উম্মে সালামার(রা.)পুরো নাম হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়া ইবন আল-মুগীরা। তিনি ছিলেন রূপে ও গুণে অনন্য, অভিজাত বংশোদ্ভূত এবং অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এক মহান নারী। তাঁর স্বামী আবদুল্লাহ ইবন আবদ আল-আসাদ ছিলেন ইসলামের প্রাথমিক যুগের সাহসী সাহাবিদের একজন, যিনি রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর গোপনে দাওয়াতকালে ইসলাম গ্রহণ করেন।

উম্মে সালামা (রা.

) ও তাঁর স্বামী দুজনেই ছিলেন ইসলামের সূচনালগ্নের প্রথম দিককার অনুসারী। তাঁর স্বামী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচাতো ভাই, আর স্বামীর মা ছিলেন নবীর পিতৃপক্ষের ফুফু—আরওয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব। এ দম্পতি ইসলামের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যারা আবিসিনিয়ায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) হিজরত করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম।

আরও পড়ুনআবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ছিলেন বিজ্ঞ ও সাহসী সাহাবি১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী উম্মে সালামা শিরক ও মূর্তিপূজার অযৌক্তিকতা অনুধাবন করে নিজ উদ্যোগে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবু উমাইয়া ছিলেন মক্কার এক সম্মানিত ব্যক্তিত্ব, যার উপাধি ছিল ‘যাদুর রকব’—অর্থাৎ ‘ভ্রমণকারীদের রসদদাতা’। কোনো সফরে গেলে তিনি তাঁর সঙ্গীদের খাবার আনতে দিতেন না; সকলের জন্য খাবারের ব্যবস্থাও তিনি নিজেই করতেন। এমন ছিল তাঁর উদারতা ও আতিথেয়তা।

 রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলাম প্রচারের শুরুতে তিন বছর গোপনে দাওয়াত দেন। পরে যখন তিনি প্রকাশ্যে প্রচার শুরু করেন, তখন তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েন। এরই প্রেক্ষিতে নবুওয়াতের পঞ্চম বছরে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের একটি অংশকে আবিসিনিয়ায় হিজরতের পরামর্শ দেন।

 ইতিহাস বলে, এই হিজরত দুর্বল ও নির্যাতিত মুসলিমদের আত্মরক্ষার একটি প্রচেষ্টা ছিল। তবে আবু সালামা ও উম্মে সালামা সহ বহু অভিজাত পরিবার এই দলে ছিলেন, যারা সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ছিলেন ও নিজেদের রক্ষা করার সামর্থ্য রাখতেন। এর মানে, হিজরতের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন।

আরও পড়ুনআবু জাহেলের মা আসমা বিনতে মুখাররাবা (রা.) সাহাবি ছিলেন ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাসুল (সা.) দুটি উদ্দেশ্যে সাহাবিদের আবিসিনিয়ায় পাঠান—প্রথমত, মক্কার উত্তেজনা প্রশমিত করা, দ্বিতীয়ত, ইসলামের বিশ্বজনীনতা প্রমাণ করা। তারা কেউ কয়েক মাস থেকে ফিরে আসেন, কেউবা সেখানে ১৫ বছর পর্যন্ত অবস্থান করেন। উম্মে সালামা ও তাঁর স্বামী আনুমানিক তিন থেকে চার বছর সেখানে ছিলেন। তাঁদের প্রথম সন্তান সালামা-র জন্মও হয় সেখানে।

 তাঁরা মক্কায় ফিরে আসেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পাশে থেকে ইসলামের দাওয়াতে অংশ নিতে। কিন্তু মক্কার বিরোধীরা আরও নৃশংস হয়ে ওঠে—নবীজিকে উপহাস করে, মুসলিমদের ওপর নানা রকম নির্যাতন চালায়, এমনকি তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে।

 এই প্রতিকূল পরিবেশেই ইসলাম নতুন আশ্রয় খুঁজে পায় ইয়াসরিবে (পরবর্তীতে মদিনা)। সেখানকার মানুষ প্রতিদিন ইসলাম গ্রহণ করছিল। এক পর্যায়ে তারা নবীজিকে ও মক্কার মুসলিমদের আমন্ত্রণ জানায় মদিনায় চলে আসার জন্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনার মুসলিমদের পূর্ণ সহযোগিতার অঙ্গীকার গ্রহণ করেন এবং সাহাবিদের হিজরতের নির্দেশ দেন।

 উম্মে সালামা ও তাঁর স্বামীও হিজরত করেন, কিন্তু কিছুদিন পরেই তাঁর স্বামী ইন্তেকাল করেন।

আরও পড়ুনতিরন্দাজ এক সাহাবি০৯ নভেম্বর ২০২৪

তৎকালীন আরব সমাজে বহু সন্তানের জননী হওয়া বা বিধবা হওয়া পুনর্বিবাহে বাধা ছিল না। তাই ইদ্দত পূর্ণ হলে, তাঁর কাছে একাধিক প্রস্তাব আসে। আবু বকর ও উমর (রা.)-এর মতো বিশিষ্ট সাহাবিরাও বিবাহের প্রস্তাব দেন, কিন্তু উম্মে সালামা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি স্বামীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং তাঁর অনুপস্থিতি গভীরভাবে অনুভব করছিলেন।

তিনি তাঁর স্বামীর কাছ থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদিস শুনেছিলেন: ‘যে কেউ বিপদে পড়ে আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী এই দোয়া পড়ে—‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’—আল্লাহ তাকে সহায়তা করবেন এবং তার জন্য এর চেয়েও উত্তম কিছু দান করবেন।’ (মুসলিম, হাদিস: ৯১৮)

