দেশ বিভাগের মাধ্যমে ভারতের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, এই সত্য কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস উপলব্ধি করেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৬ জুন ‘পঙ্গু পাকিস্তান’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লেখেন, ‘...বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী ও দেশি কায়েমী স্বার্থবাদীরা বাংলার মুসলমানকে ঝাড়েবংশে ধ্বংস করিতে যে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়াছিল, সেই ষড়যন্ত্র সাফল্যমণ্ডিত হইয়াছে।’

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তিনি পূর্ব বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ধর্মীয় পরিচয়ের দৃষ্টিতে দেখতেন না, তিনি এই জনগোষ্ঠীকে একটি দরিদ্রপীড়িত, অধিকারবঞ্চিত শ্রেণি হিসেবে বিবেচনা করতেন। তাঁর চিন্তাচেতনা তৎকালীন মুসলিম লীগের উদার ও প্রগতিপন্থী রাজনৈতিক ভাবনার (আবুল হাশিম যার অন্যতম প্রবক্তা) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

১৯৫০ সালে তিনি সপরিবার ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগে সহকারী পরিচালকের চাকরি গ্রহণ করেন। তিনি সেই সময় দৈনিক সংবাদ-এর সঙ্গেও যুক্ত হন। দৈনিক সংবাদ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের ১৭ মে। এটি শুরুতে দলনিরপেক্ষ পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই তা তৎকালীন শাসক দল মুসলিম লীগের মুখপত্রে পরিণত হয়। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের রাজনৈতিক অস্তিত্ব–সংকট শুরু হয়েছিল। সংবাদ হয়ে পড়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের সমর্থক পত্রিকা।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। সংবাদ কর্তৃপক্ষ পুলিশের এই গুলিবর্ষণের পক্ষে সম্পাদকীয় লিখতে আদেশ দিলে এর প্রতিবাদে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস পত্রিকাটি থেকে ইস্তফা দেন।

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও সাহিত্য অঙ্গনে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস একটি উল্লেখযোগ্য নাম। ১৯০৬ সালের ১১ নভেম্বর রংপুর শহরের মুন্সিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করে ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর সাংবাদিকতায় রাজনৈতিক সচেতনতা, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবিক আদর্শ গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

গত শতাব্দীর ত্রিশ-চল্লিশ দশকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক কৃষক, দৈনিক নবযুগ, সাপ্তাহিক মিল্লাত, দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় আর পঞ্চাশ-ষাট দশকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক সংবাদ, পূর্বদেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস কাজ করেন। তিনি পরবর্তী সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ এবং অর্ধ–সাপ্তাহিক ধূমকেতু সম্পাদনা করেন।

কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকার অবয়বে এ দুটি পত্রিকা যথাক্রমে ১৯৫৪ ও ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয়। পরে তিনি সাপ্তাহিক যুগবাণী সম্পাদনা করেন। ১৯৫৭ সালে ইত্তেহাদ পত্রিকার মালিকানা ও নীতি পরিবর্তন হলে তিনি তাতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। আর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করার পর অক্টোবর মাসে ধূমেকতু পত্রিকা প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়।

১৯৪৫ সালের ১৬ নভেম্বর প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক মিল্লাত প্রকাশিত হয়। আবুল হাশিম ছিলেন পত্রিকার সম্পাদক। তবে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস সম্পাদনার মূল দায়িত্বে ছিলেন এবং মিল্লাত-এর সম্পাদক হিসেবেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৬ সালের ১ মার্চ থেকে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মিল্লাত-এর বৈশিষ্ট্য ছিল আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৪৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ‘দাঙ্গার পর’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে তিনি লেখেন, ‘.

..বীভৎস দাঙ্গা দেশের ইতিহাসে নয়, দুনিয়ার ইতিহাসে সম্পূর্ণ এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করিয়াছে।...ধ্বংস ও হত্যাকাণ্ডের তাণ্ডবলীলায় দেশবাসী আজ হতবাক ও সন্ত্রস্ত; আর দেশের আজাদীর সৈনিকগণ আশাহত ও বিমর্ষ...’

