পবিত্র রমজানকে বলা হয় রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। আরবি রহমতের অর্থ দয়া, মাগফিরাতের অর্থ ক্ষমা এবং নাজাতের অর্থ মুক্তি। রমজানকে দয়া, ক্ষমা ও মুক্তির মাস বলার কারণ হলো মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের প্রথম দশক রহমতের, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাতের এবং তৃতীয় দশক জাহান্নাম থেকে মুক্তির।’ (মুসনাদে আহমদ)
এই হাদিসের বর্ণনা অনুসারে বর্তমানে মাগফিরাত বা ক্ষমার দশক চলছে। রমজান মাসে আল্লাহর ক্ষমা লাভে সচষ্টে হওয়া আবশ্যক। কেননা নবি (সা.
আল্লাহর ক্ষমা লাভের উপায়
প্রশ্ন হলো, রমজান মাসে বান্দা আল্লাহর মাগফিরাত বা ক্ষমা কীভাবে লাভ করবে? উত্তর হলো, রমজান মাসে আল্লাহর মাগফিরাত লাভের কিছু আমল বর্ণিত হয়েছে। বান্দার উচিত সেগুলোর ওপর আমল করা। আল্লাহর ক্ষমা লাভের এমন কয়েকটি আমল হলো-
১. কবিরা গুনাহ ত্যাগ করা : রমজান মাসে কবিরা তথা বড় বড় গুনাহ ত্যাগ করলে আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা করে দেবেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত,রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে আরেক জুমা এবং এক রমজান থেকে আরেক রমজান, তার মধ্যবর্তী সময়ের জন্য কাফফারা হয়ে যাবে যদি কবিরা গুনাহ হতে বেঁচে থাকে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৪০)
২. যথাযথভাবে রোজা রাখা : যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং সাওয়াবের আশায় রমজানের রোজাগুলো যথাযথভাবে রাখবে, আল্লাহ তার যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে ঈমানের সাথে ও সাওয়াব লাভের আশায় রোজা রাখবে তার পূর্ববর্তী গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হয় এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে, সাওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদরে রাত জেগে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০১৪)
৩. তারাবি ও তাহাজ্জুদ আদায় : আল্লাহর কাছে রাতের ইবাদত অতি মূল্যবান। এজন্য পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে তাহাজ্জুদ আদায় করতে বলা হয়েছে। রমজান মাসে তাহাজ্জুদ পড়া সহজ হয়ে যায়। এ মাসে রাতের আরেকটি ইবাদত হলো তারাবি। যে ব্যক্তি রমজানে তারাবি ও তাহাজ্জুদ আদায় করবে আল্লাহ তার গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজানে ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় রাত্রি জাগরণ করবে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ ক্ষমা করা হবে।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৫০২৭)
৪. কদরের রাতে ইবাদত করা : রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের পুরো শেষ দশকে ইবাদত-বন্দেগির পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন এবং এর মাধ্যমে তিনি কদরের রাত সন্ধান করতেন। তিনি মহিমান্বিত এই রাতে অধিক ইবাদত করার তাগিদ দিয়ে বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি কদরের রাত্রে ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় জাগরণ করবে, তার পূর্ববর্তী সব পাপ ক্ষমা করা হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০১)
৫. ইফতারের সময় দোয়া করা : আল্লাহ প্রতিদিন ইফতারের সময় রোজাদার বান্দাদের ক্ষমা করেন। তাই এ সময় আল্লাহর কাছে ক্ষমা লাভের দোয়া করা আবশ্যক। জাবির বিন আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক ইফতারের সময় আল্লাহ বহু সংখ্যক বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। আর তা প্রতিদিন হয়ে থাকে।’ (সহিহ আল জামে, হাদিস : ২১৭০)
৬. অধিক পরিমাণে দান করা : দানের মাধ্যমে বান্দার পাপ মার্জনা হয়। তাই রমজান মাসে অধিক পরিমাণে দান করা আবশ্যক। মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘দান গুনাহকে এমনভাবে মিটিয়ে দেয় যেভাবে পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৬১৬)
রমজানেও যারা ক্ষমা পাবে না
রমজান মাসে আল্লাহ তাঁর মাগফিরাতের দুয়ার খুলে দেন। কিন্তু বিশেষ কয়েক শ্রেণির মানুষের জন্য এই দুয়ার বন্ধ থাকে। তারা হলো, ক. যে ব্যক্তি মদপানে অভ্যস্ত, খ. যে ব্যক্তি মা-বাবার অবাধ্য, গ. যে ব্যক্তি আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে, ঘ. যে ব্যক্তি অন্তরে বিদ্বেষ পোষণ করে এবং বিদ্বেষের কারণে সম্পর্ক ছিন্ন করে। (শুআবুল ঈমান : ৫/২৭৭)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, এসব ব্যক্তিদের কদরের রাতেও ক্ষমা করা হয় না। তবে হাদিসের ব্যাখ্যাকার আলেমরা বলেন, আল্লাহ এসব ব্যক্তিদেরও ক্ষমা করেন। যদি তারা নিষ্ঠার সঙ্গে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং এসব পাপ ত্যাগ করার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে।
আল্লাহ সবাইকে রমজান মাসের ক্ষমা লাভের তাওফিক দিন। আমিন।
ঢাকা/শাহেদ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ত র প র ববর ত কদর র র ত রমজ ন ম স আল ল হ ত বল ছ ন বর ণ ত বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
বাথুয়া গ্রামের যে স্কুলে পড়েছিলেন অধ্যাপক ইউনূস
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রাথমিক পাঠ নিয়েছিলেন তাঁর নিজ গ্রাম হাটহাজারীর শিকারপুর ইউনিয়নের ‘পূর্ব বাথুয়া আলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’। ৯২ বছরের পুরোনো এই বিদ্যালয়টির এলাকায় পরিচিত ছিল ‘মহাজন ফইরের স্কুল’ নামে। চাটগাঁইয়া ভাষায় ‘ফইর’ মানে পুকুর। স্কুলের প্রবীণ শিক্ষকেরা বলছেন, এলাকার একটি পুকুরের পাশে হওয়ায় লোকমুখে স্কুলটির এমন নামকরণ।
‘মহাজন ফইরের স্কুল’ বা ‘পূর্ব বাথুয়া আলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়টির জন্য জমি দান করেছিলেন ‘১৯৩৭ সাবান’ কারখানার মালিক নুরালী সওদাগরের ছেলে নেয়ামত আলী। মহাজন পুকুরের পাশে টিনের ছাউনি দেওয়া একটি ভবন বিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে নাম ছিল ‘পূর্ব বাথুয়া আলামিয়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুল’। পরে ১৯৭৯ সালে দুই কিলোমিটার দূরে গ্রামেরই আরেকটি জমিতে স্কুলটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালে সারা দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় একসঙ্গে সরকারি হওয়ার সময় ‘আলামিয়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুলও’ সরকারি হয়। এরপর এটির নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব বাথুয়া আলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
অধ্যাপক ইউনূসের শৈশবের বিদ্যালয়
বাথুয়া গ্রাম ঘুরে, একাধিক বাড়িতে গিয়েও অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কোনো সহপাঠীর সন্ধান মেলেনি। স্থানীয় লোকজন বলছেন, তাঁর সঙ্গে পড়ালেখা করেছেন যাঁরা, তাঁদের বেশির ভাগই বেঁচে নেই, নয়তো শয্যাশায়ী।
তবে তাঁর সমবয়সী মুহাম্মদ শফি নামের একজনকে পাওয়া যায়। যিনি অধ্যাপক ইউনূসের দেড় বছরের বয়সে ছোট এবং খেলার সঙ্গী ছিলেন। শফি পড়ালেখা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর করেছেন জুয়েলারি দোকান। তাঁরও প্রাথমিক পাঠ আলামিয়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে। ৮৪ বছরের প্রবীণ মুহাম্মদ শফির সঙ্গে তাঁর বাসায় বসে কথা হয়। তিনি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের নানা স্মৃতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ১৯৪৫ সালে গ্রামের স্কুলটিতে ভর্তি হন অধ্যাপক ইউনূস। পড়েন তৃতীয় পর্যন্ত। শফি তাঁর এক ক্লাস নিচে পড়তেন। জুনিয়র হলেও তাঁদের সম্পর্ক ছিল একদম সহপাঠীর মতো। খেলেছেন, মেলায় ঘুরেছেন, নাটকও করেছেন একসঙ্গে।
মুহাম্মদ শফি বলেন, শৈশব থেকেই লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিলেন ইউনূস। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছেন। ছাত্রাবস্থায় বয়েজ স্কাউটে যোগ দিয়ে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। এসব দেখে সবারই মনে হতো, ইউনূস একদিন অনেক বড় হবেন।
কিশোর বয়স থেকে অধ্যাপক ইউনূস ভালো ছবি আঁকতেন বলে জানালেন মুহাম্মদ শফি। তিনি বলেন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি বরাবরই আকর্ষণ ছিল। ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’ নামে একটি পত্রিকাও বের করতেন ১৯৬১ সালের দিকে। ছোটবেলায় দুই ঈদে গ্রামে আসতেন। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা এবং নাটক করতেন। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতেও আসতেন। বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় বেড়াতেন সারা গ্রাম। ছাত্রাবস্থায় একবার বক্তৃতা দিতে উঠে মাইক হাতে নিয়ে তিনি হ্যালো বলেননি। বলেছিলেন, ‘মনোযোগ দিন, মনোযোগ দিন’। তার মানে বাংলাচর্চায় ছোটবেলা থেকেই তাঁর আগ্রহ ছিল।
আলামিয়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুল যে জায়গায় শুরু হয়, সেখানে দাঁড়িয়ে কথা হয় বাথুয়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি রহমত উল্লাহর সঙ্গে। তিনি কথায় কথায় জানালেন, একই স্কুলে অধ্যাপক ইউনূসের শিক্ষক ছিলেন তাঁর বাবা আবুল হোসেন মাস্টার। বাবা তাঁকে বলেছেন, অধ্যাপক ইউনূসকে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। নোবেল বিজয়ী হয়ে যখন ২০০৭ সালে গ্রামের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি আসেন, তখন ওই অনুষ্ঠানে নোবেল বিজয়ী ছাত্রকে দেখতে এসেছিলেন তাঁর বাবা। আবুল হোসেন ২০১৩ সালে মারা যান। রহমত উল্লাহ বলেন, ‘আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন, তাহলে অনেক খুশি হতেন। তাঁর ছাত্র যে আজ দেশের সরকারপ্রধান।’
বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি বরাবরই আকর্ষণ ছিল। ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’ নামে একটি পত্রিকাও বের করতেন ১৯৬১ সালের দিকে। ছোটবেলায় দুই ঈদে গ্রামে আসতেন। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা এবং নাটক করতেন। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতেও আসতেন। বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় বেড়াতেন সারা গ্রাম। ছাত্রাবস্থায় একবার বক্তৃতা দিতে উঠে মাইক হাতে নিয়ে তিনি হ্যালো বলেননি। বলেছিলেন, ‘মনোযোগ দিন, মনোযোগ দিন’। তার মানে বাংলাচর্চায় ছোটবেলা থেকেই তাঁর আগ্রহ ছিলমুহাম্মদ শফি, পূর্ব বাথুয়া আলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেই কোনো স্মৃতি
পূর্ব বাথুয়া আলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের অনেকেই জানে না, তাদের বিদ্যালয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পড়তেন একসময়। পঞ্চম শ্রেণির একাধিক শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাইলে তারা অবাক হয়। একাধিক শিক্ষার্থী বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, ‘না, এটা তো জানতাম না।’ তবে তথ্যটি জানার পর তারা সবাই উচ্ছ্বসিত হয়।
বিদ্যালয়ে নেই কৃতী শিক্ষার্থীদের কোনো তালিকা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিজ কার্যালয়ে বসে প্রধান শিক্ষক নাসিমা আকতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসলে এখানে যে অধ্যাপক ইউনূস পড়তেন, সেটা অনেকেই জানেন না। আমরা শিক্ষকেরাও জানতাম না। কোনো কারণে আগে এই তথ্য প্রচার হয়নি। আগের শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে কোনো কৃতী শিক্ষার্থীর তালিকা রাখেননি। এখন এমন একটি তালিকা করার কথা ভাবছি।’
বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক লাকি পালিত প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা খুবই গর্বের বিষয়। একজন নোবেল বিজয়ীর প্রাথমিক পাঠ নেওয়া বিদ্যালয়ে আমি শিক্ষকতা করছি, এটা ভাবতেই ভালো লাগে।’
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস