সিনেমা– পর্দায় চোখ রেখে অন্য কোথাও হারিয়ে যাওয়া এক অনুভবের নাম। গল্প, চরিত্র, গানসহ নানা উপকরণের মিশেলে যে সিনেমা নির্মিত হয়, তা নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে দর্শক মনে। দর্শক কখনও কান্নায় বুক ভাসান, কখনও হাসতে হাসতে তাদের পেটে খিল ধরে যায়; কোনো গল্প আবার তলিয়ে দেয় ভাবনার অতলে। যে কারণে কোনো কোনো সিনেমার গল্প, চরিত্র কিংবা নির্মাণ মনে এতটাই ছাপ ফেলে যে মন- অন্দর থেকে ভেসে আসে আরেকবার দেখার আহ্বান। তেমনই প্রিয় কিছু সিনেমা নিয়ে কথা বলেছেন এ সময়ের দর্শক-শ্রোতার প্রিয় চার শিল্পী.
হাবিব ওয়াহিদ
দু’জন প্রতিবন্ধী মানুষ; যাদের একজন কথা বলতে ও শুনতে পারে না, অন্যজন তারুণ্যে পা রেখেও স্বভাব শিশু রয়ে গেছে। প্রতিবন্ধী সেই দু’জন মানুষ যখন বন্ধু হয়ে ওঠে, নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একে অপরের সহায় হয়, তখন বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। বলিউড পরিচালক অনুরাগ বসুর ‘বরফি’ সেই সিনেমা, যেখানে এমনই এক গল্প উঠে এসেছে। যেখানে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া আর রণবীর কাপুর দু’জনে প্রতিবন্ধী চরিত্রে ছিলেন অনবদ্য। আমি বলব, এটা তাদের অভিনয় ক্যারিয়ারের সেরা এবং ব্যতিক্রমী কাজ। বাঙালি বেশভূষায় ইলিয়ানাকে যেভাবে আবিষ্কার করেছি, সেভাবে আগে ও পরে তাকে কখনও দেখিনি। এই তিন শিল্পীর পাশাপাশি সৌরভ শুক্লার অভিনয়ের প্রশংসাও না করলেই নয়। ‘বরফি’র প্রতিটি চরিত্র পর্দায় এমনভাবে তুলে আনা হয়েছে যে, তাদের কাউকে অভিনেতা-অভিনেত্রী বলে মনে হয়নি। এ কারণেই যতক্ষণ পর্দায় চোখ আটকে ছিল, ততক্ষণ অন্য এক জগতে ভ্রমণের স্বাদ পেয়েছি। যাদের দেখছি, তারা এই পৃথিবীর বাসিন্দা ঠিকই, কিন্তু তাদের জীবনের গল্পটা ধরা দিয়েছে অন্য সবার চেয়ে আলাদাভাবে। এক জীবনে অনেক সিনেমা দেখেছি। কিন্তু ‘বরফি’ যেভাবে মনে আঁচড় কেটেছে, যে অনুভব এনে দিয়েছে, তা ক’টি সিনেমা দিতে পেরেছে, বলা কঠিন।
বিদ্যা সিনহা মিম
অনেক নামের মধ্য থেকে ‘আমার আছে জল’ সিনেমার কথাই বলতে চাই। অভিনেত্রী হিসেবে এটি যেমন আমার পছন্দের একটি কাজ, তেমনি দর্শক হিসেবে সিনেমাটি আমার চোখে সেরা। আপনারা ভাবতেই পারেন, নিজের প্রথম সিনেমা বলে এটাকেই প্রিয় তালিকায় সবার ওপরে রেখেছি। হ্যাঁ, এটি সত্যি, ‘আমার আছে জল’ সিনেমার মধ্য দিয়ে বড় পর্দায় অভিষেক হয়েছে। কিন্তু সেটাই ভালো লাগার প্রধান কারণ নয়। কারণ এই সিনেমায় অভিনয়ের অনেক আগেই এর কাহিনি মনে দারুণভাবে ছাপ ফেলেছিল। এক কথায় ‘আমার আছে জল’ নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অনবদ্য এক সৃষ্টি। তাই এই উপন্যাস নিয়ে সিনেমা বানানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। আমাকে দিলু অর্থাৎ দিলশাদ চরিত্রের জন্য নির্বাচন করা হয়, তখন বিষয়টা ছিল আমার কাছে অন্য রকম আনন্দের। শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা কখনও ভুলতে পারব না। সে যাই হোক, এই সিনেমা কেন এত প্রিয়, সেটাই বলি। কাহিনির কথা তো বললাম, চরিত্রের প্রসঙ্গে আসি। খেয়াল করলে দেখবেন, সিনেমায় দিলুর পাশাপাশি জামিল, সাব্বির, নিশাতসহ প্রতিটি চরিত্রের মাঝেই আছে চেনাজানা মুখের ছায়া। তাদের কথাবার্তা, চলাফেরা থেকে শুরু করে প্রতিটি ঘটনা আমাদের যাপিত জীবনের সঙ্গে সহজেই কানেক্ট করে নেয়। তারপরও হুমায়ূন আহমেদের গল্প বলার ধরন ছিল অন্য সবার চেয়ে আলাদা। এটাই হলো তাঁর সিনেমার বড় শক্তি।
