ইসরায়েলের নৃশংসতা নিয়ে যদি সবাই মুখ খুলত
Published: 20th, March 2025 GMT
ইসরায়েলের গণহত্যা কিছুদিনের জন্য থেমে ছিল, কিন্তু গত সোমবার রাতের ভয়াবহ বিমান হামলায় ফিলিস্তিনিরা আবারও সেই নৃশংসতার শিকার হলো। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চার শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেক শিশু ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প এই হামলার অনুমতি দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হামলার পরপরই এলাকাবাসীকে দ্রুত এলাকা ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়, যা মূলত জোরপূর্বক উচ্ছেদ। এতে নতুন করে স্থল অভিযান শুরুর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইসরায়েলের দাবি, হামাস যুদ্ধবিরতির শর্ত মানেনি; যদিও ইসরায়েল নিজেই বারবার সেই শর্ত লঙ্ঘন করেছে।
এ হামলার পর সিএনএন জানায়, ইসরায়েলের আগ্রাসন যুদ্ধবিরতিকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে। কিন্তু সত্য হলো, যদি অস্ত্রবিরতিকেই যুদ্ধবিরতি ধরা হয়, তাহলে এখানে আদৌ কোনো যুদ্ধবিরতি ছিল না। তথাকথিত যুদ্ধবিরতির সময় গাজায় মাত্র একজন ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন, সেটাও ইসরায়েলি সেনাদের ভুলে। অন্যদিকে এই সময়ের মধ্যে গাজায় ১৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আর পশ্চিম তীরেও বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
রঙিন পোশাক পরা একটি শিশুর নিথর দেহ পড়ে আছে; এক বাবা শেষবারের মতো মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন; সাদা কাপড়ে মোড়ানো পুরো পরিবার পড়ে আছে—এ ধরনের অগণিত ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। হতভাগ্য এসব মানুষের নাম কোনো সরকারি নথিতে থাকবে না। অথচ এর আগে কখনো কোনো যুদ্ধাপরাধ এত স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়নি।এই বাস্তবতা দেখায়, কীভাবে ইসরায়েলের সহিংসতাকে সহজভাবে মেনে নেওয়া হয়, আর ফিলিস্তিনিদের জীবনকে মূল্যহীন করে তোলা হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একদিন নিশ্চয়ই প্রশ্ন করবে, ‘এত বড় অপরাধ এত দিন ধরে চলতে দেওয়া হলো কীভাবে?’
আজকের যুগে মুঠোফোন আর ইন্টারনেট থাকার সুবাদে গাজায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের এত স্পষ্ট প্রমাণ আছে, যা অতীতের অপরাধের ক্ষেত্রে কখনো ছিল না। গাজার মানুষ ৫২৯ দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের ওপর চালানো ধ্বংসযজ্ঞের ছবি ও ভিডিও শেয়ার করছেন এই আশায় যে বিশ্ব একদিন জেগে উঠবে এবং এই গণহত্যা বন্ধ হবে।
রঙিন পোশাক পরা একটি শিশুর নিথর দেহ পড়ে আছে; এক বাবা শেষবারের মতো মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন; সাদা কাপড়ে মোড়ানো পুরো পরিবার পড়ে আছে—এ ধরনের অগণিত ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। হতভাগ্য এসব মানুষের নাম কোনো সরকারি নথিতে থাকবে না। অথচ এর আগে কখনো কোনো যুদ্ধাপরাধ এত স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়নি।
আরও পড়ুনফিলিস্তিনি শিশুদের প্রাণ কি এতই তুচ্ছ১৩ আগস্ট ২০২২গত সপ্তাহে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইসরায়েল কীভাবে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের হত্যা করেছে, বন্দীদের ওপর ভয়াবহ যৌন নির্যাতন চালিয়েছে—যেখানে সবজি থেকে শুরু করে ঝাড়ুর কাঠি পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি তারা একটি আইভিএফ ক্লিনিক ধ্বংস করেছে, যেখানে চার হাজার ভ্রূণ সংরক্ষিত ছিল। ফিলিস্তিনিদের সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা নষ্ট করাকে এই গণহত্যার অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এমন নৃশংসতার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। একের পর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইসরায়েল কীভাবে গাজার ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ ও গির্জা ধ্বংস করেছে। পুরো গাজার ৮৩ শতাংশ গাছপালা, ৮০ শতাংশের বেশি কৃষিজমি ও ৯৫ শতাংশ গবাদিপশু নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে ৮০ শতাংশের বেশি পানি ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে, যাতে গাজায় মানুষের জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে। ইসরায়েল সুপরিকল্পিতভাবে গাজাকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। এ কারণেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ইসরায়েল এখনো গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।
যদি পৃথিবী ন্যায়ের পথে চলত, তাহলে এই গণহত্যার সমর্থকেরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কেউ যদি রুয়ান্ডার গণহত্যাকে সমর্থন করত, তাহলে সে সমাজের প্রত্যাখ্যাত ব্যক্তি হয়ে যেত। অথচ এখন ইসরায়েলের এই ভয়াবহ সহিংসতার বিরোধিতা করাই অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা ইসরায়েলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছে, তাদের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে, এমনকি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক মাহমুদ খলিলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাঁকে নিজ দেশ থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুনট্রাম্পের গাজা ‘সাফ’ করার মতলব সফল হবে না৩০ জানুয়ারি ২০২৫পশ্চিমা বিশ্বে বাক্স্বাধীনতার ওপর ভয়াবহ ও পরিকল্পিত আঘাত এসেছে। অন্যায়ের সামনে নীরব থাকা সব সময়ই ভুল, আর যখন কোনো সরকার গণহত্যা চালাচ্ছে, তখন এই নীরবতা আরেকটি গুরুতর অপরাধ। ইতিহাসের প্রতিটি ভয়ংকর অপরাধের সময় নীরব দর্শকেরাই অপরাধীদের বড় সহায়তা করেছে।
যদি সবাই মুখ খুলত, তাহলে কী হতো? সবাই মুখ খুললে অনেক মন্ত্রী সরকার থেকে পদত্যাগ করতেন। সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলো ইসরায়েলের অপরাধ নিয়ে প্রতিদিন শিরোনাম করত এবং এটিকে ভয়াবহ অপরাধ বলে তুলে ধরত। মানুষ জোরালোভাবে দাবি তুলত, এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞার দাবি এত প্রবল হতো যে কেউ তা উপেক্ষা করতে পারত না।
যাঁরা চুপ আছেন, তাঁদের অনেকেই মনে মনে অপরাধবোধে ভুগছেন। আর সেটাই স্বাভাবিক। তবে তাঁদের এই ভয় আর নীরবতা একুশ শতকের অন্যতম ভয়ংকর অপরাধকে স্বাভাবিক করে তুলেছে। নীরবতা ভাঙার মানে শুধু সহানুভূতি দেখানো বা সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করা নয়; বরং অপরাধকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা এবং যারা এটি চালাচ্ছে ও সমর্থন দিচ্ছে, তাদের জবাবদিহির মুখে দাঁড় করানো।
● ওয়েন জোন্স গার্ডিয়ান পত্রিকার কলাম লেখক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র র অপর ধ গণহত য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