বন্ধ হয়ে গেছে এক হাজার কারখানা, চালু আছে মাত্র ২০০
Published: 29th, March 2025 GMT
চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব মাদারবাড়ী এলাকায় ১৯৯৯ সালে ‘সাকসেস শু’ নামে হাতে তৈরি জুতার কারখানা করেন মোহাম্মদ বেলাল। সেই কারখানায় এবারের ঈদ মৌসুমে কাজ করছেন মাত্র ২২ জন শ্রমিক। অথচ গত বছরও এই সংখ্যা ছিল ৩৫। হাতে তৈরি জুতার চাহিদা কমায় এখন আর লোকবল বেশি লাগছে না। তাই ব্যস্ততাও কম।
নোয়াখালীর বাসিন্দা মোহাম্মদ বেলালের সঙ্গে সম্প্রতি তাঁর পূর্ব মাদারবাড়ীর কারখানায় বসে প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, আগের মতো ব্যবসা এখন নেই। এখন শুধু ঈদ মৌসুমে কিছুটা ব্যবসা হয়। অর্ডার কমে গেছে। তাই লোকবলও কম। প্রতি মাসেই একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছে। গত এক দশকে অন্তত এক হাজার কারখানা বন্ধ হয়েছে। তাতে পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন কয়েক হাজার শ্রমিক।
মালিক–শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, মূলত আমদানি করা ও চোরাই পথে আসা কম দামি বিদেশি জুতায় বাজার সয়লাব হওয়া; নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে হাতে তৈরি জুতার কারখানা গড়ে ওঠা এবং কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়া—এই তিন কারণে এসব কারখানা বন্ধ হয়েছে।
সরেজমিনে সম্প্রতি পূর্ব মাদারবাড়ীর ২৫টি জুতার কারখানা ঘুরে মালিক ও কারিগরদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বছরের অন্য সময়ের তুলনায় ঈদে কেনাবেচা অন্তত ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বেড়ে যায়।
— চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব মাদারবাড়ীতে ১৯৮০ সালে হাতে তৈরি পাদুকাশিল্পের যাত্রা শুরু হয়।— ২০১০ পর্যন্ত একের পর এক কারখানা গড়ে ওঠে। এরপরই ব্যবসায়ে মন্দা নেমে আসে।
সেখানকার কারখানাগুলোর কোনোটির আয়তন ২০ ফুট বাই ১০ ফুট, আবার কোনোটি একটু বড়, অর্থাৎ ৩০ ফুট বাই ১৫ ফুট। এসব কারখানার ভেতরে কাঠের পাটাতন দিয়ে দোতলা করা হয়েছে। কারিগরেরা ওপরে-নিচে বসেই যে যাঁর মতো করে জুতায় আঠা লাগান, তলা কাটেন, ফিতা বাঁধেন, সেলাই করেন ও প্যাকেটে ভরেন।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব মাদারবাড়ীতে ১৯৮০ সালে হাতে তৈরি ক্ষুদ্র পাদুকাশিল্পের যাত্রা শুরু হয়। পরে পশ্চিম মাদারবাড়ী, নালাপাড়া, নিউমার্কেট, মোগলটুলি, বাকলিয়া প্রভৃতি এলাকায়ও একের পর এক কারখানা গড়ে ওঠে। কিন্তু এখন মাত্র ২০০ কারখানা চালু রয়েছে। এসব কারখানার তৈরি পাদুকা চট্টগ্রামের স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ঢাকা ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গার খুচরা বিক্রেতারা কিনে নেন। বিক্রি হয় সাধারণত ডজন হিসেবে। কারখানাগুলোয় কয়েক হাজার কারিগর কাজ করেন।
চট্টগ্রামের কারখানাগুলোয় হাতে তৈরি জুতা চট্টগ্রামের স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি ঢাকা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। তবে এখানে জুতার কী পরিমাণ ব্যবসা হয়, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য বা হিসাব নেই। কোনো কোনো ব্যবসায়ী অবশ্য দাবি করেন, শুধু ঈদ উপলক্ষে চট্টগ্রামের কারখানাগুলোয় ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। বছরের অন্যান্য সময়ে লেনদেন হয় ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকা। কারণ, তাঁদের ব্যবসা মূলত ঈদকেন্দ্রিক। এখানকার কারখানাগুলোয় ছেলেদের স্যান্ডেল, শু, স্লিপার, স্নিকার ও হাফ সুজের পাশাপাশি নারীদের হিল, স্যান্ডেল, শু ইত্যাদি তৈরি হয়।
