রমজানের নবীজির (সা.) অন্যতম আমল ছিল দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যার শরয়ি সমাধান বিষয়ক আসর বসানো। এ-সময় তিনি সাহাবিদের প্রশ্নের জবাব দিতেন এবং পাপ ঘটে যাওয়ার পরও তওবা করে তার কাছে সমাধানের জন্য এসেছে, তাকে তিনি ভর্ৎসনা করেননি।

আবু হোরাইরা (রা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি রমজানে স্ত্রী-সঙ্গ গ্রহণ করেছে। সে রাসুল(সা.

) কে এ-বিষয়ে সমাধান জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, তোমার কি দাস আছে? সে বলল, না। তিনি পুনরায় জানতে চাইলেন, তুমি কি দু’মাস রোজা রাখতে পারবে? সে বলল, না। রাসুল (সা.) বললেন, তাহলে তুমি ষাট জন মিসকিনকে খাবার দিয়ে দিয়ো।’ (মুসলিম, হাদিস: ১,১১১)

 একটি হাদিসে আয়েশা (রা.) রমজানে রাসুলের (সা.) কাছে আসা এমনই এক ব্যক্তির কথা বলেন। রাসুল (সা.) বললেন, তুমি সদকা কর। সাহাবি বললেন, আল্লাহর নবী, আল্লাহর শপথ, আমার কিছু নেই, আমি কিছুর মালিক নই। তিনি বললেন, তুমি বসো। সে বসে পড়ল। ইত্যবসরে এক লোক গাধার পিঠে খাবার বোঝাই করে উপস্থিত হলো। রাসুল (সা.) বললেন, কিছুক্ষণ পূর্বের আসা লোকটি কোথায়? লোকটি এসে দাঁড়ালে রাসুল (সা.) বললেন, তুমি এগুলো দিয়ে সদকা করো। লোকটি বলল, আল্লাহর রাসুল(সা.), আমি ছাড়া অন্য কাউকে দেব? আল্লাহর শপথ, আমরা ক্ষুধার্ত, আমাদের কিছুই নেই। রাসুল (সা.) বললেন, তবে তোমরাই সেগুলো খাও। (বুখারি, হাদিস: ১,৯৩৫; মুসলিম, হাদিস: ১,১১২)

আরও পড়ুন  যেমন ছিল মহানবীর (সা.) সাহরি১১ মার্চ ২০২৫

এভাবে বিভিন্ন পদ্ধতিতে তিনি সকলের সমাধান হাজির করতেন, কখনো রসিকতা করতেন, ঠাট্টাচ্ছলে তাদের সংশয় দূর করতেন। আদি বিন হাতেম (রা.)-এর বর্ণিত এক হাদিসে আমরা এর উত্তম উদাহরণ পাই। তিনি বলেন, ‘যখন কোরআনের এ আয়াত নাজিল হলো, ‘যতক্ষণ না সাদা সুতা কালো সুতা থেকে পৃথক হবে’ আমি একটি সাদা এবং একটি কালো সুতো নিলাম, (রাতে) বালিশের নীচে রেখে দিলাম। কিছুক্ষণ পর সেগুলোর দিকে তাকালাম, কিন্তু অন্ধকারে স্পষ্ট কোনো পার্থক্য দেখতে পেলাম না। বিষয়টি রাসুল (সা.) জানালে তিনি হেসে ফেললেন। বললেন, তবে তো তোমার বালিশ খুব লম্বা-চওড়া। কোরআনের এ-আয়াতের মর্ম হচ্ছে রাত ও দিন। (বুখারি, হাদিস: ১,৮১৭; আবু দাউদ, হাদিস: ২,৩৪৯)

ভিন্নভাবেও রাসুল (সা.) সাহাবিদের রমজান ও রোজা বিষয়ে সমাধান দিয়েছেন। ওমর বিন আবি সালামা (রা.)  রাসুল (সা.) কে প্রশ্ন করেন, রোজাদার কি চুমু করতে পারবে? রাসুল (সা.) তাকে বললেন, তুমি উম্মে সালামাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। উম্মে সালামা (রা.)   তাকে জানালেন, হ্যাঁ, এটুকু করা যাবে। (মুসলিম, হাদিস: ১,১০৮)

