‘কেমন আছ তুমি’ প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না শিশুটি। তার দুই হাতের শক্ত মুঠোয় একটি স্মার্টফোন। সে খুব মনোযোগ দিয়ে কার্টুনজাতীয় একটা ভিডিও দেখছে। একটি ভিডিও শেষ হওয়ার আগেই সে চলে যাচ্ছে আরেকটি ভিডিওতে।

কেজি শ্রেণির শিক্ষার্থী এই শিশুটির বয়স সাড়ে চার বছর। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার একটি স্কুলে পড়ে সে। সকাল ৮টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত তার স্কুল। এরপর বাসায় ফিরিয়েই সে স্মার্টফোন নিয়ে বসে পড়ে।

ভিডিও দেখতে দেখতে দুপুরের খাওয়া শেষ করে শিশুটি। তবু তার ভিডিও দেখা শেষ হয় না। শিশুটি বেশির ভাগ সময় স্মার্টফোন নিয়ে থাকে। কখনো দেখে টেলিভিশন। হাত থেকে জোর করে স্মার্টফোন সরিয়ে নিতে চাইলে শিশুটি চিৎকার করে, কিংবা কান্না শুরু করে।

নাম না প্রকাশ করার অনুরোধ জানিয়ে শিশুটির মা প্রথম আলোকে বলেন, দেড় বছর বয়স থেকে সন্তানকে দাদি ও গৃহকর্মীর তত্ত্বাবধানে রেখে তাঁরা (স্বামী-স্ত্রী) কর্মস্থলে যেতেন। শিশুটিকে ব্যস্ত রাখতে স্মার্টফোন দিয়ে রাখতেন তাঁরা। সেই থেকে সন্তান স্মার্টফোনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে।

সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এই মায়ের কাছে এখন এক আতঙ্কের নাম ‘স্মার্টফোন’। শুধু তিনিই নন, আজকাল তাঁর মতো এমন পরিস্থিতিতে আছেন অনেক অভিভাবক। তাঁদের চোখের সামনেই সন্তানদের স্মার্টফোন আসক্তি ভয়ানক হয়ে উঠছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্মার্টফোন আসক্তি সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু শিশুদের মধ্যে এই আসক্তির শুরুটা হয়েছে মূলত করোনার স্থবিরতার সময়ে, যা এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেড় বছর বয়স থেকে শুরু করে নানা বয়সের শিশুরা আজকাল স্মার্টফোনে আসক্ত।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ জাতীয় প্রতিবেদন (ভলিউম ১) অনুসারে, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে ৫৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ মুঠোফোন ব্যবহার করছে। এদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে ৩০ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

বিবিএসের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আইসিটির প্রয়োগ ও ব্যবহারবিষয়ক জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৭০ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পরিবার অন্তত একটি স্মার্টফোন ব্যবহার করে। আর শহর-গ্রামনির্বিশেষে খানা পর্যায়ে (পরিবার) ইন্টারনেট ব্যবহারের হার এখন ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ।

শিশুরা মূলত অভিভাবকদের ইন্টারনেটযুক্ত ব্যক্তিগত স্মার্টফোনই ব্যবহার করছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

সম্মোহনী কায়দা

স্মার্টফোনে শিশুরা কী দেখে—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সন্তানকে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেন, এমন বেশ কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা জানান, তাঁদের সন্তানেরা মূলত ইউটিউব দেখে।

এই ভিডিও প্ল্যাটফর্মে শিশুদের জন্য আছে নানা চ্যানেল। ইউটিউবে সবচেয়ে জনপ্রিয় শিশুদের চ্যানেলের নাম ‘কোকোমেলন’। এর সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ১৯১ মিলিয়ন বা ১৯ কোটি ১০ লাখ।

চ্যানেলটির অত্যন্ত রঙিন ও চিত্তাকর্ষক ভিডিওগুলো সম্মোহনী কায়দায় শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখে। এ ছাড়া দ্রুত দৃশ্যের পরিবর্তন ও উদ্দীপক শব্দের মাধ্যমে শিশুদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনের সামনে ধরে রাখে চ্যানেলটি।

রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা নোওরিন আহমেদের দুই মেয়ে কোকোমেলনের ভক্ত। বড় মেয়ের বয়স ছয় বছর। ছোটটির বয়স দুই বছর।