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ঢাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ভাষা শহীদদের মরদেহের ছবি তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

তিনি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ফটোগ্রাফার আমানুল হকের মাধ্যমে লুকিয়ে ছবি তোলার ব্যবস্থা করেন। পরে সেই ছবি ছাত্রদের প্রচারপত্রে ছাপা হয় এবং পুলিশের হাতে পড়ে বাজেয়াপ্ত হয়। এ ছাড়া ছবিটি আজাদ পত্রিকায় প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ মুহূর্তে তা ছাপা হয়নি। ১৯৭০ সালে বদরুদ্দীন উমরকে ফটোগ্রাফার আমানুল হক মরদেহের দুটি ছবি দেন, একটি শুধু মাথার অংশের, অন্যটি স্ট্রেচারে শোয়ানো অবস্থায়। এর মধ্যে প্রথম ছবিটি ১৯৫২ সালে ও পরে সাধারণভাবে প্রচারিত হয়েছিল।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। সংবাদ কর্তৃপক্ষ পুলিশের এই গুলিবর্ষণের পক্ষে সম্পাদকীয় লিখতে আদেশ দিলে এর প্রতিবাদে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস পত্রিকাটি থেকে ইস্তফা দেন।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে অসাম্প্রদায়িকতা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের মানবিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে তিনি সব সময়ই উন্নত চিন্তা ও উচ্চ চরিত্রের পরিচয় দিয়েছেন। দুই খণ্ডে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখনীতে রাজনৈতিক সচেতনতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত প্রবল। তিনি সময়ের চেয়ে অগ্রগামী একজন চিন্তক ছিলেন। তাঁর চিন্তাভাবনা আজও সমাজকে নতুনভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে।

সামিও শীশ লেখক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ১৯৫২ স ল র র জন ত ক তৎক ল ন

এছাড়াও পড়ুন:

‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নিয়ে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের পরবর্তী শুনানি বুধবার

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নিয়ে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আবেদনের (রিভিউ) ওপর পরবর্তী শুনানির জন্য আগামীকাল বুধবার দিন রেখেছেন আপিল বিভাগ। আজ মঙ্গলবার শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের বেঞ্চ পরবর্তী ওই দিন ধার্য করেন।

এর আগে গত ১৮ মে শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ শুনানির জন্য ১ জুলাই দিন ধার্য করেছিলেন। ধার্য তারিখে বিষয়টি শুনানির জন্য রিভিউ আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবীর সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ ১৫ জুলাই পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন। আজ বিষয়টি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকার ৭ নম্বর ক্রমিকে ওঠে।

ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন করে ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রায় দেন। পরে ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদধারীদের পদক্রম ওপরের দিকে রাখা ও অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়। পাশাপাশি জেলা জজদের পদক্রম আট ধাপ উন্নীত করে সচিবদের সমান করা হয়।

আপিল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতির পদক্রম এক ধাপ উন্নীত করে জাতীয় সংসদের স্পিকারের সমান এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণ করে যে মুক্তিযোদ্ধারা বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন) পদক্রমে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে উল্লেখ করা হয়।

ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তৎকালীন চেয়ারম্যান ২০১৭ সালে পৃথক আবেদন করেন। রিভিউ আবেদনে রাষ্ট্রের ৯০ জন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পক্ষভুক্ত হন। পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আবেদনের ওপর গত ২৭ এপ্রিল শুনানি শুরু হয়।

আজ আদালতে রিভিউ আবেদনকারী মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সালাহ উদ্দিন দোলন শুনানি করেন। রিট আবেদনকারী পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলদের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম শুনানিতে অংশ নেন।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরি করে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তা জারি করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে তা সংশোধন করা হয়।

সর্বশেষ সংশোধন করা হয় ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে। সংশোধিত এই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরির ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদ, সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত ও সংজ্ঞায়িত পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিচের ক্রমিকে রাখা হয়েছে—এমন উল্লেখ করে এর বৈধতা নিয়ে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মো. আতাউর রহমান ২০০৬ সালে রিট করেন।

রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট আট দফা নির্দেশনাসহ ১৯৮৬ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (সংশোধিত) অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ২০১১ সালে আপিল করে। এ আপিলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রায় দেন। এ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০১৭ সালে করা আবেদনের ওপর শুনানি চলছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আসামির কাঠগড়ায় সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের ৪৫ মিনিট
  • পরবর্তী সরকারের পক্ষে এত সহজে সংস্কার আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না: আসিফ নজরুল
  • বিসিআইসির নিয়োগ পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ
  • এলডিসি উত্তরণের পরবর্তী প্রস্তুতি নিতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন
  • ৪৪তম বিসিএস: মনোনীত প্রার্থীদের তথ্য চেয়ে পুনরায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
  • ‘আগামীর বাংলাদেশে মিডিয়াকে দালাল হিসেবে দেখতে চাই না’ 
  • ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নিয়ে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের পরবর্তী শুনানি বুধবার
  • মাইলস্টোনে দগ্ধ ৩৩ জন এখনো ভর্তি, আইসিইউতে ৩
  • শেখ হাসিনার অডিওগুলো শুনলে বোঝা যায়, তাঁর এখনো প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা আছে: আইন উপদেষ্টা
  • দ্বিতীয় প্রান্তিকে ব্র্যাক ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে