জাতীয় রাজনীতি, শিল্প, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রখ্যাত ব্যক্তির নামে ঐতিহাসিক স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণের রীতি উন্নত-অনুন্নত প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রচলিত রয়েছে। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক বিষয় নয়, এটি একটি দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক চেতনার প্রতিফলন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাস্তা, ভবন, প্রতিষ্ঠান, স্মৃতিস্তম্ভ, শহর বা এমনকি পুরো দেশের নাম পরিবর্তনের ঘটনা দেখা যায়। এই পরিবর্তনগুলোর পেছনে থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, ঐতিহাসিক পুনর্মূল্যায়ন, সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা বা ঔপনিবেশিক অতীত থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। নামকরণ ও নাম পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা সমাজের মূল্যবোধ ও আদর্শকে প্রকাশ করে।

ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস বহু দেশের স্থাপনাগুলোর নামে রয়ে গেছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর অনেক দেশই ঔপনিবেশিক নাম পরিবর্তন করে নিজেদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের মুম্বাই শহরটি ব্রিটিশ শাসনামলে ‘বোম্বে’ নামে পরিচিত ছিল। ১৯৯৫ সালে শহরটির নাম পরিবর্তন করে মুম্বাই রাখা হয়, যা স্থানীয় মারাঠি ভাষা ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন। একইভাবে আফ্রিকার অনেক দেশ স্বাধীনতার পর ঔপনিবেশিক নাম বদলে ফেলে। রোডেশিয়া নামটি পরিবর্তন করে জিম্বাবুয়ে রাখা হয়, যা দেশের আদিবাসী সংস্কৃতিকে সম্মান জানায়।

স্থাপনাগুলোর নামকরণ বা নাম পরিবর্তন প্রায়ই রাজনৈতিক আদর্শের প্রকাশ হিসেবে কাজ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে কমিউনিস্ট নেতাদের নামে থাকা রাস্তা বা স্থাপনাগুলোর নাম পরিবর্তন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরটি সোভিয়েত আমলে ‘লেনিনগ্রাদ’ নামে পরিচিত ছিল।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর শহরটির নাম আবার সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরিয়ে আনা হয়। এটি ছিল সোভিয়েত অতীত থেকে মুক্তির প্রতীক। একইভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের অবসানের পর অনেক স্থাপনার নাম পরিবর্তন করা হয়, যা নতুন গণতান্ত্রিক ও বহুজাতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। জোহানেসবার্গের ‘কিংগওয়ে’ রাস্তাটির নাম পরিবর্তন করে ‘জুলিয়াস মালেমা’ রাখা হয়, যা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানায়।

স্থাপনাগুলোর নামকরণ প্রায়ই জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ। তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরটি পূর্বে ‘কনস্টান্টিনোপল’ নামে পরিচিত ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের বিজয়ের পর শহরটির নাম পরিবর্তন করে ইস্তাম্বুল রাখা হয়, যা তুরস্কের ইসলামিক ও অটোমান ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। একইভাবে ইরানের রাজধানী তেহরানের অনেক রাস্তা ও স্থাপনার নাম ইসলামিক বিপ্লবের পর পরিবর্তন করা হয়, যা দেশের ইসলামিক পরিচয়কে তুলে ধরে।

বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু শুধু সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা দলবাজির কারণে নাম বদলের খেলা বোধ হয় বাংলাদেশে ছাড়া অন্য কোথাও প্রদর্শিত হয় না। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নাম পরিবর্তন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। অবশ্য নাম বদলের এই ঐতিহ্য আমরা উত্তরাধিকার সূত্রেই পাই।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর পুরান ঢাকার মদন মোহন বসাক রোডের নাম দেওয়া হয় টিপু সুলতান রোড আর দীপালি বালিকা বিদ্যালয় হয়ে যায় কামরুন নেসা বালিকা বিদ্যালয়। এটা ছিল পাকিস্তানের তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের সাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনার ফসল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো মূলত প্রতিহিংসা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে নামকরণ ও নামহরণের প্রতিযোগিতা শুরু করে।

অবশ্য আমরা লক্ষ করেছি, কোনো কোনো সময় সংকীর্ণ দলীয় চিন্তার ঊর্ধ্বে থেকে জাতীয় নেতাদের সম্মানার্থে নামকরণের প্রবণতা। একসময় রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে সুন্দর এলাকাটির নাম রাখা হয় শেরেবাংলা নগর, ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের নাম দেওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, আর জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের সবচেয়ে প্রশস্ত অ্যাভিনিউয়ের নাম রাখা হয় মানিক মিয়া (তফাজ্জল হোসেন, যিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের একজন অকুতোভয় সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব) অ্যাভিনিউ। এসব নামকরণ বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিতে একসময় নামকরণ ও নাম বদলের খেলাটি প্রতিযোগিতায় রূপ লাভ করে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের একমাত্র বিমানবন্দরের নাম ছিল তেজগাঁও বিমানবন্দর। ১৯৭৯ সালে ঢাকার অদূরে কুর্মিটোলার আন্তর্জাতিক মানের নতুন একটি বিমানবন্দর চালু হলে তার নাম রাখা হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ১৯৮১ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামানুসারে তদানীন্তন বিএনপি সরকার এর নাম দেয় জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কিন্তু ২০১০ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় শাসনামলে বিমানবন্দরটির নাম বদলিয়ে রাখা হয় ‘হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’। এই নাম বদলের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয় যে এ দেশের মানুষ যেহেতু সুফি আউলিয়াদের শ্রদ্ধা করে, সেহেতু একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের স্মৃতি রক্ষার্থে এই নামকরণ হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রিসভার এক সিদ্ধান্তে বলা হয়, যেহেতু হাইকোর্ট কর্তৃক পঞ্চম সংবিধান বাতিল এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতা জবরদখলকারী অবৈধ শাসক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেহেতু তাঁর নামে স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠান রাখা যাবে না।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে রেডিওতে স্বাধীনতা ঘোষণার পাঠক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের নামানুসারে রাখা হয় ‘এম এ হান্নান বিমানবন্দর’। পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সে নাম পাল্টিয়ে রাখে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত দরবেশ হজরত শাহ আমানতের নামে। এখনো এর নাম ‘শাহ আমানত বিমানবন্দর’।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নির্মিত ভৈরব সেতুর নাম বদলে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নামানুসারে রাখে ‘সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু’। জোট সরকার ওই নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য মৈত্রী সেতু’। এই সেতু উদ্বোধনকালে বিএনপি নেতা সাইফুর রহমান মন্তব্য করেন, ‘কোথাকার কে নজরুল ইসলাম, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদার।’  

শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে ‘বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার’ নাম দিয়ে দেশের প্রথম নভোথিয়েটারটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কর্তৃক উদ্বোধনের সময় এর নাম দেওয়া হয় ‘মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নভোথিয়েটার’। কিন্তু শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতার এসে বঙ্গবন্ধু নামটি পুনঃস্থাপন করেন। এভাবে অসংখ্য নামকরণ এবং নাম পরিবর্তনের প্রতিযোগিতা বাংলাদেশে দেখা গেছে।  

তবে শেখ হাসিনা টানা কয়েক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় নামকরণের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তা অভূতপূর্ব। তিনি নিজের নামে ছাড়াও তাঁর পরিবারের একেকজন সদস্যের নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা বা ভবনের নামকরণ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ হয়েছে অনেকগুলো। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কি না, তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান। এখন শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেই সব প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা বা ভবনের নাম পরিবর্তনের রীতিমতো হিড়িক পড়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটছে বা ঘটেছে, যা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির অনেক কৃতী সন্তানদের নামে ভবনের নাম পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। পতিত সরকারের পরিবার–সংশ্লিষ্ট নাম পরিবর্তনের যৌক্তিকতা থাকতে পারে কিন্তু এসব কৃতী সন্তান কী দোষ করল? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হলের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বিতর্কিত ভূমিকা রাখা এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নামে। যা নিয়ে রীতিমতো সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সবাই বর্তমান বাস্তবতায় এমন নামকরণের যৌক্তিকতা খুঁজছেন।

তবে স্থাপনাগুলোর নাম পরিবর্তন সব সময়ই বিতর্কের জন্ম দেয়। অনেক ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনগুলো ঐতিহাসিক স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা হিসেবে দেখা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কনফেডারেট জেনারেলদের নামে থাকা স্থাপনাগুলোর নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়েছে। কিছু মানুষ এটিকে ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন হিসেবে দেখেন, আবার অন্যরা এটিকে অতীতকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করেন।

ড.

