পশ্চিমা বিশ্বের গবেষণাগারে কাজ করা মুসলিম গবেষকদের জন্য রমজান একটি চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘ সময় না খেয়ে কঠোর গবেষণাকাজে মনোযোগ ধরে রাখা এবং সৃজনশীলতা বজায় রাখা সহজ নয়। তারা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারে, সুতরাং কঠোর একাডেমিক পরিবেশে কাজের মান বজায় রাখার বিকল্প নেই।

রমজানের অভিজ্ঞতা

ড.

আবদুল্লাহ শারফ চেক প্রজাতন্ত্রের একটি জীববিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে পোস্ট ডক গবেষক হিসেবে কর্মরত। প্রথম রমজানের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমার সুপারভাইজার সাধারণত ল্যাবে আমাকে দেখতে আসেন না, কিন্তু রমজানের প্রথম দিন তিনি বারবার ল্যাবে আসছিলেন। পরে স্বীকার করেছেন যে, তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, আমি হয়তো সংজ্ঞাহীন হয়ে যাব, কারণ গ্রীষ্মকাল সত্ত্বেও রোজার সময় দীর্ঘ সময় পানাহার থেকে বিরত থাকছি।’

পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রোজা রাখা অনেকটা ‘অতিমানবীয় ক্ষমতা’ বলে মনে হয়। তারা অবাক হয়, গ্রীষ্মের তীব্র গরমে কীভাবে কেউ দিনের পুরোটা সময় পানাহার না করে থাকতে পারে। যদিও ইদানীং আংশিক উপবাস (ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং) পশ্চিমে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, তাতে দিনের দীর্ঘ অংশ না খেয়ে থাকা হয়, তবু রোজার মতো পানাহার থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা বিষয়টি এখনো তাদের কাছে অস্বাভাবিক।

আরও পড়ুনরোজার তাৎপর্য, ইতিহাস ও উদ্দেশ্য০২ মার্চ ২০২৫

সৃষ্টিশীলতা বজায় রাখার কৌশল

 ড. শারফ ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে তিনি তার কর্মক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখেন। ‘সব সময় চেষ্টা করি যেন আমার ধর্মীয় অনুশীলন, যেমন—জুমার নামাজ ও রোজা, গবেষণার কাজে কোনো প্রভাব না ফেলে। সাধারণ দিনগুলোতে যেমন লাঞ্চ বিরতিতে নামাজ সেরে নিই, তেমনি রোজার দিনেও কাজের সময় অপরিবর্তিত রাখি।’

 কর্মক্ষমতা ধরে রাখতে তিনি মধ্যরাতে সাহরি খেয়ে নেন, যাতে সকালে যথাসময়ে উঠতে পারেন। তিনি বলেন, ‘এর ফলে রমজানে আমি অনেক আচার-অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত হই, তবে আমার লক্ষ্য একটাই—দেখিয়ে দেওয়া যে, রোজা আমার গবেষণার কাজে কোনো ব্যাঘাত ঘটায় না। বরং সাধারণ দিনের তুলনায় বেশি কাজ করি।’

 খাদ্যপ্রেমী জনগোষ্ঠীর মধ্যে রোজা

 একই অভিজ্ঞতা পেয়েছেন ড. মোহাম্মদ ফারিশাহ। তিনি চীনের উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওডেসি ও জিওম্যাটিক্স বিভাগে পোস্টডক গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘চীনারা অত্যন্ত খাদ্যপ্রেমী এবং নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খেতে ভালোবাসে। তারা দীর্ঘসময় পানাহার থেকে আমাদের বিরত থাকতে দেখে অবাক হয়।’

 তবে ফরিশাহ লক্ষ্য করেছেন, চীনে রোজাদারদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘রমজান মাসে একবার সহকর্মীদের সঙ্গে গবেষণার কাজে অন্য শহরে গিয়েছিলাম। যে-কলেজ পরিদর্শনে গিয়েছি, তার ডিন জানতে পারেন, আমি মুসলিম। তিনি আমাদের জন্য একটি মুসলিম রেস্টুরেন্টে ভোজ আয়োজন করেন। খাবার পরিবেশন হলেও ইফতার অপেক্ষা করছিলাম, তারাও আমার প্রতি সম্মান দেখিয়ে হাত গুটিয়ে ছিলেন। আশ্বস্ত করলাম যে, আমার কোনো অসুবিধা নেই, তারা খেতে পারেন। পরে তারা খাওয়া শুরু করেন। হোটেলে ফিরে দেখি সহকারীকে দিয়ে ডিন আমার জন্য হালাল খাবার পাঠিয়ে দিয়েছেন, যাতে সময়মতো সাহরি করতে পারি।’

আরও পড়ুনরোজার কাজা কী০১ মার্চ ২০২৫

উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের রমজানের পরিবেশ তৈরির জন্য অন্যান্য আরব গবেষকদের সঙ্গে তিনি ঘরে তারাবি পড়েন, একত্রে সাহরি খান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম রমজানের দিন সম্মিলিত ইফতার আয়োজন করেন।