নোওরিন বলেন, স্মার্টফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই একই জিনিস দেখতে থাকে তাঁর দুই মেয়ে। দুজনই যেন একপ্রকার ঘোরের মধ্যে থাকে। তারা স্মার্টফোন রাখতে চায় না। স্মার্টফোন রাখলে তারা টেলিভিশন দেখার জেদ করে।

সন্তানদের এমন অবস্থা দেখে কোকোমেলন নিয়ে গুগল করেন নোওরিন। তিনি দেখতে পান, শিশুদের মস্তিষ্কে কোকোমেলনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে অনেক তথ্য ইন্টারনেটে আছে। এরপর স্মার্টফোন ও টিভিতে কোকোমেলন চ্যানেল ‘ব্লক’ করে দেন তিনি।

এদিকে সারা দিন অনলাইনে নানান ভিডিও দেখে তিন বছরের এক শিশু। সে অস্পষ্ট এক ভাষায় কথা বলে। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, আরবি—এমন কয়েকটি ভাষার নানান শব্দ মিলিয়ে সে একেকটি বাক্য বলে। শিশুটির মা বলেন, ইউটিউবে নানান ভিডিও দেখে দেখে এই অবস্থা হয়েছে সন্তানের।

সন্তান ইউটিউবে কী দেখবে, কী দেখবে না—এর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেন অভিভাবকেরা। তবে শিশুদের জন্য বিশেষ অ্যালগরিদমে তৈরি ‘কিডস ইউটিউব’-এর যে চ্যানেলগুলো আছে, সেগুলোর বেশির ভাগের অবস্থা কোকোমেলনের চেয়ে খুব একটা নিরাপদ নয়।

পাঁচ বছর বয়সী এক শিশুর মা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাসার ওয়াইফাই লাইনে ঝামেলা হলে সন্তান নানানভাবে বিরক্ত করে। ইউটিউব দেখার জন্য জেদ করে। সন্তানের এই মুঠোফোন আসক্তি কমানোর জন্য আজকাল প্রায়ই বাসার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে।

স্মার্টফোন, টেলিভিশন, ট্যাব ইত্যাদি ব্যবহারের পেছনে যে সময় ব্যয় হয়, তাকে বলা হয় ‘স্ক্রিন টাইম’। শিশুবিশেষজ্ঞদের দেওয়া বৈশ্বিক নির্দেশিকা অনুসারে, দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের সকল প্রকার স্ক্রিন থেকে দূরে রাখতে হবে। ২ থেকে ৫ বছর বয়সীদের জন্য তা দৈনিক এক ঘণ্টার বেশি নয়। ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের জন্য স্বাভাবিক স্ক্রিন টাইম দুই ঘণ্টা।

কিন্তু ২০২৩ সালের একটি আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা গেছে, ৮ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের দৈনিক স্ক্রিন টাইম গড়ে ৬ থেকে ৯ ঘণ্টা। একই জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪৭ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন যে তাঁদের সন্তানের স্মার্টফোন আসক্তি রয়েছে।

সমসাময়িক কোনো গবেষণা না থাকলেও এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে আজকাল স্মার্টফোন ব্যবহার করছে আট বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুরাও। এমনকি জন্মের পরপরই আজকাল স্মার্টফোনে সঙ্গে পরিচয় ঘটে শিশুর। সন্তানকে খাওয়ানোর সময়, ব্যস্ত কিংবা শান্ত রাখতে মা–বাবারাই প্রথম শিশুর হাতে স্মার্টফোন তুলে দেন। তখন শিশুও শান্ত হয়। গভীর মনোযোগে স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে সে কাটিয়ে দেয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এটা দেখে মা-বাবাও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচেন।

ছয় বছর বয়সী এক মেয়েশিশুর বাবা প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম দিকে বাচ্চাকে শুধু খাওয়ানোর সময় মুঠোফোন দেখতে দেওয়া হতো। কিন্তু এখন তাঁরা আর তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। সুযোগ পেলেই ফোনের জন্য বায়না করছে মেয়ে।

মেয়ের সামনে তাঁরা দুজন (স্বামী-স্ত্রী) ফোন ব্যবহার করেন কি না, জানতে চাইলে তিনি ‘না’ সূচক জবাব দেন।

ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড অ্যাডিকশনে ২০২৪ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা তাদের মা-বাবার আচরণ পর্যবেক্ষণ ও অনুকরণ করে। তাই মা-বাবার মধ্যে কারও স্মার্টফোন আসক্তি থাকলে সন্তানও স্মার্টফোন আসক্ত হতে পারে। তবে আরও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, প্রথম দিকে অনেক মা-বাবা সন্তানের এই আসক্তি বিষয়টি ধরতে পারেন না কিংবা দেখেও খুব একটা গুরুত্ব দেন না। তাঁরা যত দিনে বিষয়টি বুঝতে পারেন, তত দিনে দেরি হয়ে যায়।