আরও পড়ুনমহানবীর (সা.) হাঁটা-চলার ধরন০৮ আগস্ট ২০২৪

ওপরের হাদিসগুলি একদিকে যেমন রমজানে রাসুলের(সা.)  শরয়ি সমাধানমূলক আলোচনার প্রমাণ দেয়, একই সঙ্গে তার সমাধান-পদ্ধতিও আমাদের শিক্ষা দেয়। মজলিশে যারা প্রশ্ন করে এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান জানতে চায়, তাদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা উচিত। প্রশ্নকারীর সঙ্গে বন্ধু ভাব বজায় রাখা, ব্যক্তির দিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যাওয়া, মনোযোগ সহকারে তার বক্তব্য শোনা, উত্তর প্রদানে সহনশীল হওয়া এবং হাসিমুখে কথা বলার মাধ্যমে মানুষের হৃদয় জয় করা যায়। এমন আচরণের ফলে যে-কোনো ব্যক্তি তার প্রয়োজনের সময় রাসুলের (সা.) আসতে দ্বিধা করতেন না।

আরও পড়ুনযেমন ছিল মহানবীর (সা.) ইফতার১০ মার্চ ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: রমজ ন করত ন বলল ন

এছাড়াও পড়ুন:

মবকে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে একে উসকে দেওয়া হয়েছে

আমাদের সমাজে মব সহিংসতা (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতা) কেন ঘটছে? অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাকে। গবেষণা পর্যালোচনায় দেখা যায়, আমাদের ইতিহাসে আগেও মব সহিংসতার ঘটনাগুলো ছিল। তবে এখন এটা চরম আকার ধারণ করেছে। নানা আকারে হচ্ছে। কারণগুলো বিস্তৃত। সাধারণভাবে আপনি-আমিও কোনো অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতে পারি। কোনো ব্যক্তি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত দেখলে সোচ্চার হতে পারি। ওই ব্যক্তিদের পুলিশের হাতে আমরা তুলে দিতে পারি। অপরাধ প্রমাণিত হলে পুলিশ ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করবে, পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সাধারণ জনগণ হিসেবে পুলিশে সোপর্দ করার দায়িত্ব পালন করা যেতে পারে। তার মানে এই নয় যে যাকে অপরাধী মনে করা হচ্ছে, তাকে গণপিটুনি দেওয়া যাবে, হেনস্তা করা যাবে, নির্যাতন করা যাবে। অথচ এই জিনিসটাই করতে দেখা যাচ্ছে। আপনি একটা মানুষকে গণপিটুনি দিতে পারেন না। আর এটা করতে গিয়ে বিভিন্ন আইনি অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত অপরাধ প্রমাণ না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ওই ব্যক্তিকে অপরাধী বা আসামিও বলা যাবে না। আমাদের সংবিধান, ফৌজদারি আইন, দণ্ডবিধি—কোনো আইনে আপনাকে মব সৃষ্টি করে কারও বিচার করার অধিকার দেওয়া নেই। মবের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বরং সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়, বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। যতগুলো মব সৃষ্টি করা হয়েছে, ততবার বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এটা কোনো নাগরিকের কাম্য নয়। এটা একধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে। রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ির সামনে বসে মব তৈরি করতে দেখা গেছে। বাসার ভেতরে গিয়ে মব তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন অফিসে হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে হতে দেখেছি। সবার আগে স্কুল-কলেজে শুরু হয়েছিল। প্রধান শিক্ষক বা জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বা প্রভাবশালী কাউকে হেনস্তা করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।

তখন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং বলা হয়েছিল, এটা মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। তাঁরা মনে করেছেন, এটা মব না, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এভাবে মবের ঘটনাকে অস্বীকার করে মবকে আরও উসকে দেওয়া হয়েছে। মবের মাধ্যমে মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছে। মানুষ ভাবছে, বিচারব্যবস্থা খুবই দুর্বল। আমি ছেড়ে দিলে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ওই ব্যক্তি (যাকে অপরাধী ভাবা হচ্ছে) বের হয়ে যাবে। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, শাস্তি হবে না। যেটা করার আমাদেরই করতে হবে। আমাদেরই বিচার করতে হবে। মানুষ মনে করছে, বৈষম্য হচ্ছে। মানসিক হতাশা থেকে মানুষ রাস্তায় নামছে। মবের ঘটনার মধ্য দিয়ে তার অবস্থান ও মানসিক হতাশা প্রকাশ করতে চায়। মবের কোনো ঘটনার বিচার হতে দেখা যাচ্ছে না। কোনোটার বিচার দৃশ্যমান না। সে জন্য আরও বেশি ঘটনা ঘটছে। প্রতিষ্ঠানগুলোও ভঙ্গুর দশায়।

