আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই—প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের এমন বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। শুক্রবার রাত সোয়া আটটার দিকে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের মানবতাবিরোধী অপরাধের ব্যাপারে সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক বক্তব্য থাকার পরও বিচারিক প্রক্রিয়ার ধীরগতি অত্যন্ত নিন্দনীয়।

রাজধানীর বাংলামোটরে এনসিপির অস্থায়ী কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নতুন এই রাজনৈতিক দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংঘটিত পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা হত্যাকাণ্ড, আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনে হত্যাকাণ্ড, গুম-ক্রসফায়ার, ভোট ডাকাতিসহ জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রশ্নে কার্যকর অগ্রগতি দৃশ্যমান হওয়ার আগে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পদ থেকে এ ধরনের বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত।’

প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই বলে গত বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধিদলকে জানান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

এনসিপির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সাত মাস অতিবাহিত হলেও গণহত্যাকারী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের খুনিদের বিচারে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, জুলাই মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধের শামিল। আওয়ামী লীগের মানবতাবিরোধী অপরাধের ব্যাপারে এত সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক বক্তব্য থাকার পরও বিচারিক প্রক্রিয়ার ধীরগতি অত্যন্ত নিন্দনীয়। এনসিপি অবিলম্বে জুলাই গণহত্যাসহ বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলে সংঘটিত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচারে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চায়।

নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মন্তব্য করেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। আমরা তাঁর এ বক্তব্যের নিন্দা জানাই।’

কৃত অপরাধের বিচার, দায় স্বীকার, অনুশোচনা, পাপমোচন ব্যতীত আওয়ামী লীগের দল হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকার পক্ষে যেকোনো ধরনের তৎপরতা ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনের শামিল বলে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়। আরও বলা হয়, এনসিপি জুলাই গণহত্যাসহ বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলে সংঘটিত অপরাপর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নিশ্চয়তা চায়। বিচার চলাকালে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে এবং এই মাফিয়া গোষ্ঠীর রাজনীতিতে ফেরার যেকোনো চেষ্টাকে এনসিপি প্রতিহত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে।

এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, আওয়ামী লীগ কোনো গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দল নয়; বরং এটি একটি ফ্যাসিবাদী দল। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী আমল বাংলাদেশ থেকে উৎখাত হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ এ মুহূর্তে গণতান্ত্রিক ফ্রেমওয়ার্কের বাইরে অবস্থান করছে।

লিখিত বক্তব্যের পর এক প্রশ্নের জবাবে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বা কার্যক্রম করতে পারবে কি পারবে না, এটি সম্পূর্ণই একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার কেবল সরকার, বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর এবং জনগণের। সেখানে সেনাবাহিনী কিংবা রাষ্ট্রের এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের এ বিষয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য, পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করার এখতিয়ার নেই।

আওয়ামী লীগের মতো জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধেও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, তাঁরা অনেক বেশি উদ্বিগ্ন জুলাই গণহত্যার বিচার নিয়ে। তিনি বলেন, একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যার বিচার নিয়ে এখনো প্রশ্ন আসছে। এটা পুরোনো প্রজন্মের দায় যে একাত্তরের পর এর গণহত্যার বিচারটা নিষ্পন্ন করা যায়নি, সমাধান করা যায়নি রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো। সেটি যাতে আর পুনরাবৃত্তি না হয়, এ কারণেই আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে এনসিপি কঠোর এবং বিচারটা নিষ্পন্ন দেখতে চায়।

একাত্তর থেকে সব গণহত্যার বিচার চায় এনসিপি উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, তবে রাজনৈতিকভাবে এ মুহূর্তে বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কনসার্নের (উদ্বেগের) জায়গাটা হচ্ছে আওয়ামী লীগ।

নির্বাচনের সময়ের বিষয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যে সময়সীমা দিয়েছেন, তার মধ্যে ডিসেম্বরকেই এখন প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত আরও একটা সময়সীমা দেওয়া আছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সেটাকে সমর্থন করছি। কিন্তু আমরা বলছি, এই সময়ের মধ্যেই বিচার এবং সংস্কারসহ আমরা গণপরিষদের যে দাবিটি জানিয়েছি, সেটি আসলে এই সময়ের মধ্যেই করা সম্ভব।’

‘বিক্ষোভ অব্যাহত থাকবে’

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, আরিফুল ইসলাম আদীব প্রমুখ।

আখতার হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগের বিচার এবং নিবন্ধন বাতিলের দাবিতে সারা দেশে এনসিপির নেতৃত্বে ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সে স্বপ্নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় আওয়ামী লীগ।’

সেনানিবাসে বৈঠক প্রসঙ্গ

সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন হাসনাত আবদুল্লাহ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনীতিতে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করছে কি না, কোনো প্রভাব রাখার চেষ্টা করছে কি না—বিষয়টি নিয়ে তাঁরা সন্দিহান। হাসনাত বলেন, ‘যেহেতু আমাদের সঙ্গে যে আলোচনাটি হয়েছে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক, …আমরা মনে করছি, সেটি হচ্ছে রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা। রাজনীতি রাজনীতিবিদেরাই নির্ধারণ করবেন। রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ বা চলমান যা কিছু, পরবর্তী রাজনীতি কোন দিকে যাবে, সেটি রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকা উচিত।’

সেনানিবাসে বৈঠক সম্পর্কে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘১১ মার্চের সভার প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। বর্তমানে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়া হয়েছে সেনাবাহিনীকে। ল অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশন (আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি) নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য আমাদের আহ্বান জানানো হয়েছিল।’

নিরাপত্তার ঝুঁকি অনুভব করছেন কি না, এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত ছাত্র-নাগরিক এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ রয়েছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি বোধ করছি না।’

আওয়ামী লীগ যে গণহত্যা চালিয়েছে, সেই অপরাধই তারা স্বীকার করেনি উল্লেখ করে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আগে আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধ স্বীকার করতে হবে। তারপর অন্য কোনো আলোচনা হইলে হইতে পারে। এর আগে কোনো আলোচনা হইতে পারবে না।’

আরও পড়ুনআওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফেরানোর যেকোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করা হবে: নাহিদ ইসলাম২ ঘণ্টা আগে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণহত য র ব চ র ম নবত ব র ধ অপর ধ র ব এনস প র সরক র র আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

২ মে ঢাকায় এনসিপির বিক্ষোভ, প্রচারপত্রে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ৭ অপরাধ

‘গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে’ আগামী ২ মে (শুক্রবার) রাজধানী ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করবে নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। রাজধানীর গুলিস্তানে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে এনসিপির ঢাকা মহানগর শাখার উদ্যোগে এই সমাবেশ হবে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের উদ্যোগে গঠিত দল এনসিপি।

সমাবেশ উপলক্ষে তৈরি করা প্রচারপত্রে আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলের সাতটি অপরাধের কথা উল্লেখ করেছে এনসিপি। এগুলো হলো ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহ দমনের নামে ৫৭ সেনা কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ড; গুম, খুন ও ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহরণ; ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ; ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে চালানো হত্যাযজ্ঞ; লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি, লুটপাট ও পাচার; ২০২১ সালে নরেন্দ্র মোদিবিরোধী আন্দোলনে চালানো হত্যাকাণ্ড এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় চালানো নজিরবিহীন গণহত্যা।

এরপর চারটি দাবিও উল্লেখ করা হয়েছে প্রচারপত্রে। এগুলো হলো প্রতিটি অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ট্রাইব্যুনাল বা কমিশন গঠন করে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচারের ব্যবস্থা; আগামী নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ প্রশ্নের মীমাংসা তথা আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল; বিচার চলাকালে আওয়ামী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখা এবং ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার ও তাঁদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা।

দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, সমাবেশে প্রায় ২০ হাজার মানুষের জমায়েত হতে পারে। এই সমাবেশে এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।

দলগতভাবে আওয়ামী লীগের বিচার, দলটির নিবন্ধন বাতিল ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে গত ২১ এপ্রিল থেকে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় বিক্ষোভ, সমাবেশ ও মশালমিছিল করছে এনসিপি। এর ধারাবাহিকতায় এবার কিছুটা বড় পরিসরে ঢাকা মহানগর শাখার ব্যানারে সমাবেশ হতে যাচ্ছে।

এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীন শিশির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা মহানগরের থানা পর্যায়ে কিছুদিন ধরে এনসিপির যে কর্মসূচিগুলো হচ্ছে, এগুলোরই চূড়ান্ত সমাবেশটা হবে আগামী ২ মে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ৫১ ফিলিস্তিনি নিহত
  • রাজধানীতে পরপর তিন দিনে তিন জনসমাবেশ
  • বিশ্বনেতাদের সতর্ক দৃষ্টির সামনেই ঘটছে গণহত্যা
  • ইসলামবিরোধী প্রস্তাবনা রুখে দেওয়া হবে: মামুনুল হক
  • ২ মে ঢাকায় এনসিপির বিক্ষোভ, প্রচারপত্রে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ৭ অপরাধ
  • শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে মামলা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ মির্জা ফখরুলের
  • ‘বিশ্বের নজরদারির মধ্যেই ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল’
  • রাখাইনে করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ হেফাজতের
  • ইয়েমেনে মার্কিন হামলাকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ আখ্যা দিয়ে নিন্দা ইরানের
  • নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি