বরিশালের গৌরনদী উপজেলা সদরের মনি আক্তার চলতি বছর দুবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময়ে তিনি ঢাকাতেও যাননি একবারও। তাই ধরা যায়, স্থানীয়ভাবেই তিনি সংক্রমিত হয়েছিলেন। 

মনি আক্তারের স্বামী গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড এলাকার ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘মশা এই শহরে লাগামছাড়া। ডেঙ্গু রোগী বাড়লেও মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখছি না।’ 

ডেঙ্গু একসময় রাজধানী ঢাকার রোগ ছিল আর তা বর্ষা মৌসুমেই সাধারণত ছড়াত। কিন্তু এখন এ রোগ সারা দেশে ছড়িয়েছে এবং সারা বছরই লেগে আছে। দেশে ডেঙ্গুর বড় আকারের প্রাদুর্ভাব ঘটে ২০০০ সালে। এরপর থেকে প্রতিবছর সবচেয়ে বেশি রোগী থাকত রাজধানীতে। কিন্তু ২০২৩ সালে এর ব্যত্যয় হয়। এর পর থেকে রাজধানীর চেয়ে বাইরে ডেঙ্গু রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। তবে চলতি বছর যত রোগী ঢাকার বাইরে আক্রান্ত হয়েছে, অতীতে তা হয়নি। এ বছর মোট আক্রান্তের প্রায় ৭০ শতাংশ ঢাকার বাইরে। এ পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজধানীতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধতা থাকার পরও স্থানীয় সরকারের কিছু উদ্যোগ চোখে পড়ে। কিন্তু ঢাকার বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণ বা অন্য কোনো ধরনের উদ্যোগ অনেক কম। এর মধ্যে আবার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিনিধি না থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। 

ঢাকার বাইরে আক্রান্ত বাড়ছে

ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এখন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে ঢাকার বাইরে। 

চলতি বছর (২৮ মার্চ পর্যন্ত) ১ হাজার ৮৬২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৬৯ ভাগই ঢাকার বাইরের রোগী। গত বছর আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন। মোট রোগীর ৬২ ভাগ ছিল ঢাকা নগরীর বাইরের। ২০২৩ সালে দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়। ওই সময় মোট আক্রান্তের ৬৫ শতাংশই ছিল ঢাকার বাইরের। ওই বছরই আসলে ডেঙ্গু এভাবে দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানীতে ছাড়িয়ে যায় আক্রান্তের দিক থেকে। এর আগের বছর ২০২২ সালে মোট আক্রান্তের ৩৭ শতাংশ ছিল ঢাকার বাইরে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দীন আহমেদ বলছিলেন, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর এই বিস্তারের বড় কারণ মশার নিয়ন্ত্রণে প্রায় কোনো উদ্যোগ নেই। মশা আপন মনে বেড়ে যাচ্ছে। আগে তো স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা ছিলেন, কিছু কাজ ছিল। এখন তা–ও নেই। আর নতুন নতুন শহর গড়ে উঠছে অপরিকল্পিতভাবে। সেখানে নতুন নতুন প্রজননক্ষেত্র বাড়ছে। 

ঢাকার বাইরে প্রস্তুতি কম 

খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১১১ জন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছে খুলনায়, ৩৪ জন। এই রোগীদের মধ্যে ১৭ জন খুলনা মেডিকেলের, বাকিরা শহরের বাইরের বিভিন্ন ছোট শহর বা গ্রামের হাসপাতালের রোগী।

খুলনা বিভাগের ছোট জেলা নড়াইলে এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩। নড়াইল পৌর শহরে মশার উপদ্রব অনেক। মশা নিধনে অবশ্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। অন্যান্য বছর পৌরসভায় ফগার মেশিন দিয়ে মশকনিধন ওষুধ ছিটানো হলেও এ বছর তা চোখে পড়েনি পৌরবাসীর।

নড়াইলে শীতের শেষে হঠাৎ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মশার অত্যাচারও বেড়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকাকেই মশার উপদ্রবের মূল কারণ বলে মনে করেন শহরবাসীর কেউ কেউ।

রাজধানীর বাইরে সিটি করপোরেশনগুলোতে মশা নিধনে তৎপরতা কম। রাজধানীর উত্তর সিটিতে একজন কীটতত্ত্ববিদ আছেন। দক্ষিণে বাইরের কীটতত্ত্ববিদের কাছ থেকে সহায়তা নেওয়া হয়। এর বাইরের সিটি করপোরেশনগুলোতে কীটতত্ত্ববিদের কোনো বালাই নেই। ডেঙ্গুকেন্দ্রিক পরিকল্পনা ও তৎপরতা—দুইয়েরই ঘাটতি যথেষ্ট।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডে ৫ জন করে একটি দল রয়েছে। এ ছাড়া ৬০ জনের একটি বিশেষ দল রয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে নগরের নির্ধারিত এলাকাগুলোতে ওষুধ ছিটানোর কাজ করেন। সিটি করপোরেশনের সূত্র জানায়, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আলাদা করে বাজেট নেই। তবে মশক ওষুধ ক্রয় খাতে চলতি অর্থবছরে চার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সিটিতে কোনো কীটতত্ত্ববিদও নেই। 

