বিদায়লগ্নে মহিমান্বিত রমজান মাস। আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা যে রমজান আমাদের কাছে এসেছিল, এখন আমাদের কাছ থেকে কী বার্তা নিয়ে ফিরে যাচ্ছে তা ভেবে দেখা মুমিনের দায়িত্ব। রমজানে মহান আল্লাহ দয়া ও অনুগ্রহ করে আমাদের তাঁর নৈকট্য ও ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার যে অবকাশ দিয়েছিলেন তা কি আমরা আদৌ কাজে লাগাতে পারলাম, না কি অবহেলা আর অযত্নে কেটে গেল স্বর্ণপ্রসূ সময়টুকু? নিজের আমলের এই হিসাব গ্রহণকে ইসলামের পরিভাষায় বলা হয় মুহাসাবা বা আত্মপর্যালোচনা ও আত্মজিজ্ঞাসা।
সুফি আলেমরা বলেন, আত্মশুদ্ধি ও আত্মোন্নয়নের আত্মপর্যালোচনা অপরিহার্য। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাআলা মুমিনদের আত্মপর্যালোচনার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উচিত আগামীকালের জন্য (পরকাল) সে কী প্রেরণ করেছে, তা চিন্তা করা। আর তোমরা তাদের মতো হইয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে, ফলে আল্লাহ তাদের আত্মভোলা করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা ফাসিক।’ (সুরা হাশর, আয়াত : ১৮)
তাই মুমিনের আত্মভোলা হয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.
আরো পড়ুন:
মহিমান্বিত কদরের রাতে ইবাদত ও প্রার্থনা
ঈদের কেনাকাটায়ও আসুক সংযম
ইসলামের মহান খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলতেন, ‘তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গ্রহণের আগেই তোমরা নিজেদের হিসাব গ্রহণ করো। তোমাদের আমলনামা ওজন করার আগেই তোমরা নিজেদের আমল ওজন করে দেখো। পরকালে হিসাব দেওয়ার চেয়ে পার্থিব জীবনে হিসাব দেওয়া তোমাদের জন্য সহজ। তোমরা সেই দিনের প্রস্তুতি গ্রহণ করো যেদিন তোমাদের জীবনের সব কিছু পেশ করা হবে এবং কোনো কিছু গোপন থাকবে না।’ (মুসনাদুল ফারুক : ২/৬১৮)
পবিত্র রমজানের বিদায়লগ্নে মুমিনের জীবনে আত্মজিজ্ঞাসা আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কেননা কোরআন ও হাদিসে যেমন রমজান মাসে আল্লাহর দয়া ও দান অবারিত হওয়ার ঘোষণা রয়েছে, তেমনি তাতে যেসব মানুষের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে যারা রমজান মাসেও আল্লাহবিমুখ। যেমন নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তির নাক ধুলাধূসরিত হোক, যে রমজান পেল এবং তার গুনাহ মাফ করার আগেই তা বিদায় নিল।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৪৫)
চিন্তার বিষয় হলো, আমরা আমাদের গুনাহগুলো ক্ষমা করাতে পারলাম কি না? পাপ মার্জনার জন্য যতটা বিনীত হয়ে ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাওবা করতে হয় তা আমরা করেছি কি না? গুনাহ মাফের শর্ত হলো গুনাহ পরিহার করা। রমজানে আমরা গুনাহ ত্যাগ করেছিলাম কি? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এই যে মাস (রমজান) তোমরা লাভ করেছ তাতে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি তার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো। আর হতভাগ্য ব্যক্তিই কেবল তার কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৬৩৪)। সুতরাং রমজানের বিদায়লগ্নে মুমিনের আত্মজিজ্ঞাসার বিষয় হলো, কদরের রাত আমাদের নসিব হলো কি না? হলে কি আমরা লাভবান হলাম নাকি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হলাম?