মব সহিংসতার কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অনেকগুলো রাজনৈতিকভাবে পরিকল্পিত। সেগুলোকে স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা করা হয়েছে। বাসায় ঢুকে ডাকাতি করা হয়েছে। দোকান লুটপাট করা হয়েছে। পুলিশের ভূমিকাও ছিল নিষ্ক্রিয় পর্যায়ে। পুলিশ নিজেও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। দু–একটা ঘটনায় পুলিশ নিজেও মবের শিকার হয়েছে। একটি প্রতিবেদনে দেখেছিলাম, ৪৭৭ জন পুলিশ মবের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক দলে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদেরও কার্যকর ভূমিকা রাখা দরকার মব সহিংসতার বিরুদ্ধে। অনেক সময় কোনো অপরাধের অভিযোগে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে এলে মব সৃষ্টি করা হয়েছে ওই ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য। কেউ যখন দেখেন অপরাধ করলেও তাঁকে ছাড়িয়ে নেওয়া হবে, তখন ওই ব্যক্তি অপরাধ করতে আর ভয় পান না। শাস্তির ভয় থাকে না বলে অপরাধ করতে থাকেন।

আরও পড়ুন‘পানিও দিতে দেয় নাই’, মব তৈরি করে হত্যায় আসামি গ্রেপ্তার মাত্র ১.২৭%১১ ঘণ্টা আগে

মব সহিংসতা বন্ধে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিকদের উদ্যোগ নিতে হবে। মব সহিংসতার বিরুদ্ধে সরকারকে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখাতে হবে। মব সহিংসতার ঘটনাগুলোকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। মবের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে সরকার নির্দেশনা দিলে এবং সেই নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রচারের ব্যবস্থা নিলে মব সহিংসতা কমবে।

রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের আরও সচেতন হতে হবে। তাঁদের কর্মকাণ্ড মানুষ দেখছে। সামনে নির্বাচন। সব দলকে সাধারণ মানুষ পর্যবেক্ষণ করছে। কে কী ধরনের আচরণ করছেন, তা দেখা হচ্ছে। তাই রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের মব সহিংসতার মতো নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়ানো উচিত নয়। কোনো বড় রাজনৈতিক দল যদি ঘোষণা দেয় যে আজ থেকে তারা মবের সঙ্গে থাকবে না। তাহলে তৃণমূলের একজন কর্মী তাঁর পদ হারানোর ভয়ে ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ চিন্তা করে মব সহিংসতায় জড়ানোর আগে দুবার চিন্তা করবেন।

আরও পড়ুনগাইবান্ধায় চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা০২ নভেম্বর ২০২৫

বিচারপ্রক্রিয়ার ত্রুটি দূর করতে হবে। থিওরি (তত্ত্ব) বলে, মানুষ যখন দেখে সে কোনোভাবে সমাজে তার ক্ষমতার চর্চা করতে পারছে না। পাশাপাশি দেখে যে একজন অপরাধী দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো সাজার সম্মুখীন হচ্ছে না। তখন মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। বিচারে গলদ থেকে গেলে মব সহিংসতা ঠেকানো যাবে না।

গণমাধ্যম মব সহিংসতার বিরুদ্ধে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। গণমাধ্যম মব সহিংসতার নেতিবাচক প্রভাব সহজভাবে বিশ্লেষণ করে মানুষকে বোঝাতে পারে। বিষয়গুলোকে আলোচনায় আনতে হবে। সহজভাবে বোঝালে মানুষ তা গ্রহণ করবে।

আরও পড়ুনরূপলাল-প্রদীপকে হত্যায় অংশ নেয় যারা, কী বলছে পরিবার১৯ আগস্ট ২০২৫

আমি নারী হিসেবে বলব, ধর্ষক আমার কাছে সবচেয়ে বড় অপরাধী। তারপরও বলব, ভুক্তভোগীর মতো ধর্ষকেরও আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। জনগণকে মব সহিংসতাবিরোধী অবস্থানে আসতে হবে। যেকোনো কিছু হলে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে যেন মব সহিংসতা করা না হয়। সব বিষয়ে জেনে–বুঝে সুনাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে সমাজে মব সহিংসতা ঘটবে না।

শাহারিয়া আফরিন,
সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুনপুরান ঢাকায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড: নিরাপত্তাহীনতায় লাল চাঁদের পরিবার, বাড়িতে মাতম১২ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