চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগ তুলে হবিগঞ্জে দুজনকে গাছে বেঁধে নির্যাতন, শরীরে আগুন
Published: 13th, March 2025 GMT
হবিগঞ্জে ছিনতাই ও মুঠোফোন চুরির অভিযোগে এক তরুণকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করছেন কিছু লোক। পরে সেই তরুণের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ভুক্তভোগী তরুণ চিৎকার করে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে।
ঘটনাটি হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সিলিমনগর গ্রামে। তবে একজন নয়, দুই তরুণের সঙ্গে গত শনিবার রাতে ঘটনাটি ঘটে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তরুণদের একজন আজ বৃহস্পতিবার ১৩ জনের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ আদালতে একটি মামলা করেছেন।
বাহুবল মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ ঘটনার সত্যতা পেয়েছে। ছিনতাইয়ের অভিযোগ করে দুই তরুণকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনায় আজ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পুলিশ ও মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, বাহুবল উপজেলার সিলিমনগর গ্রামের আবদুল কাইযুমের ছেলে সোহেল মিয়া গত শনিবার পশুর হাটে একটি গরু বিক্রি করে বাড়িতে ফিরছিলেন। রাত ৯টার দিকে উপজেলার কটিয়াদি বাজার থেকে বাড়িতে ফেরার পথে নির্জন রাস্তায় কয়েকজন ছিনতাইকারী সোহেলকে ঘিরে ধরে ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। এ সময় তিনি চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তখন ছিনতাইকারীরা পালিয়ে যায়। এ সময় সোহেল উপস্থিত লোকজনের কাছে সহিদুল ইসলাম (২৪) নামের এক তরুণকে দেখিয়ে দাবি করেন, তিনি ছিনতাই জড়িত। এরপর ওই তরুণকে ধরে সিলিমনগরে সোহেলের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে গাছে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। পরে সোহেল পাশের বনদক্ষিণ গ্রামের আরেক তরুণ জাহেদ আলীকে (২০) ফোন করে ‘জরুরি কাজ আছে’ বলে বাড়িতে ডেকে আনেন। জাহেদ তাঁর বাড়িতে গেলে তাঁর বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ তুলে গাছে বেঁধে নির্যাতন শুরু করেন। পরে তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেই নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ভুক্তভোগী দুই তরুণ বর্তমানে হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন চৌধুরী দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, জাহেদ আলীর শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁর শরীরে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। চিকিৎসাধীন আরেক তরুণ সহিদুলের বাঁ হাতের কিছু অংশ ঝলছে গেছে।
জাহেদ আলী বলেন, তিনি কটিয়াদি বাজারে একটি দর্জির দোকানে কাজ করেন। তাঁকে মুঠোফোনে কল করে সোহেল বাড়িতে ডেকে নেন। যাওয়ার পর সোহেল দাবি করেন, তাঁর দুটি মুঠোফোন বাড়ি থেকে চুরি হয়েছে। চুরির সঙ্গে তিনি জড়িত। পাশাপাশি ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার অপবাদ দিয়ে সোহেল ও তাঁর স্বজনেরা অমানসিক নির্যাতন করেন। পরে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তিনি বলেন, ‘আমি যদি জড়িত হতাম, তাহলে সোহেলের ফোনে তাঁদের বাড়িতে যেতাম না। আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে নির্যাতন করা হয়।’
ভুক্তভোগী সহিদুল ইসলাম বলেন, তিনি গ্রামে গ্রামে মাছ বিক্রি করেন। ওই দিন রাতে কটিয়াদি বাজারে কাজে গেলে রাত ৯টার দিকে হঠাৎ করে সোহেলের নেতৃত্বে কিছু লোক তাঁকে ধরে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে গাছে বেঁধে নির্যাতন করেন। তাঁরা তাঁকে নির্যাতন করে জাহেদ আলীর নাম বলতে বলেন। তিনি নাম না বলায় নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়ে।
সিলিমনগর গ্রামের বাসিন্দা সিরাজ মিয়া বলেন, ‘গত শনিবার রাতে আমরা গ্রামের আবদুল কাইযুমের বাড়িতে দুজনকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করার দৃশ্য দেখেছি। তাঁরা তাঁদের বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের চেষ্টা ও মোবাইল চুরির অভিযোগ করেন।’
এ বিষয়ে অভিযুক্ত সোহেল মিয়া বলেন, সহিদুল ও জাহেদ এলাকার চিহ্নিত অপরাধী। তাঁরা চুরি-ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। তিনি ওই দিন রাতে আজমিরীগঞ্জে গরু বিক্রি করে টাকা নিয়ে বাড়িতে ফিরছিলেন। তখন সহিদুল ও জাহেদ ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন। এ ছাড়া আগের দিন তাঁর বাড়ি থেকে দুটি মুঠোফোন চুরি হয়। ওই চুরির সঙ্গেও তাঁরাই জড়িত বলে তিনি দাবি করেন।
বাহুবল থানার ওসি মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলেন, ওই অপরাধে তাঁরা জড়িত কি না, তা তদন্তের বিষয়। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি চুরির মামলা আছে বাহুবল থানায়। ওসি বলেন, দুই তরুণকে নির্যাতনের ঘটনায় জাহেদ আলী বাদী হয়ে আজ হবিগঞ্জ আদালতে ১৩ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন। মামলার পর আমির মিয়া নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি মামলার ৫ নম্বর আসামি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: হ দ ল ইসল ম স ল মনগর জ হ দ আল ব হ বল সহ দ ল
