মধ্যরাতে মোটরসাইকেল নিয়ে ধাওয়া, ৪০ কিলোমিটার বাস চালিয়ে যাত্রীদের রক্ষা
Published: 5th, April 2025 GMT
একুশে পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস ঢাকা থেকে নোয়াখালী যাচ্ছিল। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা পার হলে ৮ থেকে ১০টি মোটরসাইকেলে করে একদল তরুণ বাসটি অনুসরণ শুরু করেন। এরপর প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ বাসটিকে ধাওয়া করেন তাঁরা। বাসটি থামানোর জন্য দুই দফায় চালককে লক্ষ্য করে ইট ছোড়েন তাঁরা। এতে চালক আহত হন। কিন্তু যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাস চালিয়ে যান তিনি। এতে রক্ষা পান যাত্রীরা।
গত সোমবার মধ্যরাতে এ ঘটনা ঘটে। হামলায় বাসচালক মো.
শুক্রবার কথা হয় বাসটির সহকারী মোহাম্মদ রাহাতের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে জানিয়েছেন ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতার কথা।
মোহাম্মদ রাহাত বলেন, বাসটি যখন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা পার হয়, তখনই ৮ থেকে ১০টি মোটরসাইকেলে থাকা একটি দল দেখতে পান তাঁরা। কিন্তু তখনো বিপদ আঁচ করতে পারেননি চালক কিংবা সহকারী। বাস থামাতে না পেরে মোটরসাইকেলের আরোহীরা প্রথমে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার ছাতারপাইয়া রাস্তার মাথায় এবং পরে বেগমগঞ্জ উপজেলার আবদুল মালেক মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে চালককে উদ্দেশ করে ইট ছোড়েন।
রাহাত বলেন, দুই দফায় ইটের আঘাত লাগে বাসচালক সোহেলের মাথায়। তবুও তিনি থেমে যাননি। প্রথম আঘাতের পর তাঁর মুখ থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। কিন্তু যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁরা বাস চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
বাসচালকের সহকারী আরও বলেন, ‘দুর্ঘটনা এড়াতে পথে কোনো যাত্রীকে নামতে দিইনি। বাসটি সরাসরি নোয়াখালী সুধারাম থানার সামনে গেলে সব যাত্রী দ্রুত থানায় ঢুকে পড়ে।’
বাসচালক মো. সোহেল বর্তমানে নোয়াখালীর মাইজদী সদর হাসপাতালে ভর্তি আছেন। চিকিৎসাধীন থাকায় তিনি কোনো কথা বলতে পারছেন না।
চালকের অবস্থা জানতে যোগাযোগ করা হয় তাঁর ছোট ভাই মেহেদী হাসানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভাইয়ের চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ হাজার টাকা বাসমালিক দিয়েছেন। চিকিৎসার খরচ চালাতে তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন।
এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। বাসের মালিক মো. জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার পরে সুধারাম মডেল থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি করতে চান। কিন্তু সুধারাম মডেল থানা থেকে সোনাইমুড়ী থানায় যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। সোনাইমুড়ী থানা থেকে আবার লাকসাম থানায় যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
জহিরুল ইসলাম বলেন, হামলায় আহত বাসচালক সোহেলের মাথা ও চোয়ালে ৩১টি সেলাই লেগেছে। বাসে থাকা ৩৮ যাত্রীর মধ্যে নারী ও শিশু ছিল।
এ ঘটনার সঙ্গে পেশাদার ডাকাতির ঘটনার মিল নেই বলে দাবি করেছেন হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা অঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. খায়রুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডাকাতির উদ্দেশ্য থাকলে তাঁরা একটি বাসকে ৪০ কিলোমিটার রাস্তা কেন ধাওয়া করবে? এই রুটে অনেক গাড়ি চলাচল করে, গত পাঁচ বছরে কোনো বাস ডাকাতির ঘটনা পাওয়া যায়নি। মোটরসাইকেল আরোহীদের সাইড দেওয়া নিয়ে বাসচালকের দ্বন্দ্বের জেরেও এমনটি হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
ঘটনার বিস্তারিত জানতে পুলিশ কাজ করছে জানিয়ে খায়রুল আলম বলেন, ‘আমরা তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছি। তারা এই রুটের বিভিন্ন স্থানের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে কাজ করছে। এখনো কাউকে শনাক্ত করা যায়নি।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক ঘটন র
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।