বেশি ক্ষতিগ্রস্ত স্কুলপড়ুয়ারা

সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সুবাদে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে হচ্ছে অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে। বিভিন্ন অনলাইন গেম ছাড়াও নতুন কোনো গান বা ভিডিও—সবকিছু সম্পর্কে তাকে অবগত থাকতে হয়। না হলে সহপাঠীদের সঙ্গে মিশতে তার অসুবিধা হয়।

এই স্কুলশিক্ষার্থীর বাবা বলেন, পাঁচ বছর আগে করোনার সময় স্কুলের অনলাইন ক্লাসের জন্য সন্তানকে ট্যাব কিনে দিয়েছিলেন। এর পর থেকে কখনো একটানা আবার কখনো একটু পরপর ট্যাব দেখছে সন্তান। রাগ করে অনেকবার ট্যাব আটকেও রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু তখন সন্তান অস্থির হয়ে যায়।

হাতে মুঠোফোন না থাকার ফলে সৃষ্ট এই আচরণকে বলা হয় ‘নোমোফোবিয়া’ বা ‘নো মোবাইল ফোন ফোবিয়া’। বড়দের পাশাপাশি শিশুদের মধ্যেও এই প্রবণতা দেখা যায়।

তা ছাড়া ইন্টারনেটে নানা রকম বুলিংয়ের শিকার হতে হয় স্কুলপড়ুয়া শিশুদের। তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমান নাম ‘বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়’) ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্মার্টফোন ব্যবহারকারী ৫৯ শতাংশ শিশু-কিশোরেরা অনলাইনে সাইবার বুলিং ছাড়াও নানা রকম যৌন ও শাব্দিক হেনস্তার শিকার হয়। এটি তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত করে।

স্কুলশিক্ষার্থীদের মধ্যে স্মার্টফোন আসক্তির ভয়াবহতার কথা জানিয়ে রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকার একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, কিছু শিশুর অবস্থা এতটাই খারাপ যে তাদের জন্য ‘শ্যাডো টিচার’ বা ‘ছায়া শিক্ষক’ রাখা হয়েছে। এই শিক্ষকেরা স্মার্টফোনে আসক্ত শিশুদের বিশেষ যত্ন নেন। এতে শিশুরা উপকৃতও হচ্ছে। কিন্তু অভিভাবকেরা যদি সন্তানের মুঠোফোন দেখা কমাতে না পারেন, তাহলে এই সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।

বিশেষজ্ঞের মতামত

স্মার্টফোন আসক্তিকে মানসিক রোগ হিসেবে বর্ণনা করে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমত এটি একধরনের আচরণগত সমস্যা। তবে স্মার্টফোন যদি কারও স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন করে, মানসিকভাবে অস্থির করে তোলে, তাহলে অবশ্যই এটি মানসিক রোগ।

আজকাল পরিবারগুলো ছোট হয়ে আসছে উল্লেখ করে শামসুল আহসান বলেন, প্রয়োজনের খাতিরেই পরিবারের সব সদস্যকে বাইরে কাজ করতে হচ্ছে। শিশুরা বড় হচ্ছে একা একা। বাইরে মাঠ নেই, ঘুরতে যাওয়ার জায়গা নেই। সব মিলিয়ে শিশুদের সময় কাটছে স্ক্রিনে। এভাবেই মুঠোফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছে শিশুরা। পরবর্তী সময়ে এই শিশুদের ভুগতে হচ্ছে নানান দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যায়।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, স্মার্টফোন আসক্তির কারণে দুই-তিন বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ‘স্পিচ রিগ্রেশন’ দেখা দিচ্ছে। অর্থাৎ এই শিশুরা বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছে না। বর্তমানে এ ধরনের শিশুর সংখ্যা অনেক। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় স্মার্টফোন আসক্ত শিশুরা। মাথাব্যথা, মাইগ্রেন হওয়ার পাশাপাশি কমে যায় দৃষ্টিশক্তি। ফলাফল—১০ বছরের নিচে অনেক শিশুকেই চশমা পরতে হচ্ছে। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে এক জায়গায় শুয়ে-বসে মুঠোফোন দেখার কারণে শিশুরা সাধারণত স্বাভাবিক নড়াচড়া ও খেলাধুলা করে না। ফলে স্থূলতা, ইটিং ডিজঅর্ডার (খাবারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা), ইনসমনিয়া (নিদ্রাহীনতা) ইত্যাদি সমস্যাও দেখা দেয়। যা দীর্ঘমেয়াদি ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ, কিডনির রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি নানা রকম স্বাস্থ্যগত জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এই শিশুরা তারুণ্যে পৌঁছায় নানা মানসিক ও শারীরিক রোগ নিয়ে, যা তাদের সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়।

মাহমুদুল হক চৌধুরী আরও বলেন, মা-বাবার কাছে নানা বিষয় শেখার বয়সে স্মার্টফোন ধরা শিখছে শিশুরা। এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে? ফলে স্মার্টফোনে আক্রান্ত সন্তানদের চিকিৎসার জন্য শরণাপন্ন হন অভিভাবকেরা। কিন্তু সমাধান তো অভিভাবকদের হাতেই।

অভিভাবকেরা যা করবেন

শিশুদের স্মার্টফোন আসক্তি থেকে সুরক্ষা দিতে অভিভাবকদের জন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ। এগুলো হলো—

শিশুর হাতে স্মার্টফোন দেওয়া থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকুন।

শিশুর সামনে অভিভাবক বা শিশুর যাঁর তত্ত্বাবধানে থাকে, তাঁরাও ঘন ঘন স্মার্টফোন ব্যবহার করবেন না। কারণ, শিশুরা যা দেখে, তা–ই অনুকরণ করে।

শিশুকে খাওয়ানোর জন্য, শান্ত রাখার জন্য তার হাতে স্মার্টফোন দেওয়া বন্ধ করতে হবে। স্মার্টফোন, ট্যাব ইত্যাদি না দিয়ে শিশুকে বই দিন, খেলনা দিন।

সন্তান স্মার্টফোন আসক্ত হয়ে পড়লে তার থেকে হঠাৎ জোর করে তা সরিয়ে নেবেন না। প্রথমে সময় ফোন দেখার সময় বেঁধে দিন। তাকে অন্য কাজ দিন। ধীরে ধীরে তার স্ক্রিন টাইম কমিয়ে আনুন।

শিশুকে রঙিন গল্পের বই দিন। রংতুলি দিন। নাচ বা গান শেখান। কারাতে বা তায়কোয়ান্দো শিখতে দিন। তাকে নিয়ে গাছ লাগান। এতে শিশুর একটি শখের জায়গা তৈরি হবে, যা তাকে যেকোনো আসক্তি থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ফ ন ব যবহ র কর বছর বয়স দ র ব যবহ র করছ প রথম আল ক ফ ন আসক ত দ র জন য পর ব র র স মন এই শ শ র সময় আজক ল সমস য অবস থ বছর র র একট

এছাড়াও পড়ুন:

নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

নিয়োগপত্র নেই। এ কারণে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। দেওয়া হয় না পরিচয়পত্র। নেই কর্ম ঘণ্টার হিসাব। তবে রয়েছে মজুরিবৈষম্য ও জীবনের ঝুঁকি। এ চিত্র খুলনার বরফকলে কর্মরত বরফ শ্রমিকদের।

অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত বরফকলের শ্রমিকেরা জানেন না মে দিবসের অর্থ। তারা শুধু এটুকু জানেন, কাজ থাকলে মজুরি পাবেন, অন্যথায় জুটবে না কিছু। খুলনার নতুন বাজার, রূপসা, শিপইয়ার্ড ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বরফ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ঝুঁকি ও বৈষম্যের এই চিত্র।

সরেজমিনে জানা গেছে, লবণ পানি এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংমিশ্রণে বরফের প্রতিটি ক্যান তৈরি হয়। এ কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যুসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এছাড়াও অধিকাংশ সময় হাত-পা ভিজে ঠান্ডা থাকায় ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। এর বাইরে বুকে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় ভোগেন এখানকার শ্রমিকেরা। পাতলা বরফে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। কিন্তু মালিক বা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের অ্যাপ্রোন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন না। তবে দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

আরো পড়ুন:

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মহান মে দিবস: শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কারে জোর সরকারের

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার, নিউমার্কেট, শিপইয়ার্ড, রায়েরমহল এবং রূপসা উপজেলার পূর্ব রূপসা এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি বরফকল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাজার ও পূর্ব রূপসায় সর্বাধিক বরফকল রয়েছে। এসব কলে গড়ে দশ জন হিসেবে দেড় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।

