ভারতের রাজধানী দিল্লির ঐতিহাসিক জামে মসজিদে অত্যন্ত নিঃশব্দে প্রশংসিত কাজ করে চলেছেন সনাতন ধর্মের এক তরুণী। রমজান মাসে প্রতি সন্ধ্যায় রোজাদারদের জন্য ইফতারের খাবার তৈরি থেকে শুরু করে বিতরণও করছেন নেহা ভারতী নামে ওই তরুণী।

মাথায় দোপাট্টা ও সবুজ রঙের সালোয়ার কামিজ পরিহিত নেহা অন্য সব ধর্মের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আন্তরিকতার সাথে খাবার বিতরণ করছেন। হাসিমুখে নেহা বলছেন, ‘‘আমি এটাকে দান-খয়রাত হিসেবে দেখি না। এভাবেই আমি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে চাই। হিন্দুরা মুসলমানদের সাহায্য করতে পারে, আবার মুসলমানরাও পারেন। ভারতে এটাই আমি বিশ্বাস করি।’’ 

গত তিন বছর ধরে নেহা প্রতিদিন সন্ধ্যায় জামে মসজিদে খাবারের প্যাকেট ও শরবত নিয়ে আসছেন। প্রথমে মাত্র কয়েক খাবারের প্যাকেট দিয়ে এই উদ্যোগ শুরু করেছিলেন। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় এই খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে তার উদ্যোগে গতি আসে। এখন প্রতিদিন প্রায় কয়েক শতাধিক মানুষের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করেন। 

পুরাতন দিল্লির বাসিন্দা এবং ‘রাহ্’ নামক একটি এনজিও-র প্রতিষ্ঠাতা নেহা এমন একটি পরিবারে বেড়ে ওঠেন, যারা কখনও হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বৈষম্য করে না। তিনি যখন প্রথম লক্ষ্য করেন যে, কীভাবে রোজাদাররা ইফতারের খাবারের জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন, তখনই নতুন কিছু করার চিন্তাভাবনা করেন। 

নেহা বলেন, ‘‘তিন বছর আগে আমি দেখেছিলাম যে বহু রোজাদার খাবার ছাড়াই জামে মসজিদে ইফতার করতে আসছেন। তখন আমি ভেবেছিলাম, কেন তাদের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা শুরু করা হবে না? প্রাথমিকভাবে, আমার ক্ষমতা খুবই সীমিত ছিল। কিন্তু বন্ধুবান্ধব ও সোশ্যাল মিডিয়ার সহায়তায় আমি এই কর্মকাণ্ড আরো প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছি। এখন আমরা রমজান মাসে প্রতিদিন ইফতারের খাবার পরিবেশন করি।’’ 

আর নেহার প্রচেষ্টাই তাকে জামে মসজিদে সুপরিচিত ও জনপ্রিয় করে তুলেছে। স্থানীয়দের পাশাপাশি ওই মসজিদে যেসব দর্শনার্থী আসেন তারা সকলেই নেহার সঙ্গে সেলফি তোলার পাশাপাশি তার কাজের প্রশংসা করছেন। 

বর্তমান প্রেক্ষিতে যেখানে প্রায়শই ধর্মীয় বিভাজন তুলে ধরা হয়, সেখানে নেহার এই উদ্যোগ বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। শান্তি, ভ্রাতৃত্ব এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার দিকটি সুকৌশলে তুলে ধরছেন নতুন প্রজন্মের নেহা। 

তার অভিমত, আজকাল চারিদিকে যে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ছে, তা আমাকে খুবই পীড়া দেয়। আমি দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের আগের ভালোবাসা ফিরিয়ে আনতে চাই। ভারত তার ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য পরিচিত। আমি সেই চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। 

ইতোমধ্যেই নেহার এই ‘মিশন’ বহু মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। নেহার এই উদ্যোগ যাদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে তার মধ্যে অন্যতম উত্তর প্রদেশের বেরিলির বাসিন্দা গুলাব বানো। ইফতারের জন্য প্রতিদিন জামা মসজিদে আসা গুলাব জানান, এই উত্তেজনার মুহূর্তে একজন হিন্দু নারীকে মুসলমানদের ইফতারের খাবার দিতে দেখাটা সত্যিই হৃদয় ছুঁয়ে যায়। একটা মানুষ কীভাবে পরিবর্তন আনতে পারেন নেহা সেটা দেখিয়েছেন। জামা মসজিদে দাঁড়িয়ে তিনি একা রোজাদারদের ইফতারি দিয়ে যাচ্ছেন। 

গাজিয়াবাদে কর্মরত মুজাফফরনগরের ৩৫ বছর বয়সী নওশাদও নেহার এই নিষ্ঠার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘‘একটা ছোট কোণে আমি একজন মহিলাকে খাবার বিতরণ করতে দেখেছিলাম। প্রথমে আমি কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। আবার যখন জানতে পারি যে সে একজন হিন্দু, তখন আমি আরো বেশি অবাক হয়েছিলাম। আজকের সময়ে, যেখানে এত ঘৃণা ও বিদ্বেষ সেখানে নেহা ভালোবাসা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি এমন একটা কাজ করছেন, যা অনেকেই করার সাহস করে না।’’ 

নেহার এই কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে উভয় সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাসেবকরাই তার এই মিশনে যোগ দিতে আগ্রহী হয়েছেন। অনেকেই এখন ইফতারের খাদ্য বিতরণের জন্য আর্থিক অনুদান বা অন্য সহায়তা প্রদানের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। 

তবে নেহার দৃষ্টিভঙ্গি আরো বিস্তৃত। তার মূল স্বপ্ন, জামা মসজিদের আশপাশে যারা গৃহহীন ও জীবনধারণের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের জন্য একটি বৃদ্ধাশ্রম খোলা।

সে বলেন, ‘‘প্রতিদিন আমি বয়স্কদের রাস্তায় ঘুমাতে দেখি। আমার স্বপ্ন হল তাদের জন্য একটি আশ্রয়স্থল তৈরি করা। এমন একটা জায়গা হবে যেখানে তারা মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারে। এটাই আমার পরবর্তী লক্ষ্য।’’ 

ঢাকা/সুচরিতা/এনএইচ 

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইফত র র খ ব র দ র জন য ন হ র এই করছ ন মসজ দ

এছাড়াও পড়ুন:

খুলনায় এক মাসে ১৩ লাশ উদ্ধার, বাড়ছে উদ্বেগ

বাড়িতে ঝগড়া চলছিল বড় ভাই ও ভাবির। ছোট ভাই এসে ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মাথায় শাবল দিয়ে আঘাত করেন। মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ধারালো বঁটি দিয়ে ছোট ভাইকে হত্যা করেন। পরে বড় ভাই শহিদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি এখন কারাগারে। ঘটনাটি ঘটেছে গত ৩০ মে, খুলনার কয়রা উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের উলা গ্রামে।

এর আগে ২৭ মে কয়রার ইসলামপুর গ্রামের কয়রা নদীর চর থেকে শিকলে বাঁধা অবস্থায় আবদুল মজিদ (৬২) নামের এক বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ছাড়া ৮ জুন কয়রার কাছারিবাড়ি বাজার-সংলগ্ন পুকুর থেকে নমিতা (৪০) নামের এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়।

১০ জুন কয়রা সদরের গোবরা সড়কে এক ভ্যানচালকের সঙ্গে এক মোটরসাইকেলচালকের কথা-কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে দুই গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হন অন্তত ১৫ জন। ঘটনায় ১২ জনকে আসামি করে থানায় মামলাও হয়েছে। এ ছাড়া কথা-কাটাকাটির জেরে কয়রার পল্লীমঙ্গল গ্রামে গত তিন দিনে কয়েক দফা মারামারি, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

অসন্তোষ-দ্বন্দ্বের জেরে কয়রা উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় হত্যা–সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। ১০ মে থেকে ৯ জুন পর্যন্ত এক মাসে খুলনার ১০টি থানা এলাকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনাসহ ১৩টি লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে।

কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান কমে যাওয়ায় মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। মূল্যবোধ ও ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব ও ভালোবাসা কমে যাচ্ছে। এতে খুনখারাবি বাড়ছে। একসময় সমাজের একজনের ভালোতে সবাই আনন্দ পেতেন। নেতিবাচক দিকগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতেন। এখন সেই ব্যবস্থা উঠেই গেছে বলা যায়। পাশাপাশি রাজনৈতিক আধিপত্যের লড়াইয়ে প্রভাববলয় সৃষ্টি করতেও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।

৩ জুন খুলনা শহরে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে সবুজ হাওলাদার (৩০) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়। ৪ জুন খুলনা সদর থানার মতিয়াখালী খালের মধ্যে আটকে ছিল এক নারীর মরদেহ। পরে পুলিশ গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে। ওই নারীর পরিচয় না পেয়ে বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুলে দাফন করা হয়। গত ৯ জুন বিকেলে রূপসা উপজেলার আঠারোবেকী নদীতে পাওয়া যায় অজ্ঞাতনামা যুবকের মরদেহ। মরদেহের শ্বাসনালিতে গভীর ক্ষতচিহ্ন ছিল। রূপসা নৌ পুলিশের ওসি আবুল খায়ের বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি হত্যাকাণ্ড।

এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে রহস্য উদ্‌ঘাটন ও অপরাধী শনাক্তে দীর্ঘসূত্রতার কারণেই অপরাধ বেড়ে চলেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মানবাধিকার ব্যুরোর কয়রা উপজেলা শাখার সভাপতি তরিকুল ইসলাম। তাঁর ভাষ্য, প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত শেষে দোষীদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে। আইনি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধ বেড়ে চলেছে।

কয়রা উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুলী বিশ্বাস বলেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনায় এলাকার মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়ছে, এটা ঠিক। তবে প্রতিটি ঘটনায় পুলিশও তাৎক্ষণিকভাবে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যে বিষয়গুলো পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধের মধ্য দিয়ে সমাধান করা যায়, সেখানে খুনাখুনি, অস্থিরতা, মামলা-হামলার মধ্য দিয়ে একধরনের বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে; যা সবার জন্যই অকল্যাণকর ও ভয়ানক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