১৯৯০ সালে এখানে গঠিত হয় ক্ষুদ্র পাদুকাশিল্প মালিক গ্রুপ। সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, ১৯৮০ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে ২০১০ পর্যন্ত একের পর এক কারখানা গড়ে উঠেছিল। এরপরই জুতার ব্যবসায়ে মন্দা নেমে আসে। গত এক দশকে অন্তত এক হাজার কারখানা বন্ধ হয়েছে। মূলত নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে হাতে তৈরি জুতার কারখানা চালু হওয়ার কারণেই চট্টগ্রামের জুতার কারখানাগুলোর ব্যবসা ছোট হয়েছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) কাছেও বর্তমানে কয়টি কারখানা চালু এবং এক দশকে কতটি কারখানা বন্ধ হয়েছে সে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
কারখানা বন্ধ হওয়ার বিষয়ে স্থানীয় কারিগর মোহাম্মদ ফোরকান বলেন, গত বছর জুতা তৈরিতে ব্যবহৃত ১৫ লিটার আঠার (বেলি পেস্টিং) দাম ছিল ৪ হাজার ৫০০ টাকা। এই আঠা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হয়। এবার রোজা শুরুর আগেই দাম বেড়েছে। বর্তমানে এটির দাম পড়ছে ছয় হাজার টাকা। আবার দুধ আঠা ২৫ লিটার কিনতে হচ্ছে চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকায়। অথচ গত ঈদেও তা ছিল তিন হাজার টাকা। কারখানা বন্ধ হওয়ার পেছনে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়াও একটি বড় কারণ।
দুই বছর আগে কারখানা বন্ধ করে দিয়ে এখন ঢাকার সাভারের একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন রেজাউল করিম নামের একজন উদ্যোক্তা। তিনি প্রথম আলোকে জানান, অর্ডার কমে যাওয়ায় ও লাভের চেয়ে লোকসান বেশি হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে তিনি কারখানা বন্ধ করেছেন। তবে পরিস্থিতি অনুকূল হলে আবার চট্টগ্রামে ফিরবেন।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ জানান, বিগত কোনো সরকারই এই শিল্পের দিকে নজর দেয়নি। চাহিদামতো প্রণোদনা পাওয়া যায়নি। এর ওপর চোরাই পথে কম দামি বিদেশি জুতা দেশে ঢুকছে। ফলে দেশীয় জুতা মার খাচ্ছে। এই অবস্থায় চট্টগ্রামের পাদুকাশিল্পকে বাঁচাতে উদ্যোক্তারা সরকারি প্রণোদনা ও সহজ শর্তের ঋণ দাবি করেছেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র প র ব ম দ রব ড় র ব যবস ব যবস য়
এছাড়াও পড়ুন:
কারখানার বর্জ্যে মরছে নদ
ডাইং কারখানার বর্জ্যে মরছে ব্রহ্মপুত্র নদ। প্রকাশ্যে এ দূষণ ঘটলেও দেখার কেউ নেই। প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ ভুক্তভোগীদের। পরিবেশ কর্মকর্তা চাইছেন সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ অভিযোগ।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার ও নরসিংদী সদর উপজেলায় অন্তত ৬০টি ডাইং কারখানা ব্রহ্মপুত্র দূষণের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। নদের তীরে অবস্থিত এসব কারখানায় এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) থাকলেও তারা বর্জ্য পরিশোধন না করেই প্রতিদিন নদে ফেলছে। এতে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এ নদের সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষজন।
অভিযোগ রয়েছে, নদের তীরে অবস্থিত কারখানাগুলো ইটিপি রাখলেও তারা বর্জ্য পরিশোধন না করেই নদে ফেলছে। অনেক কারখানায় ইটিপি থাকলেও খরচ কমাতে বেশির ভাগ সময় তা বন্ধ রাখা হয়। এ ছাড়া বেশকিছু কারখানার ইটিপি প্রয়োজনের তুলনায় ছোট হওয়ায় সঠিকভাবে বর্জ্য পরিশোধন করা সম্ভব হয় না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, নরসিংদী সদর উপজেলায় রয়েছে ছোট-বড় ৫০টি ডাইং কারখানা। আড়াইহাজারে স্পিনিং মিলসহ ডাইং কারখানা রয়েছে অন্তত ১০টি। নরসিংদীর ডাইং কারখানাগুলোর মধ্যে পাঁচদোনা এলাকার আবদুল্লাহ ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ, বাঘহাটা এলাকার ফাইভ অ্যান্ড ফাইভ ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং, সাজেদা ডাইং, আনোয়ার ডাইং, শতরূপা ডাইং, রুকু ডাইং, মেসার্স একতা ডাইং, কুড়েরপাড় এলাকার ব্রাদার্স টেক্সটাইল, ইভা ডাইং, ভগীরথপুর এলাকার এম এমকে ডাইং, নীলা ডাইং, এইচ এম ডাইং, মা সখিনা টেক্সটাইল, মুক্তাদিন ডাইং, পাঁচদোনা এলাকার তানিয়া ডাইং, সান ফ্লাওয়ার টেক্সটাইল প্রভৃতি।
আড়াইহাজারের কয়েকটি কারখানা হলো– ভাই ভাই স্পিনিং মিলস, ছাবেদ আলী স্পিনিং মিল, রফিকুল ডাইং, দিপু ডাইং ও হাজী হাবিবুর ডাইং।
আড়াইহাজার পৌরসভার চামুরকান্দি এলাকার বাসিন্দা মিয়াজউদ্দিন মিয়া বলেন, দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে নদটি। দেশীয় জাতের মাছের অভয়াশ্রম এ নদ থেকে মাছ হারিয়ে গেছে।
আড়াইহাজারের বালিয়াপাড়া এলাকার ইসমাইল হোসেন জানান, রফিকুল ডাইংয়ের বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে পানির রং কালচে হয়ে গেছে। একই অবস্থা অন্য কারখানাগুলোর। বর্জ্য নদে ফেলার বিষয়ে স্থানীয়রা কথা বলতে গিয়ে উল্টো কারখানা কর্তৃপক্ষের হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। এ ব্যাপারে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
রফিকুল ডাইংয়ের মালিক রফিকুল ইসলাম জানান, তাদের ইটিপি নেই। ডাইংয়ের পানি তারা নির্দিষ্ট পানির ট্যাংকে রাখেন, সরাসরি নদে ফেলেন না। ট্যাংকে জমানো পানি কোথায় ফেলেন জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
নরসিংদী সদর উপজেলার শিলমান্দী ইউনিয়নের গনেরগাঁও গ্রামের বাসিন্দা মাহবুব হাসান শুভর ভাষ্য, কুড়েরপাড় এলাকার ডাইং কারখানাগুলোর রং মেশানো বর্জ্য পরিশোধন না করে ব্রহ্মপুত্রে ফেলায় নদটি এখন মৃতপ্রায়। দূষণের কারণে দুর্গন্ধে এর পারে দাঁড়ানো যায় না। স্থানীয়রা অনেকবার প্রতিবাদ করেও প্রতিকার পাননি বলে জানান তিনি।
গত ১৫ এপ্রিল শিলমান্দী ইউনিয়নের কুড়েরপাড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ইভা ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং লিমিটেড নামে একটি কারখানা থেকে বর্জ্য এসে পড়ছে নদের পানিতে। ভিডিও করতে দেখে কারখানা কর্তৃপক্ষ বর্জ্য ফেলা বন্ধ করে দেয়।
ইভা ডাইংয়ের ইটিপি ইনচার্জ রেজাউল করিম জানান, বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে তারা প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছেন। অনেক কারখানা সরাসরি নদে বর্জ্য ফেললেও তারা নদ দূষণ করেন না।
একই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফাতেমা ডাইংসহ ব্রহ্মপুত্রের তীরে গড়ে ওঠা কারখানাগুলো থেকেও নদে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে এসব কারখানার কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
নরসিংদী পরিবেশ অধিদপ্তরের উপসহকারী পরিচালক কামরুজ্জামান জানান, নদে বর্জ্য ফেলার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক তারেক বাবু জানান, ব্রহ্মপুত্রে নদে সরাসরি বর্জ্য ফেলছে ডাইংসহ যেসব কারখানা সেসবের অধিকাংশই নরসিংদী জেলার অন্তর্গত। তাই নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে নদ দূষণমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
আড়াইহাজারের ইউএনও সাজ্জাত হোসেন বলেন, কখনও কখনও কিছু কারখানা বর্জ্য পরিশোধন না করেই নদে ছেড়ে দেয়। কোন কারখানা নদ দূষণ করছে, স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশবাদী সংগঠন তা জানালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।