‘ছেলেটা (সেলিম) যে কত কিছু খাইতে চাইত! কিনতে পারতাম না। মাংস পছন্দ করত। মাসে, দুই মাসে পারলে একবার মাংস কিইন্যা খাওয়াইছি। ছেলেটার চোখ নষ্ট হইয়া গেছে দেইখ্যা মনে এত কষ্ট লাগে যে খালি পুরান কথা মনে পড়ে। ছেলেটা জন্ম থ্যাইকাই কষ্ট করতেছে।’ কথাগুলো বলছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় এক চোখে গুলি লাগা সেলিমের মা সেলিনা খাতুন।

সেলিনা খাতুন ও সেলিম মিয়ার (১৮) সঙ্গে ১৭ মার্চ জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কথা হয়। ওই সময় সেলিমের ফলোআপ চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলেন সেলিনা।

 সেলিনা খাতুন প্রথম আলোকে জানান, গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় ১৮ জুলাই গাজীপুরে তাঁর ছেলে গুলিবিদ্ধ (ছররা গুলি) হন। ডান চোখে দুটি গুলি লেগেছিল, এর মধ্যে একটি বের করতে পেরেছেন চিকিৎসকেরা। সেলিমের ডান চোখে আলো ফিরে আসবে না, জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ডান চোখে প্রস্থেটিক আই (কৃত্রিম চোখ) স্থাপন করা হবে।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে অল্প সময় কথা বলে সেলিনা খাতুন ছেলের চোখের পরীক্ষার প্রতিবেদন আনার জন্য আরেক হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে পরে কথা হয়েছিল ২৮ মার্চ মুঠোফোনে। তবে সেদিন (১৭ মার্চ) ইশারায় সেলিম জানিয়েছিলেন, ডান চোখে তিনি কিছু দেখেন না। চোখে অনেক যন্ত্রণা হয়। তাঁর শরীরেও লেগেছিল ছররা গুলি।

হাসপাতালে নিজ শয্যায় বসে এই প্রতিবেদককে এক্স–রে, সিটি স্ক্যান বের করে দেখাচ্ছিলেন সেলিম। ওই ওয়ার্ডে গণ-অভ্যুত্থানে চোখে আঘাত পাওয়া আরও কয়েকজন রোগী ছিলেন। তাঁরা জানান, কথা বলতে না পারলেও সেলিম ওর গুলিবিদ্ধ হওয়া, অসুস্থতা, চিকিৎসার বিষয়গুলো সব বোঝাতে পারেন।

সেলিম কীভাবে গুলিবিদ্ধ হলেন, জানতে চাইলে তাঁর মা সেলিনা খাতুন (৩৩) বলেন, তাঁদের বাড়ি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলায়। ১৫ বছর বয়সে জন্ম নেয় তাঁর প্রথম সন্তান সেলিম। তাঁর স্বামী তাইজুল ইসলাম রিকশাচালক ছিলেন। সেলিমের বয়স যখন আড়াই বছর, তখন তাইজুল ইসলাম তাঁদের ছেড়ে চলে যান। এরপর তিনি দিশাহারা হয়ে পড়েন। তাঁর মা–বাবাও খুব গরিব। পরে সংসার চালানোর জন্য গাজীপুরে চলে আসেন তিনি। রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেলিম গ্রামে অন্য শিশুদের সঙ্গে ব্র্যাক স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। শিক্ষক তাঁকে আলাদাভাবে পড়া বোঝাতেন।

সেলিনা খাতুন আরও জানান, সংসারে অভাব থাকায় ও বাক্‌প্রতিবন্ধী হওয়ায় সেলিমকে বেশি পড়াশোনা করাতে পারেননি। আড়াই বছর আগে সেলিমকে তিনি তাঁর সঙ্গে কাজ করার ব্যবস্থা করেন। ১৮ জুলাই তিনি কাজে গেলেও সেলিম বাসায় ছিলেন। বেলা আড়াইটার সময় গাজীপুরের চৌরাস্তায় আন্দোলন চলাকালে সেলিম গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর ডান চোখ ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছররা গুলি লাগে। ওই সময় পুলিশের ভয়ে তাঁরা হাসপাতালে নিতেও দেরি করেন। রাত ৮টার দিকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। আগস্টের প্রথম দিকে সেলিমকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ওই দিন চিকিৎসকেরা জরুরি ভিত্তিতে সেলিমের ডান চোখে অস্ত্রোপচার করেন। এরপর ৬ ফেব্রুয়ারি ও ১০ মার্চ ওই চোখে আরও দুটি অস্ত্রোপচার করা হয়।

সেলিমের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক খায়ের আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ছররা গুলি সেলিমের ডান চোখ ভেদ করে গেছে। এ অবস্থায় যতবার অস্ত্রোপচার হবে, ততবার চোখের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেলিমের ডান চোখে দৃষ্টি নেই। লন্ডনের মুনফিল্ডস আই হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও সেলিমকে দেখে গেছেন। এখন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চোখের ভেতর পরিষ্কার করে প্রস্থেটিক আই (কৃত্রিম চোখ) স্থাপন করা হবে।

চিকিৎসকেরা কৃত্রিম চোখ স্থাপনে অস্ত্রোপচারের কোনো সময় দিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে সেলিনা খাতুন বলেন, গত বৃহস্পতিবার তিনি গাজীপুরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় দুর্ঘটনার শিকার হন, পা ভেঙে গেছে। এ কারণে সেলিম বৃহস্পতিবার হাসপাতাল ছেড়ে বাসায় চলে এসেছেন। চিকিৎসকেরা বলেছেন, ঈদের পর তিনি যখন যেতে পারবেন, তখনই সেলিমের চোখে অস্ত্রোপচার করা হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক র প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা

রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।

এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”

আরো পড়ুন:

ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত

ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত

উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”

সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”

এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।

বিবৃতিতে  বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে। 

ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।

ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।

ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।

এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