মানুষ যেন জীবন চলার পথে সাবধান থাকে: জাহিদ হাসান
Published: 20th, March 2025 GMT
তার ডাক নাম পুলক। মা রেখেছিলেন পুলক নামটি। ছেলেবেলার বন্ধুরা এখনও পুলক নামেই ডাকেন। কাছের মানুষরাও কেউ কেউ পুলক নামে ডাকেন আজও। কিন্তু মিডিয়ায় দেশ-বিদেশে তিনি পরিচিত জাহিদ হাসান নামে। জাহিদ নামটি রেখেছিলেন তাঁর দাদা। পুলক থেকে সবার ভালোবাসায় আজকের জাহিদ হাসান হয়ে উঠেছেন তিনি। হয়েছেন টিভি নাটকের অন্যতম দর্শকপ্রিয় তারকা।
নব্বই দশকের শুরুতে টিভি নাটকের নায়কদের মধ্যে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল মুখ। সিনেমা করেও পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। বর্তমানে নতুন কোনো নাটক, সিনেমায় দেখা মেলে না অভিনেতার। অবশেষে তিনি দেখা দিলেন একটি ওয়েব ফিল্মে। নাম ‘আমলনামা’। রায়হান রাফীর নির্মাণ এটি।
সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণায় সিনেমা নির্মাণে জুড়ি নেই রায়হান রাফীর। ‘জানোয়ার’, ‘ফ্রাইডে’, ‘টান’, ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’র পর এবার সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে তিনি বানিয়েছেন ‘আমলনামা’। আমলনামায় ইমরান জামান চরিত্রে অভিনয় করেছেন জাহিদ হাসান। সিনেমায় তিনি একজন পুলিশ সদস্য। ওপরের নির্দেশে তাঁর হাতেই খুন হন হাসান। শেষে তাঁর অনাগত সন্তানের পৃথিবীর আলো দেখা হয় না। বরাবরের মতোই ইমরান জামান চরিত্রটি নিজের মতো করে ফুটিয়ে তুলে দর্শকদের প্রশংসা পাচ্ছেন জাহিদ হাসান।
জাহিদ হাসান বলেন, ‘দারুণ একটি গল্পের কাজ আমলনামা। কাজটি সবার কাছে প্রশংসিত হচ্ছে শুনে ভালো লাগছে। সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। আমরা আমাদের চরিত্রের মাধ্যমে যে ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, সেগুলো যেন আর না ঘটে, সে জন্যই কাজটি করা। ওয়েব ফিল্মটির নামটাও গল্পের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। মানুষ যেন জীবনে চলার পথে সাবধান থাকে, কী করব আর কী করব না, সেটা যেন চিন্তা করে।’
সর্বশেষ দুই বছর আগে গৌতম কৌরির ওয়েব সিরিজ ‘কে’তে দেখা গিয়েছিল জাহিদ হাসানকে। বিরতি কাটিয়ে আমলনামার মাধ্যমে ফের ওটিটিতে ফিরেছেন জাহিদ হাসান। এদিকে অনেক দিন ধরে নাটকে অনিয়মিত তিনি। কালেভদ্রে শোনা যায় নতুন নাটকে কাজ করার কথা। অসুস্থতাও ঝেঁকে বসেছে শরীরে। এসব ছাপিয়ে জাহিদ হাসানের ওটিটিতে এমন উপস্থিতি দারুণভাবে উচ্ছ্বসিত করেছে ভক্তদের। আগামীতে ওটিটির কাজে নিয়মিতই থাকবেন বলে জানালেন জাহিদ হাসান। তবে সেটা গল্প ও চরিত্রের ওপর নির্ভর করছে বেশি।
অভিনেতার ভাষ্য, ‘বেশ যত্ন ও আন্তরিকতা নিয়ে ওটিটির কাজগুলো হয়। সময় নিয়ে এসব কাজ করার কারণে মানের ক্ষেত্রেও খুব একটা আপস করেন না পরিচালক ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। তাই কাজ করে এক ধরনের তৃপ্তি পাওয়া যায়। আমি তো বরাবরই ভালো কাজের দিকে মনোযোগী। আগামীতেও গল্প ও চরিত্র ভালো হলে নিয়মিতই থাকব এ মাধ্যমে।’