দেশের নবীন সিটি করপোরেশন ময়মনসিংহ। এ সিটির খাদ্য ও স্যানিটেশন কর্মকর্তা দীপক মজুমদার বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের লোকবলই মশা নিধনের কাজ করে। কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই, তবে সিভিল সার্জন দপ্তর থেকে সহায়তা দেওয়া হয়।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলেন, ডেঙ্গু এমন একটি সমস্যা, যার সঙ্গে শুধু স্বাস্থ্যগত দিক নয়; বরং পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা, নগরকেন্দ্রিক পরিচ্ছন্নতার উদ্যোগ—এসব বিষয় জড়িত। এসবের জন্য জনসম্পৃক্ততার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু ঢাকার বাইরে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মশা নিধন, বিশেষভাবে ডেঙ্গুর এডিস মশা নির্মূলের উদ্যোগ মোটেও কার্যকর নয় বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি মশা নিয়ে গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন ধরে।

অধ্যাপক বাশার বলছিলেন, ‘স্থানীয় সরকারের মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম দুর্বল। কিন্তু এডিস মশার বিস্তার ঢাকার বাইরে অনেকটাই আছে। ডেঙ্গু এত বছর ধরে আমাদের ভোগাচ্ছে কিন্তু রাজধানীর বাইরে উন্নত মশা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ দেখছি না।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স থ ন য় সরক র সরক র র

এছাড়াও পড়ুন:

অনশনের পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পেলেন ছয় সমন্বয়ক

নিরাপত্তার অজুহাতে গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির ছয়জন সমন্বয়ককে। আটক থাকার এক পর্যায়ে তাঁরা অনশন শুরু করেন। ৩২ ঘণ্টা অনশনের পর ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) দুপুরে ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের দুটি গাড়িতে করে যাঁর যাঁর ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়।

সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে ছয় দিন; সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে পাঁচ দিন এবং নুসরাত তাবাসসুমকে চার দিন ডিবি কার্যালয়ে তখন আটক রাখা হয়েছিল। এই ছয় সমন্বয়কের মধ্যে নাহিদ এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক। আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। সারজিস, হাসনাত ও নুসরাত এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আবু বাকের এখন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক।

ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়ার সেই ঘটনা সম্পর্কে সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার বোনের বাসার লোকেশন (ঠিকানা) দিয়েছিলাম ডিবিকে। ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) ডিবি তাদের তত্ত্বাবধানেই আমাদের ছয়জনকে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। বোনের বাসায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর আমি প্রথমে আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানিকনগরের একটা জায়গায় দেখা করি। আমরা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। কীভাবে এক দফার (সরকার পতনের) ঘোষণায় যাওয়া যায়, সে বিষয়েও সেদিন আমরা চিন্তা করি।’

সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচির আওতায় গণসংগীত, পথনাটক, দেয়াললিখন, স্মৃতিচারণা ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয় রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত ১৬টি জেলা ও মহানগরে। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিছু জায়গায় শিক্ষক ও আইনজীবীরা অংশ নেন। তবে কোথাও কোথাও কর্মসূচিতে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অনেক জায়গায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়।

প্রতিবাদ, বিক্ষোভ

সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উদ্যোগে পৃথক সমাবেশ-মানববন্ধন ও মিছিল করা হয়। পাশাপাশি সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করে ছাত্র-জনতা।

‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমনপ্রক্রিয়া ও গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যা’র প্রতিবাদে ১ আগস্ট বেলা ১১টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় সংসদের সামনে সমাবেশের কর্মসূচি ছিল শিল্পী ও কলাকুশলীদের। ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে তাঁরা প্রথমে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ–সংলগ্ন ইন্দিরা রোডের প্রান্তে সমবেত হন। সেদিন সকাল থেকেই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিল্পীরা ব্যানার-পোস্টার নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন।

পরে শিল্পীরা ইন্দিরা রোড দিয়ে শোভাযাত্রা করে ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমা হলের কাছে সমবেত হন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা সেখানে সড়কের পাশে ব্যানার-পোস্টার নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, যে বর্বর পন্থায় শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে দমন করা হচ্ছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না।

দৃশ্যমাধ্যমের শিল্পীদের সমাবেশ থেকে সেদিন শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের বিচার, গণগ্রেপ্তার, মামলা ও হয়রানি বন্ধের দাবি করা হয়। সমাবেশ থেকে আরও জানানো হয়, শিল্পীরা তাঁদের প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন।

সেদিন বিকেলে ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ের সামনে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। মানববন্ধনে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, গুলি করে শিশুসহ নির্বিচার মানুষ হত্যার তদন্ত জাতিসংঘের অধীনে করতে হবে।

সেই মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল (এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) বলেন, হত্যার বিচার করতে হবে। হুকুমদাতাদেরও বিচার করতে হবে।

কূটনীতিকদের ‘ব্রিফ’

জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে ১ আগস্ট বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিন বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়। সেই ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরা সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি জানান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