সুলতান মাহমুদ অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন ম বদল র ঔপন ব শ ক ন মকরণ র র ন মকরণ র জন ত ক র র জন ত স ব ধ নত র অন ক ন র পর র পর ব ভবন র সরক র ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রম আদালতে ঝুলছে ২২ হাজার মামলা

সরকারের নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং ১৩টি শ্রম আদালতে মামলাজট কমছে না। মামলার তুলনায় নিষ্পত্তি কম হওয়ায় বাড়ছে জট। আইন অনুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে শ্রম আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। তবে ১৩টি শ্রম আদালতে ৬ মাসের বেশি হয়েছে এমন ১৩ হাজার ৪০২টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।  

শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত মার্চ মাসে সব শ্রম আদালত ও ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা ছিল ২২ হাজার ৭৩৭টি। ওই মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে ৭৮৮টি মামলা। এর মধ্যে ৬টি বিভাগীয় শ্রম আদালতে বিচারাধীন ৫০৫টি মামলা। ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশের সব শ্রম আদালতে বিচারাধীন ছিল ২১ হাজার ৬১টি মামলা। 
বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, বিচারক সংকট, মামলা ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহার না করা এবং আইনজীবী ও মালিকপক্ষের বারবার সময় নেওয়ার প্রবণতার কারণে মামলা নিষ্পত্তির গতি কমে গেছে। 

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সমকালকে বলেন, ‘কয়েকটি শ্রম আদালতে বিচারকের সংখ্যা মামলার তুলনায় অপ্রতুল। অনেক সময় মামলার নথি প্রস্তুত বা সাক্ষী হাজির করার প্রক্রিয়াও দীর্ঘ হয়, যে কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে গড়ে ৩ থেকে ৫ বছর লেগে যাচ্ছে।’ তাঁর মতে, মামলার আধিক্য অনুযায়ী শ্রম আদালতের কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন। তা না হলে শ্রম আদালতের প্রতি শ্রমিক-মালিক উভয় পক্ষ আস্থা হারাবে। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় শ্রম আইন দ্রুত যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। 

ঢাকার আদালতে ভয়াবহ জট

পরিসংখ্যান বলছে, শ্রমিকদের করা ১০ হাজার ৫৮৯টি মামলা ঢাকার তিনটি শ্রম আদালতে ঝুলে রয়েছে। মার্চ মাসের তথ্যানুযায়ী, ঢাকার ১ম শ্রম আদালতে বিচারাধীন ৪ হাজার ৬৭৬টি মামলা। ওই মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৭১টি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রম আদালতে বিচারাধীন যথাক্রমে ৩ হাজার ২৯৯ এবং ২ হাজার ৬১৪টি মামলা। নিষ্পত্তি হয়েছে যথাক্রমে ১২৫ ও ৭৩টি। 

চট্টগ্রামের চিত্র অনেকটা একই রকম। প্রথম শ্রম আদালতে ১ হাজার ৩৭৬টি এবং দ্বিতীয় আদালতে ৫৫৪টি মামলা বিচারাধীন। চট্টগ্রামে মোট বিচারাধীন ১ হাজার ৯৩০টি মামলার মধ্যে মার্চ মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১৭টি। ওই মাসে হয়েছিল ৫২টি মামলা। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের শ্রম আদালতে যথাক্রমে ২ হাজার ১৩৩ এবং ৫ হাজার ৫২৮টি মামলা বিচারাধীন। মার্চ মাসে এ দুই আদালতে নিষ্পত্তি হয় ৪২৩টি মামলা; একই সময়ে করা হয়েছিল ২০৮টি মামলা।

অন্য ৬টি  আদালতের চিত্র

বর্তমানে খুলনায় ৯১টি, রাজশাহীতে ৭৩, রংপুরে ৭৫, সিলেটে ৪৮, কুমিল্লায় ১৫২ এবং বরিশালে ৬৬টি মামলা বিচারাধীন। এ ৬টি বিভাগীয় শ্রম আদালতে সব মিলিয়ে বিচারাধীন ৫০৫টি মামলা।

শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালেও ঝুলছে অনেক মামলা

শ্রম আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার রায় বা যে কোনো আদেশের বিরুদ্ধে মালিক বা শ্রমিকের আপিল করার সুযোগ আছে। এজন্য আইন অনুযায়ী ঢাকায় গঠিত হয়েছে একমাত্র শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল। একটিমাত্র ট্রাইব্যুনাল থাকায় দেশের বিভাগীয় বা জেলা আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হলেও এর বিরুদ্ধে আপিল দায়ের বা শুনানির জন্য সংক্ষুব্ধ পক্ষকে (মালিক বা শ্রমিক) ঢাকায় আসাতে হয়। তবে অনেক শ্রমিকই ঢাকায় এসে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেত উৎসাহী হন না। আবার মামলা জটের কারনেও শ্রম আদালতে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে শ্রমিকদের। একইভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রম আদালত ও আপিল ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করে স্থগিতাদেশ নিয়ে বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে রাখে। এতেও বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয় এবং শ্রমিকরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। 
শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে ১ হাজার ২২৩টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ৪১টি মামলা হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। এ ছাড়া ৬ মাসের বেশি হয়েছে এমন মামলা শ্রম আপিল ট্রাইবুন্যালে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে ৮২২টি। 

বিচার পেতে বছর গুনছেন শ্রমিকরা

রূপগঞ্জের গার্মেন্ট শ্রমিক মনিরা আক্তার বকেয়া বেতন ও ছাঁটাইয়ের ক্ষতিপূরণ দাবিতে ২০১৮ সালে ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতে মামলা করেন। এখন পর্যন্ত পাঁচবার বিচারক বদল হয়েছে এবং মামলার সাক্ষ্য পর্বই শেষ হয়নি। মনিরা বলেন, ‘আগে মামলার খোঁজখবর রাখতাম। শুধু তারিখ দেয়। বিচারক থাকেন না। মালিকপক্ষের আইনজীবীও বারবার সময় নেন। এখন আর খবর নিই না। সারাদিন আদালতে ঘুরলে চাকরি থাকত না।’

জনবল সংকট

আপিল ট্রাইব্যুনাল ও ১৩টি শ্রম আদালতে বর্তমানে ৫৮টি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি শ্রম আদালতে রেজিস্ট্রারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। তাই এসব আদালতে আদেশের অনুলিপি সংগ্রহ, মামলা করা, কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্তি করাসহ নানা ক্ষেত্রে মামলা-সংশ্লিষ্টদের ভোগান্তি হচ্ছে। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. হেদায়েতুল ইসলাম সমকালকে বলেন, শূন্য পদ পূরণে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।  বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)-এর আইন উপদেষ্টা (অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ) এসএম রেজাউল করিম বলেন, ‘শ্রম মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মালিক ও শ্রমিকপক্ষকে সচেতন হতে হবে। আইনে বলা আছে, সর্বোচ্চ ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। বাস্তবে তা হয় না। আইনজীবীরাও মামলা দীর্ঘায়িত করেন। অনেক সময় শ্রমিকপক্ষ উপস্থিত থাকে, অথচ মালিকপক্ষ বারবার সময় নেয়।’

তিনি আরও বলেন, শ্রম আইন সংশোধনের বিষয়টিও দীর্ঘদিন ঝুলে আছে। এটি দ্রুত হওয়া প্রয়োজন।’

এ প্রসঙ্গে শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘শ্রম আইন সংশোধনের জন্য আমরা চার-পাঁচ মাস ধরে কাজ করছি। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে আইনটি সংশোধন করা হচ্ছে। শ্রম কমিশন ইতোমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আমরা সেটি এবং খসড়া আইন পর্যালোচনা করছি। আশা করছি, 
জুলাই-আগস্টের মধ্যে নতুন আইন প্রণীত হবে।’ সচিব আরও বলেন, ‘শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা, আদালত পুনর্বিন্যাস ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) ব্যবস্থার কথা নতুন আইনে থাকছে। এতে হয়রানি কমবে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