‘মাগুরার সেই শিশুটি’—নিজের নামকে আড়াল করে এখন এটিই শিশুটির পরিচয়। এই তিনটি শব্দবন্ধ দিয়েই অসংখ্য নামের ভিড়েও শিশুটিকে আলাদা করে চিনতে পারা যায়। যেন এই নাম ফুটে থাকা মাধুরীলতার মতো ফুটে আছে সবার চোখের সামনে। এই নামে তাকে চিনে যাচ্ছে গোটা দেশ। হয়তো এই তিনটি শব্দবন্ধ পেরিয়ে গেছে দেশের সীমানাও। শিশুটির বয়স আট। বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে শিশুটিকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছেন তার মা। এই শিশুটি এখন আর নেই, সে এখন পেরিয়ে যাচ্ছে পুরো পৃথিবীর আলো। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) কর্তৃপক্ষ শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেছে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আজ সকালে দুই দফায় শিশুটির ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ (আকস্মিকভাবে হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়া) হয়। সিপিআর দেওয়ার পর তাঁর হৃৎস্পন্দন ফিরে এসেছিল। কিন্তু দুপুর ১২টায় তাঁর আবার ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ হয়। এই দফায় সিপিআর দেওয়ার পরও তার হৃৎস্পন্দন ফেরেনি। বেলা ১টায় তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

ফুলের তো কেবল ফুটে ওঠার নিয়তি থাকে না, তাকে ঝরেও পড়তে হয়। এই দায়িত্বও ফুলের। আর তাই সবকিছু, চিকিৎসার সব আয়োজন তুচ্ছ জ্ঞান করে ‘মাগুরার সেই শিশুটি’, যে কিনা ফুটে থাকা মাধুরীলতা; ঝরে গেল আজ।

শিশু ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলায় শিশুটির বোনের স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাশুরকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে শিশুটির মা অভিযোগ করেন, মেয়ের স্বামীর সহায়তায় তাঁর বাবা (শ্বশুর) শিশুটিকে ধর্ষণ করেন। বিষয়টি মেয়ের শাশুড়ি ও ভাশুর জানতেন। তাঁরা ঘটনা ধামাচাপা দিতে শিশুটিকে হত্যাচেষ্টা চালান। এই মামলায় শিশুটির ভগ্নিপতি, বোনের শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাশুরকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

কত দিন হয় এই শিশুটিকে আমরা চিনি? মাত্র এক সপ্তাহের জানা। তবু, কেন এমন হয়?—এই এক সপ্তাহে রোজ যত তাকে জেনেছি, চিনেছি, ততই যেন মনে হয়েছে আগে থেকে তাকে চিনতাম। তার বন্ধ চোখ। জমে থাকা জল লেগে আছে চোখের পাতায়। ওই জলের দিকে একদৃষ্টে তাকালে, তা আনমনে নিয়ে যায় নিজের ঘরের দিকে। ওই ঘরে এই শিশুটির মতো আমার একটি কন্যাশিশু আছে। পৃথিবীর সব শিশুর মুখ-ই তো ফুটে থাকা ফুলের আদল। সব শিশুর মুখ যদি ফুলের আদল হয়, তাহলে মাগুরার শিশুটি তো আমার কন্যাই। এ কারণেই এত উদ্বিগ্ন লাগে নিজেকে! কন্যা যখন তার মায়ের সঙ্গে কোথাও যায় তখনো আমার উদ্বিগ্ন লাগে। বলেছি আমি—কিচ্ছু চাই না আমার। না সুখ, না শান্তি। যেখানেই নিয়ে যাও, তুমি শুধু কন্যাকে সাবধানে আমার কাছে ফিরিয়ে এনো। এই শুধু চাওয়া।

আরও পড়ুনমাগুরার সেই শিশুটিকে বাঁচানো গেল না২ ঘণ্টা আগে

মাগুরার সেই শিশুটির মায়েরও নিশ্চয়ই এমন চাওয়া-ই ছিল। গত রোববার ওই মা বলছিলেন, আগের দিন (মঙ্গলবার) তাঁর মেয়ে ফোনে কান্নাকাটি করে বোনের বাসা থেকে নিজের বাসায় চলে আসতে চেয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, আর দুইটা দিন থাকতে। তারপর নিয়ে আসবেন। এখন তাঁর একটাই আফসোস। বলেছেন, ‘ইশ্! ক্যান যে পাঠাইছিলাম! মেয়ের কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। আপনাকে ছবি তুইলা দেখাতে পারলে বুঝতে পারতেন কী কষ্ট পাচ্ছে! আল্লাহর কাছে মেয়ের দাবি ছাইড়া দিছি।’

এই মা আরও বলেন, ‘মেয়ে বোনের বাসায় যেতে চাইছিল না। জোর করে পাঠাইছিলাম। যদি না পাঠাইতাম তাহলে এই অবস্থা হতো না।’

এই মা কি জানতেন, বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া মানে মেয়ের আয়ুর শেষ অবধি পথ চলে যাওয়া! জানতেন না। জানলে মেয়েকে যেতে দিতেন না আরেক মেয়ের বাড়ি। কিন্তু তিনি জানতেন, শ্বশুর-জামাতা দুজনের চরিত্রই খারাপ। তবে চিনতে পারেননি। এই আফসোস নিয়ে আজীবন পুড়ে খাক হয়ে যাবেন এখন এই মা।

মামলার এজাহারে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাদী উল্লেখ করেছেন, গত বুধবার (৫ মার্চ) রাত ১০টার দিকে খাবার খেয়ে বড় বোন ও তাঁর স্বামীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমায় শিশুটি। দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে বড় বোন ঘুম থেকে জেগে দেখেন, ছোট বোন পাশে নেই, মেঝেতে পড়ে আছে। তখন শিশুটি বড় বোনকে জানায়, তার যৌনাঙ্গে জ্বালাপোড়া হচ্ছে। কিন্তু বড় বোন মনে করে, শিশুটি ঘুমের মধ্যে আবোলতাবোল বকছে। এরপর সকাল ছয়টার দিকে শিশুটি আবার বোনকে যৌনাঙ্গে জ্বালাপোড়ার কথা বলে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বোনকে জানায়, রাতে দুলাভাই (বোনের স্বামী) দরজা খুলে দিলে তাঁর বাবা (শ্বশুর) তার মুখ চেপে ধরে তাঁর কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করেন। সে চিৎকার করতে গেলে তার গলা চেপে ধরা হয়। পরে তাকে আবার বোনের কক্ষের মেঝেতে ফেলে রেখে যায়।

গত বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় শিশুটিকে মাগুরার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে যান তার বোনের শাশুড়ি। পরে শিশুটির মা হাসপাতালে যান। সেদিন দুপুরেই উন্নত চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার রাতে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর গত শুক্রবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সংকটাপন্ন অবস্থায় শিশুটিকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (পিআইসিইউ) থেকে সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়। তাকে ঢাকার সিএমএইচের পিআইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল।

ওই যে শুরুতে বলেছিলাম—‘মাগুরার সেই শিশুটি’ এই নাম যেন ফুটে থাকা মাধুরীলতার মতো ফুটে আছে সবার চোখের সামনে। এ কারণে এ ঘটনার পর ওই দিন থেকেই সকাল থেকে প্রায় দিনভর মাগুরা শহরসহ সারা দেশে শিশু ধর্ষণে জড়িত ব্যক্তিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। দেশে নারীদের প্রতি যৌন নির্যাতন ও উত্ত্যক্ত করার ঘটনা আকস্মিকভাবে বেড়ে গেছে। এর প্রতিবাদে রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র আন্দোলন হয়েছে, হচ্ছে। এই আন্দোলন ও মাগুরার ওই শিশুর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। গত রোববার আইন মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে তদন্তের সময় ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ দিন করা হচ্ছে। আর ধর্ষণের মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে বিচার করতে হবে। অংশীজনদের সঙ্গে কিছু পরামর্শ করে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।

কিন্তু এই বিচার দেখে যেতে পারল না ‘মাগুরার সেই শিশুটি’। এর আগেই শরীর ও হৃদয়ের ক্ষত নিয়ে আজীবনের জন্য চলে গেল ছোট্ট এই মেয়েটি।

আরও পড়ুনমাগুরার সেই শিশুর মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোক, আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ১ ঘণ্টা আগে