ন্যান্সি
প্রিয় সিনেমার সংখ্যা তো অনেক। কোনো সিনেমা গল্পের কারণে, কোনোটা আবার শিল্পীদের অনবদ্য অভিনয়ের জন্য প্রিয়। আবার কিছু সিনেমা আছে, দেখা শুরু করলে এক মুহূর্তের বিরতি না দিয়ে দেখতে থাকি। “বেবি’স ডে আউট” তেমনই একটি সিনেমা। বহুবার দেখেছি, তারপরও দেখার ইচ্ছা এতটুকু কমেনি। নাব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম যখন সিনেমাটা দেখি, তখন এর অভিনেতা-অভিনেত্রী কারও নামই সেভাবে জানা ছিল না। শিশুতোষ সিনেমা বলে শুরুতে দেখার আগ্রহ জন্মেনি। কিন্তু সবাই যখন দল বেঁধে দেখা শুরু করি, তখন দেখলাম কাহিনি থেকে এক মহূর্তের জন্য সরে আসতে পারছি না। নিষ্পাপ একটি শিশুর অপহরণ হয়ে যাওয়া এবং অদ্ভুত উপায়ে অপরাধীদের ডেরা থেকে তার বেরিয়ে আসার কৌশল দারুণভাবে চমকে দিয়েছিল। এর চেয়ে মজার বিষয় হলো, অনেকটা নির্ভাবনায় শিশুটি ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ অপহরণকারীরা তাকে কিছুই করতে পারছে না; উল্টো তারা এমনভাবে নাস্তানাবুদ হচ্ছে, যা দেখে হাসি থামিয়ে রাখা কঠিন। হাসির ছলে এই সিনেমায় একটা মেসেজও দেওয়া হয়েছে, তা হলো– অপরাধী যত বড়ই হোক, নিষ্পাপ সরল মানুষের কাছে তারা পরাজিত হতে বাধ্য।’ “বেবি’স ডে আউট”-কে আমি বিশ্ব সিনেমার একটি মাস্টারপিস হিসেবেই উল্লেখ করতে চাই। এমন আরও কয়েকটি সিনেমা আছে, যেগুলো বারবার দেখতে ইচ্ছা করে। সেসব সিনেমা নিয়ে না-হয় আরেকদিন কথা হবে।
তাসনিয়া ফারিণ
‘ছুটির ঘণ্টা’ হলো সেই সিনেমা, কৈশোরে যা ভাবনার জগৎ এলোমেলো করে দিয়েছিল। কিছুটা ট্রমাটাইজ হয়ে গিয়েছিলাম খোকার পরিণতি দেখে। বারবার মনে হতো, আমার সঙ্গেও যদি এমন কিছু ঘটে যায়, তখন কী হবে? খোকা যেভাবে স্কুলের বাথরুমে আটকা পড়েছিল, নানা রকম লড়াই, সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছিল– তা দেখে ভীষণ কান্না পেয়েছে। একইভাবে এই কিশোর যখন তার বন্দি হয়ে পড়ার খবর নানা উপায়ে অন্যদের জানানোর চেষ্টা করছে এবং সব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে, তা দেখে আমরাও ভয়ে শিহরিত হয়ে পড়েছি। বুকে কান্না জমেছে। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখার অভিজ্ঞতা ছিল না বলেই সিনেমাটি মনে দাগ কেটেছিল। রাজ্জাক, শাবানা, সুজাতা, শিশুশিল্পী সুমন থেকে শুরু করে বাকি সবার অভিনয় এতটাই বাস্তব হয়ে উঠেছিল যে ‘ছুটির ঘণ্টা’ সিনেমা নয়, কোনো বাস্তব ঘটনার দৃশ্য বলেই মনে হয়েছিল। সিনেমা হিসেবে এটি অনবদ্য, এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
গানের ভুবনে লিজার অন্তহীন পথচলা
শীর্ষ তারকা হওয়ার দৌড়ে কখনও অংশ নিতে দেখা যায়নি তাঁকে। যদিও ২০০৮ সালে ‘ক্লোজআপ ওয়ান: তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় সেরা শিল্পীর মুকুট মাথায় উঠেছিল, তবু ধীরলয়ে পথ হেঁটে গেছেন। নিজের কাজে অতিমাত্রার উচ্ছ্বাসও দেখাননি কখনও। নীরবে নিভৃতে কাজ করে গেছেন সবসময়। গানে গানে কুড়িয়ে চলেছেন শ্রোতার ভালোবাসা। এ কারণে সমসাময়িকদের চেয়ে আলাদা করে তাঁকে চিনে নেওয়া যায়। বলছি, কণ্ঠশিল্পী সানিয়া সুলতানা লিজার কথা। গানের ভুবনে অন্তহীন পথচলায় যিনি এরই মধ্যে পেরিয়ে এসেছেন প্রায় দেড় যুগের পথ। সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার রহস্যটা কী? শুরুতে যখন এ প্রশ্ন লিজার সামনে তুলে আনা হলো, তখন দেখা গেল, লিজা নিজেই এর উত্তর খুঁজতে বসে গেছেন। এ পর্যায়ে হেসে বললেন, ‘না, এর উত্তর সত্যি জানা নেই। আসলে আমি তো গান গাই শ্রোতার প্রত্যাশা পূরণ আর ভালোবাসা কুড়ানোর জন্য। হ্যাঁ, শিল্পীসত্তাকে খুশি রাখতে গানের চর্চা ধরে রেখেছি বললে ভুল হবে না। তারপরও প্রতিটি আয়োজনে শ্রোতার ভালোলাগা, মন্দলাগাকে প্রাধান্য দিয়েছি। এতে করে কতটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি। সেই জনপ্রিয়তা শুরু থেকে একই রকম আছে কিনা– সেটি তো শ্রোতারা ভালো বলতে পারবেন।’ লিজার এ কথা থেকে বোঝা যায়, যাদের কারণে শিল্পীজীবন বেছে নেওয়া, সেই শ্রোতা তাঁর দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। সেখানে তাঁর গানগুলো ছিল চালিকাশক্তি। তবে ১৭ বছরের সংগীতের এ পথচলায় লিজার কণ্ঠে মেলোডি গান বেশি শুনতে পাওয়া গেছে। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই দেড় যুগে নানা ধরনের গান গেয়েছি, তবু কেন জানি শ্রোতারা আমাকে মেলোডি গানের শিল্পীদের দলে রেখে দিয়েছেন। অস্বীকার করব না যে, আমার কণ্ঠে যে ধরনের গান ভক্তরা বেশি শুনতে চান, সে ধরনের গান বেশি গাই। এটিও ঠিক যে, মেলো কিংবা স্যাড-রোমান্টিক গানের প্রতি শ্রোতার ভালোলাগা সবসময় ছিল। এখনও অনেকে মেলোডি ছাড়া গানের কথা ভাবতে পারেন না। এজন্য নিরীক্ষাধর্মী কাজ করলেও আমি চাই না মেলোডি থেকে কখনও দূরে সরে থাকতে। তাই মেলোডি গান যেমন গাইছি, তেমনি গানের নিরীক্ষাও চালিয়ে যাচ্ছি।’ লিজার এ কথা যে মিথ্যা নয়, তা সর্বশেষ প্রকাশিত গানগুলোর শুনলে প্রমাণ মেলে। ক’দিন আগে বিটিভির ‘বৈঠকখানা’ অনুষ্ঠানে ক্লোজআপ ওয়ান তারকা মুহিনের সঙ্গে গাওয়া ‘তোমার নামে’ গানে যে লিজাকে শ্রোতা আবিষ্কার করবেন, তার সঙ্গে মেলানো কঠিন হবে সামজ ও রিজানের সঙ্গে ‘তিতা কথা’ গানের লিজাকে। আরেকটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ‘খুব প্রিয় আমার’, ‘তুমি এলে’, ‘পূর্ণিমা চাঁদ’ গানগুলোয় লিজা অতীতের গায়কীকে ছাপিয়ে কীভাবে আরও নতুন হয়ে নিজ কণ্ঠ তুলে এনেছেন।
মাঝে কিংবদন্তি শিল্পীদের বেশ কিছু কালজয়ী গানের রিমেকে কণ্ঠ দিয়েও প্রশংসা কুড়িয়েছেন সংগীতবোদ্ধাদের। স্টেজ শো, রেডিও, টিভির আয়োজন থেমে শুরু করে সিনেমার প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে প্রমাণ দিয়েছেন, তিনি অন্যদের চেয়ে কোনোভাবে পিছিয়ে নন। এককথায়, বহমান সময়টিকে সুরেলা করে রেখেছেন অনিন্দ্য কণ্ঠ জাদুতে।
আগামীতেও লিজার কণ্ঠ বাতাসে ভেসে বেড়াবে– এ অনুমান করা যায়।