্যও করেছেন। তাহসিন নামের এক শ্রোতা লিখেছেন, ‘গানটির প্রতিটি সুর, দৃশ্য ও পরিবেশনায় বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অপূর্ব রূপ ফুটে উঠেছে। যাত্রাপালার ফিল্মের আবহে তৈরি এই গানটি যেন গ্রামীণ বাংলার প্রাণস্পন্দন তুলে ধরেছে। লোকেশন থেকে শুরু করে কস্টিউম, প্রতিটি ডিটেইলে আছে নিখুঁত যত্ন।’

গানটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বন্ধুদের মধ্যে খুনসুটিও চলছে। বন্ধুকে মেনশন দিয়ে কেউ যেমন প্রশ্ন করছেন, ‘কী রে, বেড়া ডিঙাতে পারলি?’ আবার কেউ জিজ্ঞেস করছেন বল তো, ‘“লিচুর বাগানে” কেন “পিরিতের বেড়া” দিতে হয়?’

প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক। শুরুতেই ‘লিচুর বাগানে’ গানটি দিয়ে আলোচিত, ‘কে এই ছত্তার পাগলা’ শীর্ষক প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। গবেষক সরোজ মোস্তফার মতে ‘কে দিল পিরিতের বেড়া লিচুরও বাগানে’ পঙ্‌ক্তির রচয়িতা ও সুরকার ছত্তার পাগলা। তবে সংগীতগবেষক গৌতম কে শুভর মত ভিন্ন। তাঁর মতে, ‘এটি মূলত প্রচলিত ঘেটু গান। “কে দিল পিরিতির বেড়া লিচুর বাগানে?” অংশটি মূল গানের অংশ। ছত্তার পাগলা নিজের মতো করে এর সঙ্গে কথা সংযোজন করেছেন। নেত্রকোনায় ছত্তার পাগলার লেখা রূপটিই বিখ্যাত হয়েছে।’ ২০১৪ সালের এপ্রিলে মারা গেছেন ছত্তার পাগলা। জীবদ্দশায় রচনা ও সুরারোপ করেছেন কয়েক শ গান। মৃত্যুর বছর তিনেক আগে তাঁর কাছ থেকে গানটি শুনে হাতে লিখে রেখেছিলেন আল মামুন চৌধুরী।

আল মামুন চৌধুরীর লেখা অনুযায়ী গানটির কথা:
কে দিল পিরিতের বেড়া, লিচুরও বাগানে
লিচুরও বাগানে গো সই…লিচুরও বাগানে …(ঐ)
পাখি খাইছ না লিচু, বন্দে খাইবো
বন্দে লিচু খাইয়া, খুশি হইবো
আমার কাছে আইসা কইবো
কত শান্তি দিবো আমার মনেপ্রাণে (ঐ)
ছোট ছোট লিচুগুলি, বন্দে তুলে আম্বো তুলি
বন্দে দেয় গো আমার মুখে,
আমি দিতে চাই বন্ধুর মুখের পানে…(ঐ)
মিষ্টি লিচু খাইয়া বন্দে, বাঁশি বাজায় মন আনন্দে
আমার মনে লাগে সন্দে বন্ধু সম্ভব জাদু জানে (ঐ)
বাঁশি হাতে পলায় মালা, তারে চায় ছত্তার পাগলা,
করব লইয়া উলামেলা, (২) প্রাণবন্ধুর সনে…(ঐ)

সরল অর্থে ‘বেড়া’ হচ্ছে  প্রতিবন্ধকতা তথা বাধা তৈরির উপকরণ। আর ‘পিরিতের বেড়া’ মানে ভালোবাসায় বাধা। কিন্তু ভালোবাসার এই বাধা তথা প্রতিবন্ধকতা ‘লিচুর বাগানে’ কেন? কবিতা তথা গানে অর্থের তারতম্য অর্থের অনুগত না হয়ে বোধ কিংবা ভাবনার পরবশে প্রস্ফুটিত হয়। ব্যক্তিবিশেষে তা ভিন্ন ভিন্ন অর্থ লাভ করে, ভিন্ন ভিন্ন মূল্য পায়।

