Samakal:
2025-04-21@05:54:53 GMT

শুটিংয়ের অন্দরে

Published: 27th, March 2025 GMT

শুটিংয়ের অন্দরে

বড় বাজেটের সিনেমা, তারকাদের ঝলমলে উপস্থিতি, ক্যামেরার ঝলকানি—এ সবই পর্দায় দর্শক দেখেন। কিন্তু এর পেছনে থাকে একগাদা গল্প, হাসির মুহূর্ত, দুঃখ, ক্লান্তি আর কখনও কখনও ছোটখাটো দুর্ঘটনা। সিনেমার শুটিং মানেই একটা আলাদা দুনিয়া, যেখানে বাস্তবের সঙ্গে পর্দার জীবনের প্রতিনিয়ত লড়াই চলে। দুই নির্মাতার শুটিংয়ের অন্দরের গল্প লিখেছেন মীর সামী

অমিতাভ রেজা
সিনেমা বানানোটা কখনোই শুধু ক্যামেরা অন করে শট নেওয়া নয়, একটি স্বপ্নের মতো, যেটি ধীরে ধীরে বাস্তব হয়। ‘আয়নাবাজি’ আমার কাছে শুধুই একটি সিনেমা নয়, এটি একটি সময়, একটি অনুভূতি, একটি শহরের গল্প, যেখানে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা একে অপরের আয়নায় প্রতিফলিত হয়। আমি সবসময় চেয়েছি এমন একটি সিনেমা বানাতে, যেটি আমাদের শহরকে অন্যভাবে দেখাবে। ঢাকা শহর, তার রহস্য, তার মানুষ– এসব মিলিয়েই ‘আয়নাবাজি’। সিনেমার মূল চরিত্র আয়না– যে একজন মাস্টারমাইন্ড অভিনেতা, কিন্তু তার মঞ্চ সিনেমার পর্দায় নয়, বরং বাস্তব জীবন! এই চরিত্রটা যখন গুছিয়ে উঠল, তখনই মনে হলো, এবার কাজটি শুরু করা দরকার। আমাদের সিনেমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ঢাকার আসল রূপ ধরা। আমি চাইনি কৃত্রিম সেট বানিয়ে শুটিং করি, বরং চাইছিলাম সত্যিকারের ঢাকা শহরটি ক্যামেরায় তুলে আনতে। আমরা পুরান ঢাকার অলিগলি ঘুরতে শুরু করলাম। একেকটা জায়গায় ঢুকলেই মনে হতো, ‘এটিই হতে পারে আয়নার দুনিয়া!’ পুরান ঢাকার সরু গলি, শত বছরের পুরোনো বাড়ি, রাস্তার পাশে চায়ের দোকান–এ সবকিছু মিলে আয়নার গল্পের বাস্তবতা তৈরি হলো।
আমার মনে আছে, ‘আয়নাবাজি’র শুটিংয়ের সময় একটি দৃশ্য ছিল যেখানে চঞ্চল (চঞ্চল চৌধুরী) ধীর পায়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসবে, খুবই স্টাইলিশ শট। সব রেডি। আমি বললাম, ‘অ্যাকশন!’
চঞ্চল হাঁটতে শুরু করল। ঠিক তখনই, পাশের রাস্তায় একটা ভ্যানওয়ালা জোরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই যে আপনেরা শুটিং করতাছেন, এইডা নাটক না সিনেমা?’
ক্যামেরার ফ্রেমে চঞ্চল, সঙ্গে ভ্যানওয়ালার মাথা!
আমি চিৎকার দিয়ে বললাম, ‘কাট! ভাই, একটু চুপ করবেন?’
ভদ্রলোক একদম অবাক হয়ে বললেন, ‘আরে ভাই, আমি তো মাইক্রোফোন পাই নাই, কেমনে চুপ করমু?’
আমরা সবাই হেসে উঠলাম। শুটিং বন্ধ রেখে তাঁকে বুঝিয়ে বিদায় দিলাম।
যাই হোক। সিনেমার সবচেয়ে বড় শত্রু হলো রিটেক।
একটি দৃশ্য পারফেক্ট করতে কতবার যে রিটেক দিতে হয়, তার হিসাব নেই।
একবার একটি সংলাপ ছিল, যেখানে চঞ্চলকে বলতে হবে— ‘মানুষ আয়না দেখে নিজেকে চেনে, কিন্তু আমি?’
ডেলিভারি একটুর জন্য পারফেক্ট হচ্ছিল না। চারবার শট নিলাম। পাঁচবার নিলাম। দশবার নিলাম।
অবশেষে চঞ্চল বলল, ‘দেখেন, আমি আয়নায় তাকিয়ে আগে নিজেকে চিনে নিই, তারপর সংলাপ বলি!’
শুটিং সেটে হাসির রোল উঠল।
‘অ্যাকশন সিন’ বিপদের আরেক নাম
একটা দৃশ্যের কথা ভুলতেই পারি না। সিনেমার ক্লাইম্যাক্স শুট করছি। চঞ্চলকে ছাদ থেকে নিচে নামতে হবে। সব ঠিকঠাক, ক্যামেরা রেডি, স্টান্ট টিম প্রস্তুত।
‘অ্যাকশন!’
চঞ্চল ঝাঁপ দিল।
কিন্তু ভুলটা হলো অন্য জায়গায়– নিচে সেফটি ম্যাট ঠিকমতো রাখা হয়নি!
আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি, চঞ্চল হাসছে, বলছে, ‘ভাই, আমি বেঁচে আছি, কিন্তু একটু ব্যথা পেয়েছি!’
এই জন্যই আমি বলি, সিনেমা বানানো মানেই শুধু গল্প বলা নয়, বরং একটা যুদ্ধে নামা।
‘শেষ দিন, শেষ হাসি’ সিনেমার শুটিংয়ের শেষ দিনটা সবসময় অদ্ভুত এক অনুভূতি দেয়। সবাই ক্লান্ত, কিন্তু বিদায়ের মন খারাপও থাকে। সেদিন সেটে সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে, লাইট প্যাকিং হচ্ছে, ক্যামেরা খুলে নেওয়া হচ্ছে। চঞ্চল, নাবিলা, পার্থদা সবাই বসে আছেন, ক্লান্ত কিন্তু খুশি।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।
একজন এসে বলল, ‘ভাই, আরেকটি টেক নেবেন?’
আমি একটু হেসে বললাম, ‘না, এবার আসল সিনেমার জন্য অপেক্ষা করা যাক!’
সিনেমা বানানো অনেক কষ্টের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পর্দায় যখন সেটি দেখা যায়, তখন মনে হয়—এই যুদ্ধটা জেতাই ছিল আসল আনন্দ!

