কালো স্যুট ও গাঢ় রঙের টাই পরা পুতিন মাইক্রোফোনের দিকে ঝুঁকে একটি আঙুল তুলে ধরেন, তবে তাঁর মুখ বন্ধ। তিনি বসে আছেন রুশ লাল ও সবুজ পতাকার সামনে। ভ্লাদিমির পুতিন শুরুতেই নিজের বক্তব্য পরিষ্কার করতে চাইলেন। ইউক্রেন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে কোনো মন্তব্য করার আগেই তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানান। ১৩ মার্চ মস্কোতে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন সংকট নিয়ে এত মনোযোগ দেওয়ার জন্য আমি ট্রাম্পকে কৃতজ্ঞতা জানাই।’

এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক আন্তন বারবাশিন বলেন, ‘পুতিন চাচ্ছেন, ট্রাম্প যেন বিশ্বাস করেন যে তিনি (পুতিন) আলোচনায় আগ্রহী।’ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মতো ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ করতে চান না পুতিন। বরং বারবাশিনের মতে, রুশ প্রেসিডেন্ট কৌশলগতভাবে এমন বার্তা দিতে চান যাতে ট্রাম্প তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহী হন এবং কোনো সমঝোতায় আসেন।

ওভাল অফিসে হলুদ আসনে বসে আছেন জেলেনস্কি ও ট্রাম্প। জেলেনস্কি সম্পূর্ণ কালো পোশাকে। তিনি ট্রাম্পের দিকে তাকিয়ে আছেন। হাত দিয়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। ট্রাম্প নীল স্যুট ও লাল টাই পরে, তাঁর দিকে আঙুল উঁচিয়ে কথা বলছেন। মুখে কপট বিরক্তির ছাপ।

তবে পুতিনের চাওয়া সমঝোতা ট্রাম্পের ভাবনার চেয়ে আলাদা হতে পারে। ট্রাম্প চান, অন্তত ৩০ দিনের জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হোক। পুতিন এটিকে সমর্থন করার ইঙ্গিত দিলেও বলেছেন, ‘কিছু বিষয় আছে, যা নিয়ে আলোচনা করতে হবে’। এই ‘কিছু বিষয়’ কী? এইগুলো থেকে বোঝা যায়, রাশিয়া এখন কী পরিকল্পনা করছে!

পুতিন যে ‘কিছু প্রশ্ন’ উত্থাপন করেছেন, সেগুলো আসলে পরোক্ষ আপত্তি নয়, বরং স্পষ্ট দাবি। তিনি চান, রাশিয়ার কুর্স্ক অঞ্চলে এখনো লড়াইরত ইউক্রেনের সেনারা আত্মসমর্পণ করুক। যুদ্ধবিরতির সময় ইউক্রেন যেন নতুন কোনো সেনা মোতায়েন করতে না পারে। একই সঙ্গে, পশ্চিমা দেশগুলো যেন কিয়েভে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।

পুতিনের মতে, এই যুদ্ধবিরতি ‘দীর্ঘমেয়াদি শান্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং সংঘাতের মূল কারণ দূর করবে’। তবে এই অস্পষ্ট বক্তব্যের উদ্দেশ্য হলো, আলোচনাকে মস্কোর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যগুলোর দিকে নিয়ে যাওয়া।

কুর্স্ক শহরে দেয়াল চিত্রের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন একজন নাগরিক.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউক র ন

এছাড়াও পড়ুন:

ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা

বছর পাঁচেক আগেও ধান কাটার শ্রমিকেরা বৈশাখ মাসের অপেক্ষায় থাকতেন। বৈশাখে হাওরের বুকজুড়ে সবুজ ধান যখন সোনালি রঙ ছড়াতে শুরু করে, তখন থেকেই দূরদূরান্ত থেকে হাওরে আসতে থাকেন ধান কাটার শ্রমিকেরা। কিন্তু, এই চিত্র দ্রুত বদলাচ্ছে। হাওরের কৃষক এখন ধান কাটার জন্য বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করেন। ফলে কৃষকের শ্রম এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হচ্ছে। তবে, কর্মহীন হয়ে পড়ছেন কৃষি শ্রমিকেরা। বাধ্য হয়ে তারা পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।