রূপসার নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত ‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করেন মোহাম্মদ রাসেল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি হলেও পরিবার নিয়ে রূপসার জাবুসা এলাকায় বসবাস করেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই বরফকলে কাজ করছেন তিনি। রাসেল জানান, তাদের মাসিক বেতন নেই। নেই নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র। মূলত উৎপাদনের উপর প্রতি পিস বরফের ক্যান অনুযায়ী ১২ টাকা হারে মজুরি পান। নামমাত্র এ মজুরিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে সংসার ঠিকমতো চলে না।

‘‘তিন বছর আগে নির্ধারণ করা মজুরি এখনো চলছে। লোকসানের অজুহাতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে চান না। তাদের মতো শ্রমিকদের কোন বেতন-বোনাস নেই। নো ওয়ার্ক, নো পে অর্থাৎ কাজ থাকলে মজুরি আছে কাজ না থাকলে নেই। মালিকদের এ সিদ্ধান্ত না মানলে চাকরিও থাকে না।’’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন রাসেল হোসেন।

একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘গড়ে প্রতিমাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা মজুরি পাই। কিন্তু মাসিক খাবার খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া বাবদ ৩ হাজার টাকা চলে যায়।’’

তবে জাকির হোসেন ব্যাচেলর হওয়ায় কারখানার মধ্যেই থাকেন। বিয়ের পর এ কাজ করার ইচ্ছা নেই বলে জানান তিনি।

বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১-এ অপারেটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ সেলিম শেখ। তার জন্ম নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা হলেও কর্মসংস্থানের কারণে রুপসার বাগমারা গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি জানান, বর্তমান বয়স ৮৪। ২০ বছর বয়স থেকেই বরফ কারখানার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হেলপার হিসেবে ২৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অপারেটর হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে সবসময় উৎপাদন না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা কারখানায় থাকতে হয়। ছুটি পান না।

‘অ্যামোনিয়া গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। তবে তিনি কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি বলে জানান তিনি।

‘মায়ের দোয়া আইস এন্ড কোল্ড স্টোরেজে’র শ্রমিক জাকারিয়া হাওলাদার বলেন, ‘‘চার বছর বরফকলে কাজ করছি। চাকরির ভবিষ্যৎ নেই। শ্রম দিতে পারলে মজুরি হয়, না হলে হয় না। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেন না মালিকপক্ষ। বেতন বাড়ানোর কথা বললে তারা আমলে নেন না।’’

একই এলাকার ‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করছেন মোঃ মুন্না গাজী ও মোঃ হাসান শেখ। তারা নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তারা দুজনেই মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই।

‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’র ম্যানেজার আশিকুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদাসীন। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার মাঝেমধ্যেই লিক হয়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৩২টি আইস উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। ছয়জন শ্রমিক কাজ করে বলে জানান তিনি।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ- ২'র ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘বরফের মূল ক্রেতা চিংড়ি ও সাদা মাছের ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ ও দোকানে শরবত বিক্রেতারাও কারখানা থেকে বরফ কিনে নেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের ৬ মাস চাহিদা থাকে এবং কিছুটা লাভের মুখ দেখা যায়। তবে শীত মৌসুমের ছয় মাস বরফের চাহিদা কম থাকে। তখন কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি দিয়ে লোকসান গুণতে হয়।’’

জামাল উদ্দিন স্বীকার করেন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও তা এড়াতে কোন সরঞ্জাম নেই। তবে অপারেটরদের অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে মাক্স সরবরাহ করা হয়।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১'র মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রিয়াদ-উল-জান্নাত সৈকত বলেন, ‘‘ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। কখনো লাভ, কখনো লোকসান এভাবেই চলছে। গত বছর কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’’

তবে লাভ হলে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিষয়ে শ্রমিকদের সংগঠন রূপসা বেড়িবাঁধ হ্যান্ডলিং শ্রমজীবী ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রিপন শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি বরফকলের ৪০ জন শ্রমিক তাদের ইউনিয়নের সদস্য। বিগত দেড় বছর আগে মজুরির সমস্যা নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুই একজন শ্রমিক অভিযোগ করলে ইউনিয়নের মাধ্যমে সেটির সমাধান করে দেন তারা। কিন্তু বর্তমানে অভিযোগ নিয়ে কেউ আসে না।’’

বরফকলের শ্রমিকদের নিয়ে তারা মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