হবিগঞ্জের পাহাড়ি এলাকায় সজনের ভালো ফলন হয়েছে। বাজারে সজনের দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। তাই পাহাড়ি চাষিরা সজনে বিক্রিতে লাভবান হচ্ছেন।

এখন সজনের মৌসুম। এটি ফাল্গুন মাসের প্রথমে ধরা শুরু করে। চৈত্র ও বৈশাখ মাসজুড়ে বিক্রি হয়। এ সবজিটি এক সময় হবিগঞ্জ জেলার সর্বত্র চাষ হতো। এখন শুধু ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে জেলার পাহাড়ি এলাকায়। তার পাশাপাশি গ্রামের অনেক বাড়িতেও সজনে চাষ হয়। আর এ মৌসুমে সজনের ভালো ফলন হয়েছে।

জেলার চুনারুঘাট উপজেলার কালেঙ্গা পাহাড়ি এলাকা ও দেউন্দি চা-বাগান এলাকা পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, বাড়ি বাড়ি সজনের গাছ। অনেকে গাছ থেকে সজনে সংগ্রহ করে বিক্রি করছেন। আবার নিজেদের খাবারে সবজির চাহিদা মেটাচ্ছেন। এভাবে জেলার নবীগঞ্জ, বাহুবল, মাধবপুর উপজেলার পাহাড়ি এলাকার প্রতিটি চা-বাগান, আদিবাসী পুঞ্জির বাড়িতে সজনে চাষ হচ্ছে। এর ফলনে কোনো সার বা বিষ প্রয়োগের প্রয়োজন হচ্ছে না।

আরো পড়ুন:

ব্যয় বেশি, তুলার দাম বাড়ানোর দাবি চাষিদের

মিষ্টি ভুট্টায় সফলতার স্বপ্ন দেখছেন স্কুল শিক্ষক মনি

আলাপকালে দেউন্দি চা-বাগানের বাসিন্দা প্রতীক থিয়েটারের সভাপতি সুনীল বিশ্বাস বলেন, বাগানের উঁচু-ঢালু স্থানের মাটিতে সজনের ভালো ফলন হয়ে থাকে। এ সবজিতে পুষ্টি রয়েছে। দেউন্দি বাগানের শ্রমিক নেতা আমোদ মাল বলেন, তাদের কয়েকটি গাছ রয়েছে। প্রতিবছর সবকটি গাছে সজনে ধরে। নিজেদের খাওয়াসহ বিক্রি করে ভালো টাকা পাওয়া যায়। মৌসুম শেষে গাছের কিছু কিছু ডাল কেটে দিতে হয়। এতে নতুন ডালে বেশি ফলন হয়।

চুনারুঘাট উপজেলার কালেঙ্গা পাহাড়ের কালিয়াবাড়ী পুঞ্জির হেডম্যান বিনয় দেববর্মা জানান, তাদের বাড়ি বাড়ি সজনে গাছ রয়েছে। গাছে সজনে ধরে। এ সব সজনে তারা বিক্রি করার পাশাপাশি নিজেরা খেতে পারেন। সজনে চাষে কোনো খরচ নেই। বরং বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন তারা।

বাহুবলের আলীয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রী উটিয়ান টংপেয়ার জানান, সজনে গাছের ডালপালা নরম। ঝড় আসলে ভেঙে যায়। তারপরও সজনে চাষে ওষুধ না দিলেও ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে। নিজেদের খাওয়ার পাশাপাশি বিক্রিও করা যাচ্ছে।

সাতছড়ি ত্রিপুরা পল্লীর হেডম্যান চিত্তরঞ্জন দেববর্মা ও সহকারী হেডম্যান আশিষ দেববর্মা জানান, তাদের পল্লীতে বেশ কিছু সজনে গাছ আছে। প্রতি বছরই সজনে ধরছে। নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি বিক্রি করে তারা অর্থ পাচ্ছেন।

শায়েস্তাগঞ্জ পুরান বাজারের পাইকারি ক্রেতা মোতাব্বির হোসেন জানান, গ্রামে এখনো কিছু কিছু বাড়িতে সজনের চাষ হয়। তবে ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে পাহাড়ে। তাই তারা পাহাড় থেকে সজনে কিনে বাজারে খুচরা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন। এতে ভালো লাভ হচ্ছে। ক্রেতারাও বিষমুক্ত সজনে খেতে পারছেন।

ক্রেতা সজল মিয়া জানান, এক আঁটি সজনে ৬০ টাকা দিয়ে কিনছেন। এ সবজি খেয়ে স্বাদ পাওয়া যায়। আরেক ক্রেতা কামাল মিয়া জানান, সজনে খেতে হলে শুকনো শীমের বীজ ও শুটকির প্রয়োজন। সঙ্গে মাছ দিলে আরও ভালো স্বাদ পাওয়া যায়।

চাষিরা প্রতি কেজি সজনে ডাটা পাইকারদের কাছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি করেন। আর ১২টা সজনে এক আঁটি করে বিক্রি করেন ৫০ টাকায়। সেই সজনে ডাটা খুচরা পর্যায়ে যেতে কেজি ১২০ টাকায় ও আঁটি ৭০ টাকায় বিক্রি হয়।

হবিগঞ্জ আধুনিক হাসপাতালের চিকিৎসক ডা.

দেবাশীষ দাশ জানান, গরমের সময় অনেকে পেটের সমস্যায় ভোগেন। পেটে গ্যাস, বদহজম এবং পেটে ব্যথা হলে সজনের তৈরি তরকারি খুব উপকারে আসবে। কারণ সজনের তরকারি হজমে সহায়তা করে। এটি পেটের সমস্যা নিরসনে সহায়তা করবে। সজনে ডাটা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এছাড়া সজনে পাতার রসও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যাদের কোলেস্টেরলের সমস্যা আছে, তাদের জন্য এটি খুব উপকারী সবজি।

এছাড়া দাঁতের মাড়ির সমস্যা দূর করতে সজনে ডাটার জুড়ি নেই। প্রাথমিক অবস্থায় টিউমারের প্রতিষেধক হিসেবে সজনে পাতা বেশ কাজের। বাতের ব্যথা ও হেঁচকি উপশমে এই সজনে ডাটা বেশ উপকারে আসে। এছাড়াও আঘাতে ফুলে যাওয়া কমাতে সহায়তা করে। নানা গুণে ভরা সজনে ডাটা আপনার রসনাতৃপ্তি মেটানোর পাশাপাশি দেবে পুষ্টি, রাখবে সুস্থ।

হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আকতারুজ্জামান জানান, সজনে সবজিটির পুষ্টিগুণ ভালো। জেলার পাহাড়ি এলাকায়সহ বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ২৭ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয় ৬৫ মেট্রিক টন। শুকনো স্থানে উৎপাদন ভালো হয়। বর্তমানে পাহাড়ি এলাকায় চাষে কৃষকরা লাভবান। পাহাড়ি এলাকার বাড়ি বাড়ি সজনের চাষ হচ্ছে। এর চাষে কৃষকদের উৎসাহ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। হবিগঞ্জ থেকে কিছু পরিমাণ সজনে দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়।

ঢাকা/বকুল

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ফসল র সমস য এল ক য় সজন র

এছাড়াও পড়ুন:

অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে

সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।

এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।

এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’

আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