গবেষণায় সাফল্য অর্জন

ড. মোহাম্মদ শাবান যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন ও ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটে কাঠামোগত জীববিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করছেন। গত রমজান মাসে ‘মলিকিউলার সেল’ জার্নালে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকাশ করেন। এই গবেষণায় মানবদেহের কোষ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রোটিন অপসারণ করে তার গোপন প্রক্রিয়া উন্মোচিত হয়। তিনি বলেন, ‘রমজান মাসে আমি ল্যাবের কাজের পাশাপাশি গবেষণাপত্র লেখায় প্রচুর পরিশ্রম করেছি, তবে রোজা আমার কর্মোদ্যমকে কমিয়ে দেয়নি, বরং অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।’

 ড. শাবান স্মরণ করেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করার সময় এক মার্কিন সহপাঠী রমজান মাসে কর্মশক্তি পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। সে নিয়মতি সকাল সকাল ল্যাবে আসতে শুরু করে এবং দেরি করে বাড়ি ফেরে। এক মাস পর সে মজা করে বলে, ‘ভেবেছিলাম, তোমার কর্মশক্তির রহস্য হয়তো কোনো বিশেষ কফি হবে, এখন দেখছি অন্য কিছু।’

ড. শাবান বলেন, ‘এটাই হচ্ছে রমজানের সঠিক বার্তা—যেন সবাইকে দেখাতে পারি যে, রোজা কোনো বাধা নয়, বরং তা কর্মশক্তি ও উৎপাদনশীলতার একটি শক্তিশালী অনুপ্রেরণা হতে পারে।’

আরও পড়ুনতুর্কমেনিস্তানে ইফতারির টেবিল সেজে ওঠে বাহারি সব খাবার দিয়ে০২ মার্চ ২০২৫

একটি ইতিবাচক বার্তা

 ড. আমাল আমিন মিশরের ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টারের ন্যানো টেকনোলজি বিশেষজ্ঞ এবং ‘ওমেন ইন সায়েন্স উইদাউট বর্ডার্স’ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে তার গবেষণা সফরের সময় এই ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা চলাকালীন গ্রীষ্মকালে রোজার সময়সীমা রাত ৯টা পর্যন্ত লম্বা হতো। সহকর্মীরা আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার তাড়া দিতেন। কিন্তু আমি সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ল্যাবে থাকতাম। আমি তাদের ভুল ধারণা ভাঙতে চেয়েছি যে, রমজান আমাদের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয় না বরং কর্মশক্তিকে আরও সংগঠিত করে।’

সহানুভূতি, তবে কর্মদক্ষতায় কোনো ছাড় নয়

জেনেভার আগোরা ক্যানসার রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা প্রকল্প পরিচালক ও বায়োফিজিক্স বিশেষজ্ঞ ড. হাইসামও শাবান ড. আমিনের কথার সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সহকর্মী ও সুপারভাইজাররা রোজার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, বিশেষ করে যদি এটি গ্রীষ্মকালে পড়ে এবং দিন দীর্ঘ ও আবহাওয়া উষ্ণ থাকে। তারা আমাদের সময়সূচির ক্ষেত্রেও নমনীয়তা দেখায়। কিন্তু তাদের সহানুভূতি কেবল সময় সামঞ্জস্যের ক্ষেত্রে, কাজের মানের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—উৎপাদনশীলতা ও গবেষণার মান বজায় রাখা।’

 তবে ড. হাইসাম ব্যক্তিগতভাবে এই সুবিধার ব্যবহার করেন না। বরং প্রতিদিনের সময়সূচি এমনভাবে সাজান, যাতে গবেষণার ওপর কোনো প্রভাব না পড়ে।

আরও পড়ুনরোজাদারের দিন কীভাবে কাটবে০২ মার্চ ২০২৫

দক্ষিণ মেরুতে রোজার আকাঙ্ক্ষা

 ড. আহমেদ সুলেমান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালটেক ও নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরিতে (জেপিএল) গবেষণা করছেন। গত রমজানে তিনি ‘ন্যান্সি গ্রেস রোমান’ টেলিস্কোপের ক্যামেরা উন্নয়নে কাজ করেছেন, যা জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ক্যামেরার তুলনায় ১,০০০ গুণ বেশি নিখুঁত। ক্যামেরাটি সূর্যালোক প্রতিফলন নিরপেক্ষ করতে সক্ষম, যা হয়তো আমাদের এখনো অজানা মহাজাগতিক সভ্যতাগুলো আবিষ্কারে সহায়তা করতে পারে।

 ড. সুলেমান রমজান মাসে গবেষণাগারে সহকর্মীদের জন্য নিয়মিত বিশেষ মিষ্টান্ন নিয়ে যান। তারা এখন রমজানের সময়ের জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে, শুধু সেই মিষ্টির স্বাদ নেওয়ার জন্য। কিন্তু তার এক অপূর্ণ ইচ্ছা রয়ে গেছে—দক্ষিণ মেরুতে রোজা রাখার ইচ্ছা। দক্ষিণ মেরুতে সূর্য অস্ত যায় না। তিনি সেখানে গবেষণার কাজে গিয়েছিলেন, কিন্তু মিশন রমজানের আগেই শেষ হয়ে যায়। তবে সেখানে তার একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা হয়। নরওয়ের অভিযাত্রী রোয়াল আমান্ডসেনের বিখ্যাত তাঁবুতে দুই দিন কাটান, যেখানে ১৯১১ সালে নরওয়ের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমি পুরো সময়টুকু নামাজ ও কোরআন তিলাওয়াতে কাটাই। সুরা কাহফের ৯০ নম্বর আয়াতটি তখন বারবার মনে পড়ছিল: ‘যখন সে সূর্যোদয়ের স্থানে পৌঁছাল, দেখল এটি এমন এক জাতির উপর উদিত হচ্ছে, যাদের জন্য সূর্যের বিপরীতে কোনো আচ্ছাদন রাখিনি।’

 সূত্র: আলজাজিরা ডট নেট

আরও পড়ুনরমজানে সোমালিয়ার সংস্কৃতি ও সংহতি০৩ মার্চ ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: রমজ ন ম স দ র জন য রমজ ন র সহকর ম ত র এক র কর ম ক জ কর আম দ র ক ষমত র সময় র একট

এছাড়াও পড়ুন:

মধ্যরাতে শাহরুখের বাড়ির সামনে ভক্তদের ভিড়

বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খান। লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনে এখনো দারুণ সরব। শুধু তাই নয়, বক্স অফিসেও ঝড় তুলছেন তিনি। রবিবার (২ নভেম্বর) ৬০ বছর পূর্ণ করলেন এই অভিনেতা। যদিও তা দেখে বোঝার উপায় নেই।  

শনিবার (১ নভেম্বর) দিবাগত মধ্যরাত থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সহকর্মী-ভক্তদের শুভেচ্ছা বার্তায় ভাসছেন শাহরুখ খান। পাশাপাশি প্রিয় তারকাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে হাজার হাজার ভক্ত ছুটে যান তার বাড়ি মান্নাতের সামনে। এ মুহূর্তের বেশ কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে নেটদুনিয়ায়।  

আরো পড়ুন:

শাহরুখের ব্যাপারে সাবধান করলেন জুহি চাওলা

শাহরুখের অজানা এই সাত তথ্য জানেন?

সারা ভারত তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শাহরুখ খানের ফ্যান ক্লাব রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্ত-অনুরাগীরা মুম্বাইয়ের মান্নাতের (বাড়ি) সামনে জড়ো হন। শাহরুখের জন্মদিন উপলক্ষে কলকাতা থেকে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছেন প্রিন্স সিং ও তার দল।  

ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে প্রিন্স সিং বলেন, “আমি কলকাতা থেকে আসছি। আমার সঙ্গে ‘এসআরকে ওয়ারিয়স’ টিম রয়েছে। ৩৩ ঘণ্টা ট্রেন জার্নি করে শাহরুখ খানকে একঝলক দেখার জন্য এখানে এসেছি। আশা করছি, আজকে তিনি একবারের জন্য হলেও দেখা দেবেন। আমরা নিশ্চিত, আজ অথবা কালকে তাকে দেখতে পাব। আমরা অনেক কিছু ম্যানেজ করে এখানে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি। কারণ হাজার হাজার মানুষ এখানে আসতে চাচ্ছেন। কিন্তু পুলিশ আসতে দিচ্ছেন না।” 

প্রিন্সের মতো হাজার ভক্ত-অনুরাগী মধ্যরাতে শাহরুখের বাড়ির সামনে জড়ো হন। কেউ প্রিয় অভিনেতার ছবি, কেউ প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে মান্নাতের সামনে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকেন—“আমরা আপনাকে ভালোবাসি। শুভ জন্মদিন এসআরকে।”  

তবে গতকাল রাতে শাহরুখের দেখা মেলেনি। কারণ শাহরুখ খান এখন বিলাসবহুল মান্নাতে বসবাস করেন না। গত মার্চের দিকে মান্নাত থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে অভিজাত একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন; সেখানেই বসবাস করছেন। কারণ মান্নাতে এখন সংস্কার কাজ চলছে। সংস্কার কাজ শেষ হতে দুই বছর লাগবে বলে জানা গেছে। 

ইন্ডিয়া টুডে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গতকাল রাতে শাহরুখ খান তার ৬০তম জন্মদিন উদযাপন করেছেন আলীবাগের বাসায়। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন ইন্ডাস্ট্রির সহকর্মী, ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবরা। এ তালিকায় রয়েছেন—ফারাহ খান, করন জোহর, রানী মুখার্জিসহ অনেকে।

ঢাকা/শান্ত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নাটোরে ঘোড়ার গাড়ি করে শিক্ষকের ‘রাজকীয়’ বিদায়
  • রাজশাহীতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগের ঘোষণা
  • চকবাজারে প্রিজন ট্রাকের ধাক্কায় ঠেলাগাড়ির শ্রমিক নিহত
  • মধ্যরাতে শাহরুখের বাড়ির সামনে ভক্তদের ভিড়