আরও পড়ুন‘লিচুর বাগানে’ গানটি দিয়ে আলোচিত, কে এই ছত্তার পাগলা ০৬ জুন ২০২৫

‘কে দিল পিরিতের বেড়া, লিচুরও বাগানে’ একটি ‘ঘাটু গান’ বা ‘ঘেটু গান’। এই গান প্রসঙ্গে জানা যায়, এই গানের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল নৃত্য। অল্প বয়সী একটি ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে তার নৃত্যের মধ্য দিয়ে ঘেটু গান পরিবেশিত হতো। সঙ্গে থাকত ঢোল, হারমোনিয়াম, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। কয়েকটি ‘ঘেটু গানে’র দৃষ্টান্ত দেখা যাক।
(১)
‘তুই আমারে চিনলে নারে
আমি তো রসের কমলা।
বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি
মধ্যে নলের বেড়া।’
(২)
ঘুমাইলা ঘুমাইলারে বন্ধু
পান খাইলায়না
এক বালিশে দুইটি মাথা
সুন্দর কইরা কওরে কথা।
গানগুলো থেকে উপলব্ধি করতে কষ্ট হয় না যে ‘ঘেটু গানে’ যেমন ভাষার সারল্য আছে, তেমনিভাবে রূপকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে যাপিত জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকা নানা উপকরণ। আর এ ক্ষেত্রে গান রচনার সময় রচয়িতা তাঁর আশপাশ থেকেই গান নির্মাণের উপকরণগুলো যে নিয়ে থাকবেন, সেই ধারণাও পাওয়া যায়। ‘লিচুর বাগানে’ গানের ক্ষেত্রেও বোধ করি এটা ঘটেছে। তাই এই গানে যেমন ‘লিচু বাগানে’র কথা আছে, একইভাবে আছে ‘পাখি’, ‘বাঁশি’ ও ‘লিচু’র কথাও। পাখিকে লিচু না খাওয়ার অনুরোধ করলেও পাখি যেন খেতে না পারে সে কারণেই যে বেড়া দেওয়া হয়েছে; সেই ব্যথাও গানটিতে ফুটে উঠেছে। সব মিলিয়ে ‘লিচুর বাগান’ শেষ পর্যন্ত ‘লিচুর বাগানে’ সীমাবদ্ধ থাকেনি। হয়ে উঠেছে ভালোবাসার প্রতীক।

কথায় আছে, ভালোবাসা জয় করে নিতে হয়। জিতে নেওয়ার মধ্যেই আছে অপার আনন্দ। ভালোবাসায় প্রতিবন্ধকতা থাকাটা মোটেও দোষের নয়। বরং বাধা না থাকাটাই যেন আশ্চর্যের। একইভাবে ভালোবাসা জিতে নেওয়ার পরও পেয়ে গেছি বলে হাল ছেড়ে দিলে চলে না। ‘লিচুর বাগান’কে এ ক্ষেত্রে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করলে, ‘লিচুর বাগানে’ ‘পিরিতের বেড়া’ তথা ভালোবাসার বেষ্টনী দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। কেননা ‘ভালোবাসা’কে ভালোবাসা দিয়েই আগলে রাখতে হয়। প্রবল যত্নে আঁকড়ে রাখতে হয়। যেন কোনো কৌতূহলেই তা দুলে না ওঠে, হারিয়ে না যায়।

আরও পড়ুনসাবিলা তো ‘লিচুর বাগানে’ দিয়ে কী যে আগুন লাগিয়ে দিল...০৫ জুন ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘লিচুর বাগানে’ যে কারণে ‘পিরিতের বেড়া’ দিতে হয়