প্রায় চার দশকের দীর্ঘ অভিনয় জীবনে সব ধরনের কাজেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন জাহিদ হাসান। এখন বছরজুড়ে তাঁর কাজের সংখ্যা হাতেগোনা। তবে নিয়মিত একটি ধারাবাহিক নাটকে কাজ করছেন তিনি। ধারাবাহিকটির নাম ‘ভাল্লাগেনা’। জাকির হোসেন উজ্জ্বলের পরিচলানায় নির্মিত এই ধারাবাহিকটি নিয়ে অভিনেতার ভাষ্য, ‘যারা মানসিকভাবে এ ফোবিয়ায় আক্রান্ত তারা আসলে নতুন সম্পর্ক নিয়ে আতঙ্কে থাকেন। বিবাহিত জীবন নিয়ে ভয় কাজ করে। নিজের ব্যক্তিস্বাধীনতার জায়গাটুকু খর্ব হতে পারে কিংবা মানিয়ে চলা যাবে কিনা এ ধরনের ভয় কাজ করে তাদের মাঝে। এমন কিছু মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয় নিয়েই নাটক ভাল্লাগেনা।’
যে অভিনেতার ডজন ডজন ধারাবাহিক প্রচার হতো টিভিতে সেই অভিনেতা এখন একটি ধারাবাহিক নিয়ে সন্তুষ্টির ঢেকুর তুললেন। বললেন, এখন তো ধারাবাহিক নাটক কম নির্মাণ হয়। তার মধ্যেও আমার একটি প্রচার হচ্ছে। এটাই কম কিসে?
অভিনয়ের জন্য তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তিনি মনে করেন, পুরস্কার একটি মানদণ্ড, কাজের স্বীকৃতি। শিল্পীরা কাজ করেন ভালোবাসা থেকে। পুরস্কার পেলে তাঁর উৎসাহ ও দায়বদ্ধতা বেড়ে যায়। সিনেমায় আরও ভালো ভালো চরিত্রে অভিনয় করতে চান জাহিদ হাসান। বারবার চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে নতুনভাবে দেখার ইচ্ছা এখনও আছে তাঁর।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
মে দিবস ২০২৫ : শ্রমিক-মালিক ঐক্যে গড়বে নতুন বাংলাদেশ
১৮৮৬ সালের ১ মেÑএকটি দিন, একটি দাবি, আর হাজারো শ্রমিকের আত্মত্যাগের মাধ্যমে ইতিহাসে রক্তাক্ত দাগ কেটে দিয়েছিল যে মুহূর্ত, তা আজ বিশ্বব্যাপী ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। তখনকার দাবিটি ছিল স্রেফ ৮ ঘণ্টা শ্রমের অধিকার। কিন্তু আজ ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে শ্রমিকের দাবি শুধু সময়
নয়Ñমর্যাদা, সুরক্ষা ও ন্যায্যতার প্রশ্নও।
এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য “শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এদেশ নতুন করে”Ñএ যেন সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই বার্তা কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, বরং তা রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও সমাজের জন্য এক যৌথ দিকনির্দেশনা।
বাংলাদেশের শ্রমচিত্র ও বাস্তবতা
বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত শ্রমনির্ভর। তৈরি পোশাক শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ, কৃষি ও নির্মাণ খাতে আরও কয়েক কোটি মানুষ নিয়োজিত। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে শ্রমনির্ভর খাত থেকে। কিন্তু যাঁরা এই অর্থনীতির ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করছেন, সেই শ্রমিকরা কি পেয়েছেন তাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা?
দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনও বহু শ্রমিক পান না ন্যূনতম মজুরি, কর্মস্থলে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সেবা কিংবা ছুটি সংক্রান্ত মৌলিক সুবিধা। নারী শ্রমিকদের পরিস্থিতি আরও জটিলÑযত্রতত্র হয়রানি, মাতৃত্বকালীন সুবিধার অভাব, কিংবা নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ গড়ে না তোলার ফলে এই খাতেও স্থিতিশীলতা আসছে না।
মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক: দ্বন্দ্ব নয়, দরকার সহমর্মিতা
এক সময় শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক মানেই ছিল দ্বন্দ্ব, ধর্মঘট ও হুমকি। তবে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা বলছেÑসহযোগিতাই টেকসই উৎপাদনের চাবিকাঠি। মালিকপক্ষ যখন শ্রমিককে কেবল “ব্যয়” হিসেবে না দেখে “সম্পদ” হিসেবে বিবেচনা করেন, তখন প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়। একইভাবে শ্রমিকও যদি বুঝেন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন মানে তার কর্মস্থলের স্থায়িত্বÑতাহলে দুপক্ষের মধ্যে বিশ্বাসের
ভিত্তি গড়ে ওঠে।
এই বিশ্বাস গঠনের জন্য প্রয়োজন তিনটি স্তম্ভ:
নীতিগত স্বচ্ছতা Ñ ন্যায্য মজুরি, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা ও চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তা দায়িত্বশীল মালিকপক্ষ Ñ কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিতে উদ্যোগ সচেতন শ্রমিকশ্রেণি Ñ অধিকার আদায়ের পাশাপাশি কর্তব্য পালনের মানসিকতা
নীতি ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ ও সংশোধিত ২০১৮ সংস্করণ অনুযায়ী শ্রমিকের অধিকার স্বীকৃত হলেও বাস্তবায়নের জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে (যেমন কৃষি, গৃহপরিচারিকা, গিগ-ওয়ার্কার) শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি এখনও প্রায় উপেক্ষিত।
এছাড়া, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, দুর্ঘটনা বীমা, এবং পুনঃপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার হওয়া জরুরি। সরকার শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন করলেও তা অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
এই প্রেক্ষাপটে ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে’ দেশ গড়ার বার্তাটি যেন শুধুই স্লোগানে সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং এটি হোক রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আর্থিক বিনিয়োগ ও মানবিক বিবেচনার এক বাস্তব প্ল্যাটফর্ম।
প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ ও নতুন শ্রম বাস্তবতা
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে শ্রমবাজার দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন ও গিগ-ইকোনমি অনেক চাকরি বিলুপ্ত করছে, আবার নতুন দক্ষতা চাচ্ছে। বাংলাদেশ যদি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায়, তাহলে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, পুনঃস্কিলিং এবং ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এখানে মালিক ও রাষ্ট্র উভয়ের উচিত হবে, শ্রমিককে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে বিনিয়োগ করা, কারণ দক্ষ শ্রমিক ছাড়া কোনো শিল্পই টিকে থাকে না।
মে দিবস: উৎসব নয়, দায়বদ্ধতার প্রতীক
মে দিবস কেবল লাল পতাকা হাতে শোভাযাত্রার দিন নয়, এটি আমাদের মানবিক চেতনার প্রতিফলন। যে শ্রমিক ঘাম ঝরিয়ে ভবন গড়ে, কৃষি জমি চষে, রপ্তানি পণ্য তৈরি করেÑতার জন্য আমাদের উচিত মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা।
এবছর, আসুন আমরা সবাই রাষ্ট্র, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকÑএকটি মানবিক, উৎপাদনশীল ও শীদারিত্বভিত্তিক সমাজ গঠনের পথে এগিয়ে যাই। শ্রমিকের হাতে গড়া এই বাংলাদেশ হোক তার জন্যই গর্বের জায়গা।
লেখক পরিচিতি:
মীযানুর রহমান
সাংবাদিক ও সমাজ বিশ্লেষক
মোবাইলঃ ০১৭৫৪১০৯০৭২
যোগাযোগ: : [email protected]