এছাড়াও পড়ুন:
দারফুরে ধর্ষণ-মুক্তিপণ-হত্যা: আরএসএফের ভয়াবহ নিপীড়নের বর্ণনা দিলেন পালিয়ে আসা মানুষেরা
সুদানের পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর শহরে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ)–এর কাছ থেকে পালিয়ে আসা ক্ষুধার্ত এবং নির্যাতিত মানুষেরা বিভিন্ন সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের কাছে তাঁদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করছেন। তবে তাঁরা পালাতে পারলেও হাজার হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
উত্তর দারফুরের রাজধানী এল-ফাশের শহর ছিল রাজ্যটিতে সুদানি সেনাবাহিনীর সর্বশেষ ঘাঁটি। গত রোববার আরএসএফ বাহিনী এটির দখল নেয়। এরপর থেকে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা স্থানীয় মানুষের পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এরই মধ্যে দারফুরে ধর্ষণ, মুক্তিপণ ও গণহত্যাসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা সামনে আসছে।
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ইসমাইল বলেন, ‘খার্তুমের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন এমন একজন তরুণ সেখানে ছিলেন। তিনি তাঁদের বললেন, “ওকে হত্যা করো না”। এরপর তাঁরা আমার সঙ্গে থাকা সব তরুণ ও আমার বন্ধুদের হত্যা করেন।’
তাবিলা এলাকায় পালিয়ে আসা অন্য নাগরিকেরাও তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তেমনই একজন তাহানি হাসান। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই তাঁরা সেখানে হাজির হলেন। কোথা থেকে এলেন জানি না। ভিন্ন ভিন্ন বয়সী তিন তরুণকে দেখা গেল। তাঁরা আকাশে গুলি ছুড়লেন এবং বললেন, ‘থামো, থামো’। তাঁরা আরএসএফের পোশাকে ছিলেন।’
আলখেইর ইসমাইল নামের এক সুদানি তরুণ দারফুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরের তাবিলা শহরে পালিয়ে এসেছেন। আলখেইর বলেছেন, রোববার এল-ফাশের থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় ৩০০ জনকে আটক করে আরএসএফ। তিনিও ওই দলে ছিলেন। তবে আটককারীদের একজন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত ব্যক্তি হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।তাহানি হাসান বলেন, ‘এই তরুণেরা আমাদের বেধড়ক মারধর করেছেন। আমাদের পোশাক মাটিতে ছুড়ে ফেলেছেন। এমনকি আমি একজন নারী হওয়ার পরও আমাকে তল্লাশি করা হয়েছে। হামলাকারীরা সম্ভবত বয়সে আমার মেয়ের চেয়েও ছোট হবে।’
ফাতিমা আবদুলরহিম তাঁর নাতি–নাতনিদের সঙ্গে তাবিলাতে পালিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, পাঁচ দিন ধরে অনেক কষ্ট করে হেঁটে তাবিলাতে পৌঁছাতে পেরেছেন।
ফাতিমা বলেন, ‘তাঁরা (আরএসএফের সদস্যরা) ছেলেশিশুগুলোকে মারলেন এবং আমাদের সব সম্পদ কেড়ে নিলেন। আমাদের কিছুই রাখা হলো না। আমরা এখানে পৌঁছানোর পর জানতে পারলাম, আমাদের পর যেসব মেয়ে এসেছে, তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। তবে আমাদের মেয়েরা বেঁচে গেছে।’
পালিয়ে আসা তরুণী রাওয়া আবদাল্লা বলেছেন, তাঁর বাবা নিখোঁজ।
গত বুধবার রাতে দেওয়া এক বক্তৃতায় আরএসএফের প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালো বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য তাঁর যোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। হামদান ‘হেমেদতি’ নামেও পরিচিত।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানি সেনাদের সঙ্গে আরএসএফ সদস্যদের লড়াই চলছে। গত বৃহস্পতিবার আরএসএফ দাবি করে, নির্যাতনের অভিযোগে বেশ কয়েকজন যোদ্ধাকে আটক করেছে তারা।
তবে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার সাধারণ নাগরিকদের ওপর আরএসএফ সদস্যদের নিপীড়নের অভিযোগ তদন্তে বাহিনীটির দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরএসএফের একজন উচ্চপদস্থ কমান্ডার এই ঘটনাগুলো ‘গণমাধ্যমের অতিরঞ্জন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর দাবি, এল–ফাশেরে নিজেদের পরাজয় ও ক্ষয়ক্ষতি আড়াল করতে সেনাবাহিনী এবং তাদের মিত্ররা এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, এ সংঘাত চলাকালে আরএসএফ ও সেনাবাহিনী—দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে। সংঘাতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। সংঘাতকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। বিরাজ করছে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের অবস্থা। পাশাপাশি কলেরা ও অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগের সংক্রমণ বাড়ছে।
দারফুর থেকে পালিয়ে আসা লোকজন তাবিলা এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। ২৯ অক্টোবর, ২০২৫