তিন বছর হলো ধান কাটার পেশা ছেড়েছেন মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের মো. মকবুল মিয়া। এখন তিনি সারাবছর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান।

আরো পড়ুন:

খুলনার বরফশ্রমিক
নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মকবুল মিয়া বলেন, ‘‘আগে বছরের ছয় মাস বর্ষায় নৌকা বাইতাম, আর হুগনা সিজন আইলে নিজের জমি চাষ করতাম, আবার মাইনষের জমিতেও কামলা দিতাম। যা আয় অইতো তাই দিয়া আমরার ছয়জনের সংসার চইল্যা যাইতো। কিন্তু, যহন থেইক্যা নতুন নতুন মেশিন হাওরে আইতাছে, তহন থেইক্যা আমরার আর বেইল নাই।’’

‘‘কেউ আর আমরারে আগের মতন দাম দেয় না। কাম করলেও ঠিকমতো টেহা পাই না, তাই পুষায় না,’’ বলেন এই কৃষিশ্রমিক।

মকবুলের মতো ধান কাটা, মাড়াই, রোদে শুকানো, ঝাড়া, কাঁধে বহন করার মতো স্বাধীন পেশা ছেড়েছেন অষ্টগ্রামের ফয়জুল, ইটনার শামছুল মিয়া, নিকলীর ফরিদ উদ্দিনসহ অসংখ্য শ্রমিক। এক সময় যারা এ পেশায় দলবেঁধে কাজ করতেন, এখন দৃশ্যপট পুরোটাই ভিন্ন। ধান কাটার পেশা বদলে তারা এখন কেউ রিকশাচালক, কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ চটপটি-ফুচকার দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

তারা বলছেন, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির গতির সঙ্গে তারা কখনো তাল মেলাতে পারবেন না। কৃষকরাও তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারছেন না। বেশি জমি যাদের আছে তারাও আধুনিক পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। যে কৃষক অল্প জমিতে চাষাবাদ করেছেন, তারাও আর পয়সা খরচ করে কৃষিশ্রমিকের ওপর নির্ভর করছেন না। তারা পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা নিচ্ছেন। ফলে খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা পড়েছেন বিপাকে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সনাতন পদ্ধতিতে এক বিঘা জমির ধান কাটতে প্রচুর সময় লাগে। ফসল কাটার পরে বহন ও মারাই করা, তারপর বস্তায় সংরক্ষণ করার জন্যও অনেক শ্রমিকের দরকার। এটুকু ৬ থেকে ৭ জন শ্রমিকের সারা দিনের কাজ। তার জন্য মজুরি গুনতে হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কিন্তু, এ কাজে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করলে সময় এবং অর্থ দুটোই কম লাগে।

বৈশাখে বর্ষার পানি ও বৈরী আবহাওয়া না থাকায় কৃষকেরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটছেন। বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে ঝড়-তুফান শুরু হলে পাকা ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে তারা যে পদ্ধতিতে ধান কাটা সহজ এবং দ্রুত হয় সেই পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এবার পুরো জেলায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওর এলাকাতেই আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। ফলন ভালো হওয়ায় এই ধান থেকে এবার প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। ধান কাটতে এ বছর হাওর অঞ্চলে ৩৫ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। এই সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় কম। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধান কাটতে কৃষক কম্বাইন্ড হারভেস্টারসহ ৪১৩টি ধান কাটার যন্ত্র ব্যবহার করছেন। 

জেলা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. খোরশেদ উদ্দিন বলেন, ‘‘মানুষের পেশা পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের বিভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়। কিন্তু, কৃষি এমন একটা পেশা, যারা এ পেশা রপ্ত করেছেন তাদের জন্য নতুন পেশায় আসা খুব কঠিন। বর্তমানে কৃষিকাজে যেভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, তাতে কৃষিশ্রমিকেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।’’

‘‘শুধু কৃষিতেই নয়, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে,’’ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারকেই সুদৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান, মাঠে যদি কৃষক ও শ্রমিক ন্যায্য শ্রমমূল্য না পান, তাহলে কৃষিও একদিন হুমকির মুখে পড়বে।’’

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত নিবন্ধ