সিএমএইচে শিশুটির চিকিৎসায় গঠিত বোর্ডের একজন চিকিৎসক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটির যৌনাঙ্গে ক্ষত রয়েছে। গলায় বড় ক্ষত। ওড়নাজাতীয় কিছু দিয়ে শিশুকে ফাঁস দেওয়া হয়েছিল এবং বুকে প্রচণ্ড জোরে চাপ দেওয়া হয়েছিল। মস্তিষ্কে অক্সিজেন কমে গেছে। বুকের ওপর চাপ দেওয়ার কারণে ফুসফুসের যেসব জায়গায় বাতাস থাকার কথা না, সেসব জায়গায় বাতাস ঢুকে গেছে। বুকে অস্ত্রোপচার করে অতিরিক্ত বাতাস বের করার জন্য টিউব বসানো হয়েছে। অক্সিজেন স্বল্পতাজনিত কারণে মস্তিষ্কে ক্ষতি হয়েছে। এ কারণে খিঁচুনি হচ্ছিল।

এত এত যন্ত্রণার সময় ছোট্ট মেয়েটি নিজেকে বাঁচাতে ঠিক কী করেছিল?—আমরা জানি না। নিরুপায় হয়ে সে কি মনে মনে অভিশাপ দিয়েছিল। ছোট্ট মানুষ। তার অভিশাপের ভাষা কতটা কঠিন হতে পারে। বড়জোর হয়তো বলেছ—নিপীড়ক, তোমার যেন কোনো দিন খিদে না পায়; তোমার চোখে যেন জল না আসে কোনো দিন অথবা বোবা হয়ে তুমি আজীবন বয়ে নিয়ে যাও বিকলাঙ্গ জীবন। বিচার তো চাই। আবার বাবা হিসেবে চাই—সত্যি হোক নিষ্পাপ শিশুর এমন অভিশাপ।

আরও পড়ুনমাগুরার সেই শিশুটির মা বললেন, ‘ইশ্‌! ক্যান যে পাঠাইছিলাম’০৯ মার্চ ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স এমএইচ বড় ব ন

এছাড়াও পড়ুন:

একজন চা শ্রমিকের দিনে আয় ১৭৮ টাকা

হবিগঞ্জে ছোট-বড় মিলেয়ে চা বাগানের সংখ্যা প্রায় ৪১টি। এসব বাগানের বাসিন্দা প্রায় দেড় লাখ। এর মধ্যে, স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে ৩২ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ চা পাতা উত্তোলনে জড়িত।

চা বাগানে একজন শ্রমিককে প্রতিদিন ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয়। এর বিনিময়ে মজুরি পান ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো বাগানে নিয়মিত এই মজুরিও দেওয়া হয় না।

শ্রমিকদের দাবি, দৈনিক মজুরি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করতে হবে। বর্তমানে যে মজুরি পাওয়া যায় তা দিয়ে সংসার চলে না। প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সেই সঙ্গে চা শ্রমিকদের নৈমিত্তিক ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে।

আরো পড়ুন:

বৈষম্য কেন? নারী শ্রমিকেরা পান না সমান মজুরি

ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা

সরেজমিনে কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা যায়, শ্রমিকরা ছোট্ট কুঠুরিতে গাদাগাদি করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসবাস করেন। পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা, দু-বেলা পেটভরে খেতে পারেন না।

শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘‘দুই বছর অন্তর চা শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি ও সমস্যা নিয়ে চা বাগান মালিক পক্ষের সংগঠনের সঙ্গে চা শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিনিধির বৈঠক হয়। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে বৈঠক হয়েছে। সে সময় ৮ টাকা ৫০ পয়সা বৃদ্ধি পেয়ে মজুরি ১৭৮ টাকা ৫০ নির্ধারিত হয়েছে।’’

শ্রমিকদের কষ্টের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এই টাকায় চলা যায় না। দেশের কোথাও এতো সস্তা শ্রমের দাম নেই। বর্তমানে একজন কৃষিশ্রমিক দিনে ৫০০-১০০০ টাকা আয় করেন, একজন  রিকশাচালকের প্রতিদিনের আয় ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। সেখানে একজন চা শ্রমিক পান ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। এজন্য তাকে প্রতিদিন ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয়।’’

চা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে নাটক ও গানের মাধ্যমে দাবি জানিয়ে আসা জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দেউন্দি প্রতীক থিয়েটারের সভাপতি সুনীল বিশ্বাস বলেন, ‘‘দৈনিক ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা মজুরিতে শ্রমিকদের চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। অচিরেই মজুরি ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হোক। এছাড়া, শ্রমিকদের আরো সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।’’

ঢাকা/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