রংপুরের গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের মহিপুর বাজারের পূর্বদিকে বিজয় বাঁধ। তিস্তার এই বাঁধের ওপর নদীভাঙনে নিঃস্ব হওয়া বেশ কিছু ভূমিহীন পরিবারের বাস। এই চরে মিষ্টিকুমড়া চাষে কর্মসংস্থান হয়েছে এখানকার ব্যবসায়ী, শ্রমিক-মজুর, ভ্যানচালকসহ চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের। চরের উৎপাদিত কুমড়া পাল্টে দিয়েছে স্থানীয় অর্থনীতির চিত্র।
পূর্ব প্রান্তে গজঘণ্টা ইউনিয়নের ছালাপাক চরের সীমানার বাসিন্দা জহিরন বেওয়া (৬০) গতকাল শুক্রবার দুপুরে বাঁধে বসেই বঁটিতে মিষ্টিকুমড়া ফালি করছিলেন। তাঁর হাতের কাছে বস্তায় ছিল আরও বেশ কয়েকটি কুমড়া। গাঢ় হলুদ রঙের কুমড়ার ফালি দেখে জিজ্ঞেস করলে জানান, সিদ্ধ করে মিষ্টি কুমড়ার ফালি দিয়ে তিনি ইফতার করবেন। শুধু তিনিই নন, চরাঞ্চলের অভাবি পরিবারগুলো সহজে হাতের কাছে পাওয়ায় প্রথম রোজা থেকেই সিদ্ধ মিষ্টিকুমড়ার ফালি দিয়ে ইফতার করছেন। ভাতের সঙ্গে তরকারিতেও প্রতিদিন সবজি হিসেবে থাকছে এই মিষ্টিকুমড়া।
গল্পের ফাঁকে মুখে এক ফালি হাসি দিয়ে জহিরন বেওয়া বলেন, ‘এবার হামার কুমড়ায় রোজা, কুমড়ায় ঈদ। সংসারে অভাব থাকলেও এই কুমড়ার তকনে (জন্য) ভালো আচি। কুমড়ায় হামাক ভালো থুইচে।’ কুমড়া বিক্রির টাকায় রোজা ও ঈদ পার করবেন– স্বস্তির এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন তিনি।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে রোজার শুরুতে চরাঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষের সংসারে যখন চলছিল হাজারো টানাপোড়েন, ঠিক তখনই তিস্তার চরে শীতকালে আবাদ করা মিষ্টিকুমড়া তাদের ঘরে ওঠে। যাকে ঘিরে কর্মসংস্থান হয়েছে ব্যবসায়ী, শ্রমিক-মজুর, ভ্যানচালকসহ চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের। চরের উৎপাদিত কুমড়া পাল্টে দিয়েছে এলাকার অর্থনীতির চিত্র। আলুতে লোকসান হলেও বাম্পার ফলনের পাশাপাশি ভালো দাম পাওয়ায় চাষকৃত মিষ্টিকুমড়ায় রোজা-ঈদ পার করার স্বপ্ন দেখছেন এবার তিস্তার চরের মানুষ।
সরেজমিন গঙ্গাচড়ার গজঘণ্টা ইউনিয়নের ছালাপাক চর, রাজবল্লভ, লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের মহিপুর, শংকরদহ, কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা, মটুকপুরসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলে দেখা যায়, ছোট ছোট ঘরে থরে থরে সাজানো রয়েছে মিষ্টিকুমড়া। বর্তমানে কুমড়া বিক্রির টাকায় সংসার চলছে অভাবি পরিবারগুলোর। পাইকারি হিসাবে প্রতি কেজি ১২ থেকে ১৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কুমড়ার বাম্পার ফলনে স্থানীয়রা তিস্তার চরকে এখন ‘সাদা সোনার দেশ’ বলে থাকেন। অক্টোবরের প্রথম দিকে লাগানো এই কুমড়া মার্চ-এপ্রিল মাসে কৃষকদের ঘরে ওঠে। চরের ভূমিহীন পরিবারগুলো চাহিদা মেটাচ্ছেন কুমড়া চাষে। কয়েক বছর ধরে চরের আবাদ করা মিষ্টিকুমড়া দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রপ্তানি হচ্ছে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে।
চর ইছলী এলাকার বাসিন্দা রহমত আলী তিন বিঘা জমিতে কুমড়ার আবাদ করেছেন। এ পর্যন্ত ৪০ হাজার টাকার কুমড়া বিক্রি করেছেন। ঘরে থাকা কুমড়া আরও ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারবেন।
বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেল, নারী-পুরুষ মিলে শ্রমিকরা ক্ষেত থেকে কুমড়া তুলছেন। বাছাই করে তা ট্রাকে তোলা হয়। এ কাজে শ্রমিকরা প্রতিদিন ৪০০ টাকা করে পান। কুমড়া আনা-নেওয়ার কাজে ভ্যান ও ঘোড়ার গাড়িরও কদর বেড়েছে।
মহিপুর সেতুর উত্তর প্রান্তে প্রায় আধা কিলোমিটারজুড়ে প্রতিটি দোকানের সামনে স্তূপ করে রাখা হয়েছে মিষ্টিকুমড়া। খুচরা ব্যবসায়ীসহ পথচারীরা সেখান থেকে কুমড়া কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এখান থেকেই প্যাকেট হয়ে ট্রাকে সরাসরি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যাচ্ছে কুমড়া।
গঙ্গাচড়ার বিভিন্ন চরে এ বছর ১২০ হেক্টর জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষ হয়েছে। ফলনও হয়েছে ভালো। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার তিস্তার চরের প্রায় ৮০০ হেক্টর জমিতে মিষ্টিকুমড়ার আবাদ হয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব র
এছাড়াও পড়ুন:
লবণ শ্রমিকদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়
“প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে কাজ করি। লবণ তুলি, বস্তা ভরি। কিন্তু যে মজুরি পাই, তা দিয়ে এক বেলার চাল-ডালও কেনা যায় না। লবণ চাষের কাজ করলেও আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়।”
এ কথা কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার তাবলেরচর এলাকার লবণ শ্রমিক জাহেদ আলমের। হাজারো লবণ শ্রমিক দিনভর কড়া রোদে ঘাম ঝরালেও মিলছে না ন্যায্য মজুরি। নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন জাহেদ আলমের মতো শত শত লবণ শ্রমিক।
উত্তর ধুরুংয়ের লবণ চাষি রশীদ আহমদ বলেন, “এবার সাড়ে ৫ কানি জমিতে লবণ চাষ করেছি। এই বছর আবহাওয়া ভালো ছিল, উৎপাদনও হয়েছে। কিন্তু দাম পড়ে যাওয়ায় আমরা লোকসানে যাচ্ছি। প্রতিমণ লবণের উৎপাদন খরচ পড়ে ৩৫০ টাকার মতো, অথচ বিক্রি হচ্ছে ১৮০-১৮৫ টাকায়। এই লোকসান শ্রমিকদের মজুরিতেও প্রভাব পড়েছে।”
তিনি জানান, মজুরি দিতে না পারায় একদিকে শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে চাষিরাও হতাশ হয়ে পড়ছেন।
আরমান হোসেন নামে আরেক শ্রমিক বলেন, “লবণের কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। লবণের দাম কম পেলেই চাষিরা আমাদের পারিশ্রমিকের ওপর লোকসান চাপিয়ে দেয়। এতে আমরা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হই। এই অনিয়ম দূর হোক।”
চাষিরা বলছেন, একদিকে জমির ইজারা, পলিথিন, লবণ পরিবহন, শ্রমিক মজুরি-সব খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে বাজারে সিন্ডিকেট করে দাম নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রতি মণ লবণে তারা ১৭০ টাকার মতো লোকসান গুণছেন। এই লোকসানের কারণে লবণ শ্রমিকরাও দিশেহারা হয়ে পড়ছেন।
লেমশীখালীর চাষি বেলাল উদ্দিন আকাশ বলেন, ‘‘গত বছর এই সময় প্রতি মণ লবণ বিক্রি করেছি ৪৫০ টাকায়। এখন পাই ১৮৫ টাকা। এতে শ্রমিকের মজুরি দিতেও আমরা হিমশিম খাচ্ছি।”
চাষি আবুল বশর ও সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘সিন্ডিকেট করেই দাম নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে লবণ উৎপাদন কমে যায়। পরে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করার সুযোগ তৈরি হয়। অথচ এতে মাঠের হাজারো শ্রমিকের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ছে।”
মহেশখালী লবণ চাষি ঐক্য সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘‘মজুরি না পেয়ে অনেক শ্রমিক লবণের মাঠ ছাড়ছেন। এইভাবে চলতে থাকলে শ্রমিক সংকট হবে।”
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) কক্সবাজার লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, “চাষিদের ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণে উৎপাদনে অনীহা দেখা দিচ্ছে। এর ফলে শ্রমিকদেরও চাহিদা কমে যাচ্ছে। বাজারে দাম কমে যাওয়ার পেছনের কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে কক্সবাজার জেলার সদর, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় প্রায় ৬৮ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব অঞ্চলে উৎপাদিত হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ। মৌসুম শেষে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন, যা দেশের বার্ষিক চাহিদার সমান।