মেজবাউর রহমান সুমন
আমি জানতাম, ‘হাওয়া’ সহজ কোনো ছবি হবে না। সমুদ্রের গল্প মানেই অনিশ্চয়তা, আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই তো সবচেয়ে সুন্দর গল্পগুলো লুকিয়ে থাকে। প্রথম থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বাস্তবের কাছাকাছি যেতে হলে আমাদের সত্যিকার অর্থেই সমুদ্রে নামতে হবে। কিন্তু গভীর সমুদ্রে শুটিং করা যে এতটা কঠিন হবে, সেটি কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল একদল স্বপ্নবাজ মানুষকে নিয়ে। চঞ্চল ভাই, নাসির ভাই, রাজ, আর পুরো টিমকে নিয়ে আমরা গভীর সমুদ্রে রওনা দিলাম একটি ফিশিং ট্রলারে। ধীরে ধীরে মোবাইল নেটওয়ার্ক মিলিয়ে গেল, তীরে ফেলে আসা শহরের আলোও দূরে হারিয়ে গেল। আমাদের সামনে শুধু জলরাশি, মাথার ওপর বিশাল আকাশ। শুটিং শুরুর আগেই মনে হলো, আমরা একটি নতুন পৃথিবীতে এসে পড়েছি। প্রথম কয়েক ঘণ্টা সবার মধ্যে রোমাঞ্চ ছিল। তারপরই শুরু হলো আসল চ্যালেঞ্জ। ঢেউয়ের ধাক্কায় শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখা যাচ্ছিল না, শুটিং তো দূরের কথা, সোজা হয়ে দাঁড়ানোই কঠিন হয়ে পড়ল। ট্রলারের একটানা দুলুনি, খাবারের সীমাবদ্ধতা, মোবাইল নেটওয়ার্কের অনুপস্থিতি– সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত মানসিক পরীক্ষার মধ্যে পড়লাম আমরা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সি-সিকনেস। একেকজন খাবার খেয়েই বমি করে দিচ্ছিল।
সাগরে শুটিং মানে প্রতিদিন একরকম নতুন যুদ্ধ। কখনও ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই, কখনও সূর্যের প্রচণ্ড তাপ, কখনও আবার হঠাৎ ঝড়। এর মধ্যেও কিছু ঘটনা আছে, যা কখনও ভুলব না।
প্রথম দিন: সমুদ্রের আসল রূপ
আমরা তখন গভীর সমুদ্রে শুটিং করছি। ছোট্ট একটি ট্রলারে পুরো ইউনিট, ক্যামেরা সেট, লাইট, সবকিছু। প্রথম দিনেই আমি বুঝলাম, এখানে কোনো কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই।
‘অ্যাকশন!’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ঢেউ এলো। পুরো ট্রলার দুলে উঠল। ক্যামেরা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, টেকনিশিয়ানরা ঝাঁপিয়ে গিয়ে ক্যামেরা সামলালো।
আমি তখনই বুঝলাম, এই সিনেমাটি আমাদের নয়, এটি সমুদ্রের, ওর মর্জির ওপরই সব নির্ভর করছে!
সিনেমার সবচেয়ে কঠিন দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি ছিল– চঞ্চল চৌধুরী [চান মাঝি] আর অন্য শিল্পীদের ট্রলারের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা। সাগরের মধ্যে ট্রলার এমনভাবে দুলছিল যে মনে হচ্ছিল, যেকোনো সময় কেউ পড়ে যাবে।
চঞ্চল ভাইকে বললাম, ‘ভাই সাবধানে, আপনার ভারসাম্য রাখতে পারবেন তো?’
তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘আমি তো মাঝি, পানির ছেলে, আমার ভয় কী?’

