ঠিক কোন রাতে শবে কদর কোরআনে তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। তবে কদর যে রমজান মাসে, তার নির্দেশ স্পষ্ট। সুরা বাকারায় বলা হয়েছে, কোরআন রমজান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৭) এবং সুরা কদর-এ বলা হয়েছে, কোরআন কদর রাতে নাজিল হয়েছে। (সুরা কদর, আয়াত: ১)
আর এই রাত যে রমজানের শেষ দশকে হবে বলে, তা বহু হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। এমনকি তা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলেও হাদিসে এসেছে। (বুখারি, হাদিস: ২,০২০) এমনকি কোনও হাদিসে আমরা শেষ সাত দিনের কথাও দেখেছি। (মুসলিম, হাদিস: ২,৮২২)
আরও পড়ুনশবে কদরের ফজিলত ও আমল২১ জুন ২০১৭সাতাশ না একুশ
অনেকে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর বলতে কেবল সাতাশের রাতকে বোঝেন। বিশুদ্ধ মত অনুসারে, কদর কেবল সাতাশের রাতে সীমাবদ্ধ নয়। তবে, অন্যান্য রাতের তুলনায় এ রাতের ব্যাপারে প্রবল ধারণা পোষণ করা যায়। কেননা, সাতাশতম রাতে কদর হওয়ার বর্ণনাও রয়েছে। রাসুল (সা.
এ-সম্পর্কিত অধিক বর্ণনার কারণে সাহাবি উবাই বিন কাব (রা.) শপথ করে বলতেন যে, তা সাতাশের রাতেই ঘটে। (মুসলিম, হাদিস: ১,৮২২)
তবে একুশের রাত ও তেইশের রাতে লাইলাতুল কদর হয়েছে, এমন প্রমাণও হাদিসে পাওয়া যায়। আবু সাইদ খুদরি (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমাকে তা এক বেজোড় রাতে দেখানো হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে যে, আমি সে ভোরে কাদা ও মাটিতে সেজদা দিচ্ছি।’ এরপর তিনি একুশের রাতে রাতভর ইবাদত করলেন। তিনি ফজর নামাজের জন্য দাঁড়ানো মাত্র আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। মসজিদে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ছিল। আমি কাদা ও পানি দেখতে পেলাম। নামাজ শেষে যখন তিনি বের হলেন, তখন তার কপাল ও নাকের পাশে ছিল পানি ও কাদা। সেটি ছিল একুশের রাত। (বুখারি, হাদিস: ২,০১৮)
আরও পড়ুনরমজানের নেয়ামত লাইলাতুল কদর০৬ এপ্রিল ২০২৪কেন তারিখ নির্ধারণ করা যায়নি
আবদুল্লাহ ইবনে আনিস (রা.) বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, ‘রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রথমে আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হলেও পরে আমি তা ভুলে যাই। আমাকে দেখানো হয়েছিল যে, সে ভোরে পানি ও কাদায় আমি সেজদা দিচ্ছি।’ বর্ণনাকারী বলেন, তেইশের রাতে আমরা বৃষ্টি স্নাত হলাম, রাসুল (সা.) আমাদের নিয়ে নামাজ আদায় করলেন। বের হওয়ার সময় দেখা গেল, তার কপাল ও নাকে পানি ও কাদার চিহ্ন।’ (মুসলিম, হাদিস: ২,৮৩২)
বোঝা গেল, অধিকতর সম্ভাবনার দিক দিয়ে প্রথম হলো রমজান মাসের ২৭ তারিখ। দ্বিতীয়: ২৫ তারিখ। তৃতীয়: ২৯ তারিখ। চতুর্থ : ২১। আর পঞ্চম হলো: ২৩ তারিখ।
বিভিন্ন মতের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, লাইলাতুল কদরকে গোপন করা হয়েছে, এবং শেষ দশের বেজোড় রাতগুলোতে—নির্দিষ্ট এক রাতে নয়, ভিন্ন ভিন্ন রাতে উপস্থিত হয়। মানুষের জন্য আল্লাহ তয়ালার পক্ষ হতে এটা এক বিশেষ দয়া যে, কখনো এক রাতে, কখনো ভিন্ন রাতে কদর হাজির হয়। আমলে আগ্রহী ও উদাসীনদের মাঝে এক সরল পার্থক্য রেখা টেনে দেয়। তিনি দেখতে চান এর বরকত ও ফজিলত লাভের জন্য কে কত প্রচেষ্টা চালাতে পারে। (ফজলুল আশারিল আওয়াখিরি মিন রামযান, আব্দুল্লাহ শহিদ আব্দুর রহমান)
আরও পড়ুনরোজার শেষ দশ দিনে করণীয়৩১ মার্চ ২০২৪উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস
বাবা সন্তানের ওপর ছায়ার মতো স্নেহময় এক উপস্থিতি। নিঃশর্ত ভরসার প্রতীক। সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনের প্রয়োজনে নিজের বর্তমান, এমনকি নিজের স্বপ্নও নীরবে উৎসর্গ করে দিতে পারেন যিনি– আজ তাদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর দিন। বাবা দিবস উপলক্ষে সমতা’র বিশেষ আয়োজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা বৃহত্তর বরিশালে। এখন সেই জায়গাটা পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি পৌরসভার সমুদয়কাঠি গ্রাম। তখনকার সামাজিক পরিসরে আমাদের পরিবারের অবস্থা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভালো ছিল। আমার বাবা বিজয় কুমার আইচ তখন পিরোজপুরে কাজ করতেন। তাঁর রেশনের দোকান ছিল। প্রতি শনিবার বাড়ি আসতেন। আমরা বাবার আশায় বসে থাকতাম। এটি ছিল আমাদের জন্য একরকম আশীর্বাদের মতো।
বাবার একটি ব্যবসাও ছিল। এ থেকে মূলত আমাদের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের চেয়ে সম্ভবত বাবার জ্ঞান বা বোধ উন্নততর ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য দশ গ্রামের লোকজন তাঁকে মানত। গ্রামে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকত। বাবার সঙ্গে কথা না বলে কেউ থানা-পুলিশ করতে যেত না। বাবা সবাইকে খুব বুঝিয়ে বলত– মামলা করলে কে জিতবে, কে হারবে– এটি অনেক পরের কথা। মামলা নিয়ে বরিশাল-পিরোজপুরে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে দুই পক্ষই নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তারচেয়ে বরং তোমরা নিজেরা মিটমাট করে ফেল।
গ্রামের পণ্ডিতরা তখন তালপাতায় অ-আ-ক-খ শেখাতেন হাত ধরে ধরে। আমার সেটি একদম পছন্দ হতো না। বাবা কী করলেন, তিনি একটা স্লেট ও পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। অ-আ-ক-খ দিয়ে যত ছবি আঁকা হয়, তা শেখাতেন। এর মধ্যে আমার যে ছবিটা পছন্দ হতো, সেটি আমি মনের মধ্যে গেঁথে নিতাম। যার ফলে বাবার মাধ্যমে অত্যন্ত আনন্দদায়ক এক শিক্ষা পেয়েছি আমি।
আমার বাবারা ছিলেন ৪ ভাই। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দু’জন পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আমার বাবা ও এক কাকা বাড়ি ছেড়ে যাননি। আমরা ছিলাম ৬ ভাই ৩ বোন। কাকাতো ভাই ৪ জন, বোন একজন। মোট ১৪ ভাইবোন। কাকা কম বয়সেই গত হন। বিলাসী জীবন আমাদের ছিল না। তবে গ্রামের মানুষের কাছে আমরা ছিলাম বড়লোক। পরিবারে অনেক সদস্য থাকলেও খাবারের অভাব হতো না কখনোই। এমনকি দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থায়ও খাবারের কষ্ট করতে হয়নি। আমাদের একটা গুদামঘর ছিল। সেখানে বাবা পাশের বন্দর কাউখালী থেকে সারা বছরের চাল, ডাল, পাউডার দুধ, চিনি, লবণ, গুড় এনে ড্রামে ভরে রাখতেন। বাইরে যত সংকটই থাকুক না কেন, বছরজুড়ে খাবারের অভাব হতো না। সমস্যা হতো ঝড়ের সময়। উপকূলীয় অঞ্চলে এমন ঝড় মাঝে মাঝেই আসত। কখনও ঘরের চাল উড়ে গেলে আমরা সমস্যায় পড়ে যেতাম।
অন্যদের সামনে বাবা নিজের অবস্থানের জন্যই বেশি হাসি-তামাশা করতেন না। যখন আমাদের সঙ্গে থাকতেন, তখন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো হাসি-খুশি থাকতেন। তখনকার বাবাদের আমরা মারধর করতে দেখেছি, এমনকি খড়ম দিয়ে পেটাতে দেখেছি। বাবা আমার গালে জীবনেও একটা চড় মারেনি। কোনো ভাইবোনকেও মারধর করতে দেখিনি। তখন হয়তো আরও এমন বাবা ছিলেন। তবে গ্রামে আমি এমন বাবা আর দেখিনি। সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলেও তিনি কখনও জিজ্ঞেস করতেন না, কেন দেরি করে ঘরে ফিরেছি।