রমজানের শেষভাগে আমরা যেন রমজানের গুরুত্ব ও মর্যাদার কথা ভুলেই যাই। আমরা বাজার-সদাই, কেনাকাটা ও আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে যাই। অথচ পূর্বসূরী আলেমরা রমজানের শেষভাগে আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত হতেন। রমজানের শেষভাগে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলতেন, ‘আমাদের মধ্যে কার রোজা কবুল হলো, আমরা তাঁকে অভিনন্দন জানাব এবং কে বঞ্চিত হলো তাঁর জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করব। হে সৌভাগ্যবান, যার রোজা কবুল হয়েছে তোমাকে অভিনন্দন এবং হে হতভাগা, যার রোজা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে আল্লাহ তোমার পাপ মার্জনা করুন।’ (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ২১০)
রমজান মাসে সিয়াম সাধনার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য আল্লাহভীতি অর্জন করা। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রমজান মাসের রোজাকে ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বসূরীদের ওপর যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)
সুতরাং রমজানের শেষভাগে এসে একজন মুমিনের অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে, সে কতটা আল্লাহভীতি অর্জন করতে পারল। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা করার পর যদি মুমিনের অন্তরে আল্লাহর ভয় তথা পাপের ব্যাপারে ভয় এবং পুণ্যের প্রতি আগ্রহ না তৈরি হয়, তবে তার রোজাকে ফলপ্রসূ বলার সুযোগ আছে কি?
পবিত্র রমজানের একটি উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির স্বভাব-চরিত্রের উন্নতি। ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের ভেতর যেসব দোষ-ত্রুটি রয়েছে সেগুলো থেকে মুক্ত হওয়া। যেমন পরনিন্দা, পরচর্চা, হিংসা, বিদ্বেষ, বিবাদ ইত্যাদি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)
মুমিনের আত্মজিজ্ঞাসা হলো আমাদের স্বভাব-চরিত্র কতটা কলুষমুক্ত হলো। যদি সেটা নাই হয়, তবে আমরা তো সেসব মানুষের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলাম যাদের ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কত রোজাদার এমন, যাদের রোজা ক্ষুধা-পিপাসা ছাড়া আর কিছুই না এবং কত তাহাজ্জুদ আদায়কারী এমন, যাদের তাহাজ্জুদ রাত জাগরণ ছাড়া আর কিছু না।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস : ২০১৪)
প্রশ্ন হলো, মুমিন কেন আত্মপর্যালোচনা করবে? উত্তর হলো, মুমিনের আত্মপর্যালোচনার উদ্দেশ্য হলো আল্লাহমুখী হওয়া। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হও এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করো তোমাদের কাছে শাস্তি আসার আগে।’ (সুরা ঝুমার, আয়াত : ৫৪)
তাই আসুন! পবিত্র রমজানের যতটুকু সময় অবশিষ্ট আছে সে সময়টুকুতে আমরা যেন আল্লাহমুখী হয়ে থাকি এবং রমজানে যে ভুল-ত্রুটি হয়েছে সে ব্যাপারে অনুতপ্ত হই এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করি। আগামী দিনে ভালো কাজ করার এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার করি। কেননা হাদিসে এসেছে, ‘(এ মাসে) একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকেন, হে কল্যাণ অন্বেষণকারী, অগ্রসর হও। হে পাপাসক্ত, বিরত হও।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৬৮২)
আল্লাহ সবাইকে তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস, সাঈদিয়া উম্মেহানী মহিলা মাদরাসা, ভাটারা, ঢাকা।
শাহেদ//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স য় ম স ধন রমজ ন রমজ ন ম স র রমজ ন কল য ণ বল ছ ন আম দ র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
অটোরিকশার ধাক্কায় ছিটকে বাসের নিচে, দুই বন্ধু নিহত
রাজধানীতে অটোরিকশার ধাক্কায় ছিটকে বাসের নিচে পড়ে দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। গতকাল বুধবার বনশ্রীর এফ ব্লক সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এদিন মতিঝিলের ফকিরাপুল মোড়ে প্রাইভেট কারের চাপায় আব্দুল মতিন (৩৬) নামে এক রিকশাচালক নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া পাঁচ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ছয়জন প্রাণ হারিয়েছেন।
বনশ্রীতে নিহত দু’জন হলেন– আব্দুল্লাহ আল নোমান (২১) ও পাভেল মিয়া (২০)। নোমানের মামা আব্দুল হামিদ জানান, নিহতরা পরস্পর বন্ধু। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে ঢাকায় ঘুরতে যাওয়ার সময় দু’জন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। তারা রূপগঞ্জের নামারমুসুরি এলাকায় থাকতেন। নোমান মুড়াপাড়া ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। পাভেল তেমন কিছুই করতেন না। এ ঘটনায় নোমানের পরিবারের পক্ষ থেকে সড়ক নিরাপত্তা আইনে খিলগাঁও থানায় মামলা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী মোটরসাইকেল চালক টিপু সুলতান বলেন, সড়কটি যানবাহনে ঠাসা ছিল। এ কারণে গাড়ি চলছিল ধীরগতিতে। হঠাৎ একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা পাশ থেকে এসে নোমানের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এতে দু’জন সড়কের ওপর ছিটকে পড়েন। পরে মিয়ামি পরিবহনের একটি বাস তাদের চাপা দেয়। নোমান ঘটনাস্থলেই মারা যান। মোটরসাইকেল আরোহী পাভেলকে গুরুতর আহত অবস্থায় ফরাজী হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
খিলগাঁও থানার ওসি দাউদ হোসেন জানান, বাসটি জব্দ করা হয়েছে। চালক ও তার সহকারী পালিয়ে গেছে। অটোরিকশা চালককেও আটক করা যায়নি। মরদেহ দুটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পাঠানো হয়েছে।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফকিরাপুল মোড়ে প্রাইভেটকারের চাপায় প্রাণ হারান রিকশাচালক আব্দুল মতিন। তাঁর বাড়ি রংপুরে। তিনি মুগদার মাণ্ডা এলাকায় একটি রিকশার গ্যারেজে থাকতেন। মতিঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাইমিনুল ইসলাম জানান, প্রাইভেটকারের চালক আল আমিনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়েছে। ময়নাতন্ত শেষে পরিবারের কাছে মতিনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার রাতে বিমানবন্দর থানার সিভিল এভিয়েশন কোয়ার্টার গেটের (সি-টাইপ) সামনের ফুটপাত থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার বয়স আনুমানিক ২৫ বছর। বিমানবন্দর থানার এসআই আমিনুল ইসলাম বলেন, ওই যুবকের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে। মরদেহ ঢামেক মর্গে রাখা হয়েছে।
সড়কে ঝরল আরও ছয় প্রাণ
খুলনার ডুমুরিয়ায় তেলবাহী লরির চাপায় দুই নারী নিহত হয়েছেন। গতকাল বিকেলে উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের নরনিয়া মহিলা মাদ্রাসার কাছে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন– রোকেয়া বেগম (৫৫) ও রশিদা বেগম (৪৫)।
গতকাল সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাছে সেলফি পরিবহনের বাসের ধাক্কায় শামসুল হক নামে এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন। তিনি গাজীপুরের শ্রীপুরে গণস্বাস্থ্য উপকেন্দ্রের নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন। সাভার থেকে অবসরের পাওনাদি নিয়ে ফেরার পথে তিনি প্রাণ হারান। শামসুলের বাড়ি চাঁদপুরে। ঘটনার পর গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মচারীরা সেলফি পরিবহনের পাঁচটি বাস আটক করেন।
এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অটোরিকশা ও পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষে নয়ন মিয়া (৩৭) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১০ জন। গতকাল বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়া ইউনিয়নের রতনদী এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে দুই মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে শান্ত ইসলাম (১৮) নামে এক তরুণ নিহত হয়েছেন। গতকাল উপজেলার কুষ্টিয়া-প্রাগপুর সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। শান্ত মথুরাপুর পশ্চিমপাড়া গ্রামের রিপন মণ্ডলের ছেলে।
রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মৃগী বাজারে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কে ছিটকে পড়ে স্বপন শীল নামে এক স্যালুন ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। গতকাল ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র বিলি করতে বেরিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি।