কয়েক মাস ধরে রাজধানীর পান্থকুঞ্জ পার্ক ধ্বংসের প্রতিবাদ করা হচ্ছে। এ পার্ক রক্ষায় উন্নয়নকর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও মিডিয়াও সরব। ঢাকার আরও দুটি পার্কের অবস্থা একই রকম। আমাদের এই পার্কগুলোর ধ্বংস কী বার্তা বহন করে?
প্রথমেই আসি বহুল আলোচিত পান্থকুঞ্জ পার্ক ধ্বংসের একটি পর্যালোচনায়। প্রথম দিকে এই পার্কের উন্নয়ন করার লক্ষ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন একটি বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করে। তার পরও যে পার্কের খুব একটা উন্নতি হয়েছে, তা বলা যাবে না। তবে মন্দের ভালো। পরবর্তী সময়ে যখন এই পার্কটি সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তখন তারা জানতে পারল, এই পার্কের ভেতর দিয়ে উড়াল সড়কের একটি র্যাম্প যাবে। অর্থাৎ পার্কটি আর জনসাধারণের ব্যবহারের উপযোগী থাকল না। কেননা, এটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যের একটি অংশ হয়ে গেল।
ঢাকার আরও একটি পার্ক হলো শহীদ আনোয়ারা পার্ক। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পার্কটি মেট্রোরেল স্থাপনার কারণে ধ্বংসের পথে। প্রথম দিকে এখানে মেট্রোরেলের নির্মাণসামগ্রী রাখা হতো। কিন্তু মেট্রোরেলের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরই আবার জানা গেল, এখানে একটি বহুতল শপিংমল নির্মাণ করা হবে, যাতে মেট্রোরেলের খরচ বহন করা যায়। একটা বিষয়ে মিল রয়েছে– পান্থকুঞ্জ পার্ক এবং শহীদ আনোয়ারা পার্কের উভয় স্থানই ব্যবহৃত হবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম হিসেবে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমাদের যোগাযোগ উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়েছেন, এখানে আর কোনো কাজ করা হবে না। তবুও আশঙ্কা
থেকেই যায়!
পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কও ভালো নেই। সেখানে বাণিজ্যিক স্থাপনা হিসেবে খাবারের দোকান নির্মাণ করার অনুমতি হয়েছে। সিটি করপোরেশনের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছিল পরিবেশবাদীদের পক্ষ থেকে। তার পরও এখানে সেই বাণিজ্যই!
শহীদ আনোয়ারা পার্ক ও বাহাদুর শাহ পার্কের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। ১৯৬৯ সালের ২৫ জানুয়ারি, গণঅভ্যুত্থানের দ্বিতীয় দিন। ঢাকার নাখালপাড়ার ৪৮৪ নম্বর বাসায় চার মাসের শিশুসন্তান নার্গিসকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলেন মা আনোয়ারা বেগম। এমন সময় পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ বাহিনীর বুলেট টিনের বেড়া ভেদ করে আনোয়ারা বেগমের গায়ে বিদ্ধ হয় এবং তিনি নিহত হন। এই ঘটনাকে এবং তাঁকে স্মরণে রাখতেই মাঠটিতে ‘আনোয়ারা বাগান’ নামে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে এটি ‘আনোয়ারা মাঠ’ নামে পরিচিতি পায়। এভাবে বাহাদুর শাহ পার্কেরও একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। ১৮৫৭ সালের ‘সিপাহি বিপ্লব’-এর সময় বেশ কয়েকজন বিপ্লবীকে এখানে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দিল্লির শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহর নামে পার্কটির নামকরণ করা হয়।
ঢাকার এই তিনটি পার্ক ধ্বংসের বিষয়ে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাব, প্রতিটি স্থানের পেছনে অর্থ ও মুনাফা জড়িয়ে আছে। এখানে প্রাণ-প্রকৃতি, ইতিহাস অথবা সবুজের যেন মূল্য নেই। আমাদের এই পুঁজিভিত্তিক সমাজে তারা চিন্তা করেন, মানুষ ফুলের গন্ধ নেবে না; নেবে সুগন্ধি। পার্কের সবুজ দেখবে না; দেখবে শপিংমলের আলো। পাখির ডাক শোনার কোনো প্রয়োজন নেই; গাড়ির হর্নই হচ্ছে জীবনের অংশ। তাই তো পার্ক নামক উন্মুক্ত স্থান ধ্বংস করার এত আয়োজন।
আমরা যদি এভাবে পার্ক ধ্বংস করে চলি, তাহলে ভবিষ্যতে এমন একটা প্রজন্ম পাব, যারা শুধু মুনাফার কথা চিন্তা করবে। তাদের কাছে প্রকৃতি, সবুজ, জীববৈচিত্র্য এবং মানবিকতা বলে কিছুই থাকবে না। তাই আর নয় পার্ক হত্যা।
তালুকদার রিফাত পাশা: পলিসি কর্মকর্তা, ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবিং বাংলাদেশ
rifatir2@gmail.
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নিয়ে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের পরবর্তী শুনানি বুধবার
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নিয়ে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আবেদনের (রিভিউ) ওপর পরবর্তী শুনানির জন্য আগামীকাল বুধবার দিন রেখেছেন আপিল বিভাগ। আজ মঙ্গলবার শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের বেঞ্চ পরবর্তী ওই দিন ধার্য করেন।
এর আগে গত ১৮ মে শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ শুনানির জন্য ১ জুলাই দিন ধার্য করেছিলেন। ধার্য তারিখে বিষয়টি শুনানির জন্য রিভিউ আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবীর সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ ১৫ জুলাই পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন। আজ বিষয়টি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকার ৭ নম্বর ক্রমিকে ওঠে।
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন করে ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রায় দেন। পরে ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদধারীদের পদক্রম ওপরের দিকে রাখা ও অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়। পাশাপাশি জেলা জজদের পদক্রম আট ধাপ উন্নীত করে সচিবদের সমান করা হয়।
আপিল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতির পদক্রম এক ধাপ উন্নীত করে জাতীয় সংসদের স্পিকারের সমান এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণ করে যে মুক্তিযোদ্ধারা বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন) পদক্রমে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে উল্লেখ করা হয়।
ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তৎকালীন চেয়ারম্যান ২০১৭ সালে পৃথক আবেদন করেন। রিভিউ আবেদনে রাষ্ট্রের ৯০ জন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পক্ষভুক্ত হন। পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আবেদনের ওপর গত ২৭ এপ্রিল শুনানি শুরু হয়।
আজ আদালতে রিভিউ আবেদনকারী মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সালাহ উদ্দিন দোলন শুনানি করেন। রিট আবেদনকারী পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলদের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম শুনানিতে অংশ নেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরি করে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তা জারি করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে তা সংশোধন করা হয়।
সর্বশেষ সংশোধন করা হয় ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে। সংশোধিত এই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরির ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদ, সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত ও সংজ্ঞায়িত পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিচের ক্রমিকে রাখা হয়েছে—এমন উল্লেখ করে এর বৈধতা নিয়ে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মো. আতাউর রহমান ২০০৬ সালে রিট করেন।
রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট আট দফা নির্দেশনাসহ ১৯৮৬ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (সংশোধিত) অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ২০১১ সালে আপিল করে। এ আপিলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রায় দেন। এ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০১৭ সালে করা আবেদনের ওপর শুনানি চলছে।