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: অ য কশন আম দ র প রথম বলল ম সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

প্রতিবন্ধী নারীর অনন্য পাঠশালা

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের বন্যাবাড়ি গ্রাম। এ গ্রামে এক সাহসী নারীর হাত ধরে গড়ে উঠেছে অসাধারণ এক পাঠশালা। শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও দারিদ্র্য, প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক সীমাবদ্ধতা জয় করে শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন জয়ন্তী রায়।
৪০ বছর বয়সী জয়ন্তীর জীবন কখনও সহজ ছিল না। তিনি কুঁজো, সোজা হয়ে চলতে পারেন না। ঝুঁকে চলতে হয়। এই প্রতিবন্ধকতার কাছে কখনও তিনি মাথা নিচু করেননি। এসএসসি পাস করেও অর্থাভাবে কলেজে যেতে পারেননি। কৃষক হরিচাঁন রায়কে বিয়ে করে আরও কঠিন এক সংসার জীবন শুরু হয়। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে টানাপোড়েনের সংসারে এক দিন সিদ্ধান্ত নেন– শুধু নিজের জীবনের উন্নতি নয়, এলাকার শিশুদেরও পড়াতে হবে।
বাড়ির উঠানের এক গাছতলায় মাত্র ১০ জন শিশুকে নিয়ে শুরু হয় তাঁর পাঠশালা। শিশুপ্রতি মাসে ৩০০ টাকা করে নিলেও অনেকেই দিতে পারত ৫০ বা ১০০ টাকা। কিন্তু অর্থ নয়, জয়ন্তীর মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া। ঝড়-বৃষ্টি এলে গাছতলার পাঠশালা সরিয়ে নেওয়া হতো পাশের মন্দিরে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মঈনুল হক বন্যাবাড়ি গ্রামে একটি রাস্তার কাজ পরিদর্শনে গিয়ে দেখে ফেলেন এই অনন্য পাঠশালা। এর পর থেকেই বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট। ইউএনও জয়ন্তীকে বলেন, অভিভাবকদের কাছ থেকে আর কোনো টাকা নিতে হবে না। উপজেলা অফিস থেকে তাঁর সম্মানী দেওয়া হবে।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা করে পেয়েছেন জয়ন্তী। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে তাঁর পাঠশালাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের মন্দিরভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমে। এখন জয়ন্তী প্রতি মাসে পাচ্ছেন ৫ হাজার টাকা সরকারি বেতন। পাশাপাশি ইউএনওর উদ্যোগে টিআর প্রকল্পের 
আওতায় ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে একটি টিনশেড পাঠশালা। লাগানো হয়েছে তিনটি বৈদ্যুতিক পাখাও। জয়ন্তীর বিদ্যালয়ে এখন ৩০ জন শিশু পড়াশোনা করছে।
স্থানীয়রা জানান, এক সময় রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে শিশুদের পাঠ নিতে হতো। এখন সুন্দর ঘরে বিনামূল্যে চলছে পাঠদান।
অভিভাবক শিউলী বিশ্বাস ও সবিতা রায় বলেন, জয়ন্তীর পাঠশালায় তাদের ছেলেমেয়েরা অনেক ভালোভাবে পড়াশোনা করছে। আগে যা কল্পনাও করতে পারেননি তারা। দারিদ্র্যের কারণে তারা অনেকেই শিশুদের পড়ানোর জন্য জয়ন্তীকে টাকা দিতে পারতেন না। ইউএনওর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তারা বলেন, তিনি পাঠশালার 
জন্য একটি ঘর ও জয়ন্তীর পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখন বিনা বেতনে এ পাঠশালায় তাদের ছেলেমেয়েরা 
পড়াশোনা করছে।
নিজেই এক সময় আলো থেকে দূরে সরে পড়া জয়ন্তী এখন অন্যদের জন্য বাতিঘর হয়ে উঠেছেন। তিনি বলেন, ‘কোনোদিন ভাবিনি আমার মতো একজন প্রতিবন্ধী নারীও এভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে। ইউএনও স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ, যিনি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। যতদিন বাঁচি, ততদিন শিশুদের শিক্ষা দিয়ে যাব।’
টুঙ্গিপাড়ার ইউএনও মঈনুল হক বলেন, এটি একটি অনন্য পাঠশালা। জয়ন্তী যা করেছেন, তা এ সমাজের জন্য দৃষ্টান্ত। এ পাঠশালার শিশুদের জন্য একটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। গ্রীষ্মের গরমে শিশুদের কষ্টের কথা ভেবে প্রশাসন থেকে তিনটি পাখার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। জনকল্যাণে উপজেলা প্রশাসন এমন কাজ চালিয়ে যাবে বলে জানান তিনি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রতিবন্ধী নারীর অনন্য পাঠশালা
  • মাথা ঘোরার সমস্যা হলে কেন চেকআপ করা জরুরি
  • বেলা শেষের যাত্রী
  • বিমুখতা নয়, সচেতনতা