লিভারপুল কাঁপানো ৫ দিন
একটা স্বপ্নহীন এবং কতগুলো রুক্ষ দিনের কথা ভেবেই মৌসুমটা শুরু করেছিল লিভারপুল। দলবদলে কোনো খেলোয়াড় কেনা হয়নি, ইয়ুর্গেন ক্লপের বিদায়ের ক্ষতও তখনো দগদগে। এমন পরিস্থিতিতে ভালো কিছুর আশা ছেড়ে দিয়েছিল লিভারপুলের কট্টর সমর্থকেরাও।
কেউ কেউ মৌসুম শেষে দলকে ৮-১০ নম্বরেও দেখে ফেলেছিল। এমনকি আর্নে স্লট নামে নতুন একজন কোচ এসে যে ডাগআউটে দাঁড়িয়েছেন, সেটিও ঠিকঠাক কেউ খেয়াল করেননি। করবেন কীভাবে? ক্লপের বিদায়ের ধাক্কাটাই যে তারা তখনো সামাল দিতে পারেননি।
কিন্তু স্বপ্নহীন ও প্রাণহীন সেই মৌসুমটাকে দায়িত্ব নিয়েই রাঙিয়ে তোলেন স্লট। পুরো চিত্রটাকেই আগা গোড়া বদলে দেয় ‘স্লট-বল’ কৌশল। যার ফলে কয়েক মাসের ব্যবধানে ক্লপ নিয়ে তৈরি হওয়া হাহাকারও থেমে গেল। আর স্লট হয়ে গেলেন লিভারপুলের স্বপ্নের নাবিক। যার কাঁধে ভর দিয়ে প্রথমে কোয়াড্রপল এবং পরে ট্রেবল জেতার স্বপ্ন দেখছিল ক্লাবটি। কিন্তু মুদ্রার অন্য পিঠের ছবিটা তখনো দেখা বাকি।
ফুটবলে মৌসুমের যে কোনো পর্যায়েই হুট করে এসে হাজির হতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত বাজে সময়। আর এসেই ‘আজ রবিবার’ নাটকের ফরহাদ সাহেবের সেই বিখ্যাত ডায়লগের মতো বলতে পারে, ‘চলে এলাম’। দুঃসময়ের সেই ‘চলে আসার’ ডাকটা লিভারপুল শুনছে মৌসুমের শেষ ভাগে এসে। দলটি যখন ট্রেবল জয়ের স্বপ্নে বিভোর, তখনই এক ধাক্কায় এলোমেলো হয়ে গেল সাজানো সব স্বপ্ন। ১২ থেকে ১৬ মার্চ—মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে দুটি শিরোপা লড়াই থেকে ছিটকে গিয়ে রীতিমতো বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে অ্যানফিল্ডের ক্লাবটি। চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বিদায়ের পর হাতছাড়া হলো লিগ কাপের শিরোপাও।
আরও পড়ুনলিভারপুলকে হারিয়ে ৭০ বছর পর ইংল্যান্ডে ‘চ্যাম্পিয়ন’ নিউক্যাসল১৪ ঘণ্টা আগেফলে প্রায় ৮ মাস পর আবারও লিভারপুল সমর্থকদের কারও কারও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্টে আবার দেখা মিলতে শুরু করেছে ক্লপের ছবিও। মৌসুমের শেষ ভাগে এসে একের পর এক শিরোপা হারানোর যন্ত্রণায় আবার হয়তো তারা মিস করছেন জার্মান সেই জাদুকরকে। কিন্তু ক্লপ তো এখন অতীত, লিভারপুলে তৈরি হওয়া সমস্যা সমাধানে তাই হাত বাড়াতে হবে স্লটের দিকেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, সব তো ঠিকঠাকই চলছিল তাহলে সমস্যাটা বাধল কোথায়? মৌসুমে লিভারপুলের পারফরম্যান্সের দিকে একটু গভীরভাবে তাকালেই উত্তরটা মিলবে। মৌসুমটা উড়ন্তভাবেই শুরু করেছিল লিভারপুল। ক্লপের রেখে যাওয়া দলটাকে নিজের চাঁচে ফেলে গুছিয়েও নিয়েছিলেন স্লট।
তারওপর দলের মূল খেলোয়াড় মোহাম্মদ সালাহ, ভার্জিল ফন ডাইক কিংবা কোডি গাকপোরাও ছিলেন ছন্দে। ফলে ম্যাচের পর ম্যাচে লিভারপুল জিতেও চলছিল। এমনকি এর মধ্যে দলীয় এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে বেশ কিছু মাইফলকের সাক্ষীও হয়েছে ক্লাবটি। লিগে যেমন লিভারপুল ২৯ ম্যাচের মধ্যে হেরেছে মাত্র ১টি ম্যাচ।
সব মিলিয়ে লিগে লিভারপুল এখন পর্যন্ত ২৫ ম্যাচে অপরাজিত আছে। চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রথম পর্বেও লিভারপুল জিতেছে টানা ৭ ম্যাচ। কিন্তু স্তুপ করে রাখা এসব জয় দিন শেষে প্রত্যাশিত ফল এনে দিতে পারছে না। মূলত লম্বা সময় ধরে টানা ম্যাচ খেলার ধকল কোনো না কোনো পর্যায়ে আসতেই হতো।
হতাশ লিভারপুলের খেলোয়াড়েরা.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস
বাবা সন্তানের ওপর ছায়ার মতো স্নেহময় এক উপস্থিতি। নিঃশর্ত ভরসার প্রতীক। সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনের প্রয়োজনে নিজের বর্তমান, এমনকি নিজের স্বপ্নও নীরবে উৎসর্গ করে দিতে পারেন যিনি– আজ তাদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর দিন। বাবা দিবস উপলক্ষে সমতা’র বিশেষ আয়োজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা বৃহত্তর বরিশালে। এখন সেই জায়গাটা পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি পৌরসভার সমুদয়কাঠি গ্রাম। তখনকার সামাজিক পরিসরে আমাদের পরিবারের অবস্থা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভালো ছিল। আমার বাবা বিজয় কুমার আইচ তখন পিরোজপুরে কাজ করতেন। তাঁর রেশনের দোকান ছিল। প্রতি শনিবার বাড়ি আসতেন। আমরা বাবার আশায় বসে থাকতাম। এটি ছিল আমাদের জন্য একরকম আশীর্বাদের মতো।
বাবার একটি ব্যবসাও ছিল। এ থেকে মূলত আমাদের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের চেয়ে সম্ভবত বাবার জ্ঞান বা বোধ উন্নততর ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য দশ গ্রামের লোকজন তাঁকে মানত। গ্রামে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকত। বাবার সঙ্গে কথা না বলে কেউ থানা-পুলিশ করতে যেত না। বাবা সবাইকে খুব বুঝিয়ে বলত– মামলা করলে কে জিতবে, কে হারবে– এটি অনেক পরের কথা। মামলা নিয়ে বরিশাল-পিরোজপুরে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে দুই পক্ষই নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তারচেয়ে বরং তোমরা নিজেরা মিটমাট করে ফেল।
গ্রামের পণ্ডিতরা তখন তালপাতায় অ-আ-ক-খ শেখাতেন হাত ধরে ধরে। আমার সেটি একদম পছন্দ হতো না। বাবা কী করলেন, তিনি একটা স্লেট ও পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। অ-আ-ক-খ দিয়ে যত ছবি আঁকা হয়, তা শেখাতেন। এর মধ্যে আমার যে ছবিটা পছন্দ হতো, সেটি আমি মনের মধ্যে গেঁথে নিতাম। যার ফলে বাবার মাধ্যমে অত্যন্ত আনন্দদায়ক এক শিক্ষা পেয়েছি আমি।
আমার বাবারা ছিলেন ৪ ভাই। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দু’জন পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আমার বাবা ও এক কাকা বাড়ি ছেড়ে যাননি। আমরা ছিলাম ৬ ভাই ৩ বোন। কাকাতো ভাই ৪ জন, বোন একজন। মোট ১৪ ভাইবোন। কাকা কম বয়সেই গত হন। বিলাসী জীবন আমাদের ছিল না। তবে গ্রামের মানুষের কাছে আমরা ছিলাম বড়লোক। পরিবারে অনেক সদস্য থাকলেও খাবারের অভাব হতো না কখনোই। এমনকি দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থায়ও খাবারের কষ্ট করতে হয়নি। আমাদের একটা গুদামঘর ছিল। সেখানে বাবা পাশের বন্দর কাউখালী থেকে সারা বছরের চাল, ডাল, পাউডার দুধ, চিনি, লবণ, গুড় এনে ড্রামে ভরে রাখতেন। বাইরে যত সংকটই থাকুক না কেন, বছরজুড়ে খাবারের অভাব হতো না। সমস্যা হতো ঝড়ের সময়। উপকূলীয় অঞ্চলে এমন ঝড় মাঝে মাঝেই আসত। কখনও ঘরের চাল উড়ে গেলে আমরা সমস্যায় পড়ে যেতাম।
অন্যদের সামনে বাবা নিজের অবস্থানের জন্যই বেশি হাসি-তামাশা করতেন না। যখন আমাদের সঙ্গে থাকতেন, তখন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো হাসি-খুশি থাকতেন। তখনকার বাবাদের আমরা মারধর করতে দেখেছি, এমনকি খড়ম দিয়ে পেটাতে দেখেছি। বাবা আমার গালে জীবনেও একটা চড় মারেনি। কোনো ভাইবোনকেও মারধর করতে দেখিনি। তখন হয়তো আরও এমন বাবা ছিলেন। তবে গ্রামে আমি এমন বাবা আর দেখিনি। সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলেও তিনি কখনও জিজ্ঞেস করতেন না, কেন দেরি করে ঘরে ফিরেছি।