 উম্মে সালামা (রা.) বলেন, ‘আমি এই দোয়া বারবার পড়তাম। কিন্তু ভাবতাম, আবু সালামার চেয়ে উত্তম আর কে হতে পারে?’ তবু আল্লাহর রহমতে সেটাই ঘটেছিল।

 সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর এক মহান প্রস্তাব আসে—রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে তাঁকে বিয়ে করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। উম্মে সালামা সম্মানিত বোধ করলেও কিছুটা সংকোচবোধও করেন। তিনি বার্তা পাঠান: ‘আমি ঈর্ষাকাতর প্রকৃতির, বয়স হয়েছে এবং আমার অনেকগুলো সন্তান।’

আরও পড়ুনসাহসী সাহাবি হজরত যুবাইর (রা.)০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

এটি ছিল অস্বীকৃতি নয়, বরং বিনম্র অজুহাত। রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তরে বলেন, ‘তোমার ঈর্ষাভাব দূর করার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। বয়স? আমি তো তোমার চেয়ে বড়। আর তোমার সন্তানদের দায়িত্ব আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কাছে অর্পণ করো।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ২,১০৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১,৯৪৩)

 কার বিধবা সন্তানদের জন্য এর চেয়ে উত্তম অভিভাবক আর হতে পারে? এভাবেই এই সম্মানজনক বিয়েটি সম্পন্ন হয় এবং উম্মে সালামা (রা.) উপলব্ধি করেন—আল্লাহ তাঁকে এমন এক স্বামী দিয়েছেন, যিনি তাঁর প্রথম স্বামীর চেয়েও উত্তম, যদিও আবু সালামাও এক মহান মানুষ ছিলেন।

সূত্র: আরবনিউজ ডট কম

আরও পড়ুননারী সাহাবি হজরত শিফা (রা.)১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রস ত ব র প রথম ইসল ম র আল ল হ র জন য হ জরত

এছাড়াও পড়ুন:

বিগ-বির মাধ্যমে জাপানের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী বাংলাদেশ

এক দশক আগে বঙ্গোপসাগর ঘিরে বাংলাদেশের জন্য বিগ-বি নামে পরিচিত বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট গ্রহণ করেছিল জাপান। বঙ্গোপসাগরীয় শিল্প প্রবৃদ্ধির ওই উদ্যোগে রয়েছে মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ প্রকল্প আর আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার বিকাশ। মে মাসের শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জাপান সফরে বিগ–বির মাধ্যমে সহযোগিতা জোরদারের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। তাঁর জাপান সফরের আগে টোকিওতে ১৫ মে অনুষ্ঠেয় দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকেও বিষয়টিতে প্রাধান্য দেবে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের ষষ্ঠ বৈঠকের প্রস্তুতি হিসেবে বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে জাপানের আলোচনায় কোন কোন বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার থাকবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

১৫ মে টোকিওতে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে জসীম উদ্দিন বাংলাদেশের এবং জাপানের জ্যেষ্ঠ উপমন্ত্রী আকাহোরি তাকেশি তাঁর দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।  
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে কোন কোন বিষয়গুলো ১৫ মের আলোচনায় প্রাধান্য পেতে পাবে, তা নিয়ে মতামত নেওয়া হয়। পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফরসহ সচিব পর্যায়ের সফর নিয়ে আলোচনা হয়।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বিগ–বিতে সহযোগিতা জোরদারের পাশাপাশি ব্যবসা, বিনিয়োগ, নবায়নযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ খাতভিত্তিক সহযোগিতা জোরদারের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নানা বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফর নিয়ে আলোচনা হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, টোকিওতে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকটি দুই ভাগে বিভক্ত থাকবে। প্রথম ভাগে থাকবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা বিষয়। আর দ্বিতীয় ভাগে থাকবে আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি।

আঞ্চলিক বিষয়াদিতে জাপানের বিগ–বি নিয়ে আলোচনা হবে। এ সময় ঢাকার পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের বাস্তবতা তুলে ধরা হবে। সেই সঙ্গে এ প্রকল্প সামনে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টিও বলা হবে। পরে ভারত যদি এর সঙ্গে যুক্ত হতে চায়, তবে তার ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হবে।

বিগ–বির সঙ্গে ২০২৩ সালে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলকে যুক্ত করে জাপান। কিন্তু ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে চরম টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক। এমন এক প্রেক্ষাপটে বিগ–বিকে বিশেষ করে সংযুক্তিকে বাংলাদেশের পরিমণ্ডলে নেওয়ার পরিকল্পনায় আপাতত একটা ধাক্কা এসেছে। এ নিয়ে জাপান নানাভাবে নিজেদের অস্বস্তির বিষয়টি বাংলাদেশকে জানিয়েছে। বিগ–বি জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের অগ্রাধিকার প্রস্তাব হওয়ায় এটিতে বিশেষ গুরুত্ব আছে টোকিওর। তাই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে আগ্রহী জাপান।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক এবং প্রধান উপদেষ্টার টোকিও সফরে জাপান প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিবিড় করার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের কাছ থেকে সমরাস্ত্র বিক্রির ওপর কয়েক বছর ধরে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে জাপান।

বাংলাদেশকে ২০২৩ সালে জাপানের সরকারি নিরাপত্তা সহায়তায় (ওএসএ) যুক্ত করা হয়েছে। মূলত জাপান নিজের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াতে এই কাঠামো তৈরি করেছে। ওএসএর মাধ্যমে জাপান বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও গভীর করার এবং ওই দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা দিয়ে থাকে। ওএসএর মাধ্যমে জাপান একটি দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে ঋণের পরিবর্তে অনুদান দিয়ে থাকে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