ছবি নিছক কোনো ব্যক্তিগত স্মৃতি নয়। ছবি একটি টেক্সট, আর রাজনৈতিক দুনিয়ায় এই ছবির ব্যবহার বরাবরই কূটনৈতিক কৌশলের অংশ। বিখ্যাত মানুষদের সঙ্গে ছবি দিয়ে মানুষ তার ক্ষমতা এবং সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে অন্যকে জানান দেয়। বিখ্যাত মানুষদেরও তা করতে হয়। তাই কূটনীতিতে ব্যবহৃত ছবির পেছনের রাজনীতি নিয়েও জনগণের আগ্রহের শেষ নেই।
সম্ভবত সে কারণেই সম্প্রতি ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠককালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ড.
৫ আগস্ট বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর গত ৪ এপ্রিলই প্রথম নরেন্দ্র মোদি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎ হলো। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস নরেন্দ্র মোদিকে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে তোলা একটি ছবি উপহার দেন। ছবিটিতে দেখা যায়, ওই সময় মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত ১০২তম ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে মুহাম্মদ ইউনূসকে স্বর্ণপদক পরিয়ে দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি।
গত আট মাসে প্রধান উপদেষ্টা বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় শুভেচ্ছা স্মারক হিসেবে একটি ছবির অ্যালবাম দিয়েছেন। অ্যালবামটি মূলত জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে। সেখানে আছে ছবি, গ্রাফিতিসহ অনেক কিছু। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির ভাগ্যে সে বই জুটল না। তিনি দেখতে পেলেন না গণঅভ্যুত্থানের নানা ধরনের ডকুমেন্টেশন।
কেন ড. ইউনূস এই ছবি বাছাই করলেন উপহার হিসেবে? শুধু তাই নয়, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎকে সরকার খুবই ফলপ্রসূ হিসেবে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করছে এবং সবখানেই এই উপহারের ছবি ব্যবহৃত হচ্ছে। এ কারণেই ছবি কূটনীতির বিষয়টি চলে আসে।
এটি ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা ছবি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও এই ছবি সেই সময় প্রকাশিত হয়েছিল। ড. ইউনূসের মতো নোবেল বিজয়ীর জন্য এর আলাদা তাৎপর্য এতদিন ছিল না। কিন্তু সেই ছবিই এখন বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক মেরামত করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।
হতে পারে ড. ইউনূস মোদিকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন– মোদি তাঁকে আগেই সম্মানিত করেছেন, এখনও তা অব্যাহত রাখবেন। দ্বিতীয়ত, তিনি যে এই ছবি এতদিন যত্নে রেখেছেন– সেটি মোদিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। ৫ আগস্টের পর প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সরকার ‘আগের মতোই আছে’ দাবি করলেও বাস্তবতা যে ভিন্ন, তা ‘সাধারণ মানুষ’ও বুঝতে পারে। তাই ব্যক্তিগত ছবি উপহার দিয়ে ইউনূস সম্ভবত ২০১৫ সালের বন্ধুত্বকে স্মরণ করিয়ে ‘তেতো’ হওয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক ‘মিষ্টি’ করার চেষ্টা করেছেন।
ছবি কূটনীতি বাংলাদেশে এই প্রথম ঘটল, তা নয়। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে একটি সেলফি তোলেন। ছবিতে হাস্যোজ্জ্বল বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনা এবং তাঁর মেয়ে পুতুলকেও দেখা যায়। তখন ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়েছিল, বাইডেন নিজেই এ সেলফি তুলতে চেয়েছেন।
তখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ ছিল। তাই সেই সেলফি রাজনৈতিক ময়দানে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। সেই ছবি বিশেষত বিএনপি নেতাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে বলে দাবি করেছিল আওয়ামী লীগ। তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্টই বলেছিলেন, সেলফি কাউকে রক্ষা করতে পারবে না এবং তিনি আওয়ামী নেতাদের সেই ছবি গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্যও বলেছিলেন।
কে কাকে কী উপহার দেবেন, সেটি একেবারেই ব্যক্তিগত বিবেচনার বিষয়। কিন্তু জুলাই অ্যালবামটি নরেন্দ্র মোদিকে দেওয়া হলো না কেন? আমার জানামতে, সেই বইয়ের বিভিন্ন অংশে ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা’ প্রভৃতি স্লোগান-সংবলিত গ্রাফিতি ও ছবি রয়েছে। তাই হয়তো ধরে নেওয়া হয়েছে– সেই বই দিলে কূটনৈতিক সম্পর্ক ‘ভালো’ হওয়ার পরিবর্তে আরও খারাপ হতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এতদিন ভারতের বিরুদ্ধে ‘আধিপত্য’ বিস্তারের অভিযোগ করে ব্যক্তিগত স্মৃতির ছবি উপহার দিয়ে কোন উদ্দেশ্য পূরণ হবে? উপরন্তু, এতদিন সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ভারতের জন্য অস্বস্তিকর কথাবার্তার পর ২০১৫ সালের ছবি দিয়ে কি নরেন্দ্র মোদিকে খুশি করা যাবে? বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং নতুন দল এনসিপি সমর্থকরাই বা ইউনূস-মোদি সাক্ষাৎ নিয়ে কেন এত উচ্ছ্বসিত? যাই হোক, অভ্যুত্থানের আলোকচিত্র ও গ্রাফিতি বইয়ের বদলে ব্যক্তিগত সংগ্রহের ছবি উপহারের কূটনীতি ভারতকে খুশি করতে চাওয়ারই বার্তা দেয়।
সরকারের প্রতিশ্রুতি ঠিক থাকলে, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হবে। রাজনীতির ময়দানে এ নিয়ে আলোচনা কম নয়। তবে কি সব দলই মনে করছে, আমাদের নির্বাচনে ‘ভারত ফ্যাক্টর’ আগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ?
জো বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সেলফি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড় তুলতে পারলেও ওই সরকারের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক উন্নয়নে সেলফিটি তেমন কাজে আসেনি। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহই তার প্রমাণ। এই প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূসের ‘ছবি কূটনীতি’ কতটা সফল হবে– এ প্রশ্ন কেউ তুললে তাকে অন্তত তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zobaidanasreen@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক টন ত ইউন স র উপহ র দ র জন ত ক টন ত এতদ ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানের কত পারমাণবিক স্থাপনা রয়েছে, কোথায় সেগুলোর অবস্থান
ইরানের রাজধানী তেহরানের বিভিন্ন শহরে আজ শুক্রবার ভোররাতে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। পারমাণবিক কর্মসূচির মূল কেন্দ্র লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এ হামলার আগে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বিভিন্ন সময় ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি দ্রুত সম্প্রসারণ করছে—ক্রমবর্ধমান এই আশঙ্কার কারণেই মূলত এসব বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
২০১৫ সালে ছয় প্রভাবশালী দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি হয়। ওই চুক্তিতে ইরানকে পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত রাখার শর্ত দেওয়া হয়। বিনিময়ে দেশটির ওপর থেকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পর থেকে ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি উল্লেখযোগ্যভাবে জোরদার করেছে।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইরানে মোট সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত ছিল প্রায় ৯ হাজার ২৪৭ দশমিক ৬ কেজি বা ২০১৫ সালের চুক্তিতে নির্ধারিত সীমার চেয়ে ৪৫ গুণ বেশি।
মোট মজুতকৃত ইউরেনিয়ামের মধ্যে ৪০৮ দশমিক ৬ কেজি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করেছে ইরান, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে প্রযোজ্য সমৃদ্ধকরণের চেয়ে সামান্য কম। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য ইউরেনিয়াম ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করতে হয়।
২০২১ সালের এপ্রিল মাসে নাতাঞ্জ পারমাণবিক কর্মসূচি কেন্দ্রে একটি হামলা হয়। এ হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে ইরান।ভিয়েনাভিত্তিক সংস্থা আইএইএ-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, তাত্ত্বিকভাবে ইরানের কাছে বর্তমানে যে পরিমাণ অস্ত্র তৈরির উপযোগী ইউরেনিয়াম রয়েছে, আরও কিছু পরিশোধন করলে তা দিয়ে দেশটি প্রায় ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারবে।
তবে ইরান বরাবরই এ কথা অস্বীকার করে আসছে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কোনো অভিপ্রায় নেই বলে জানিয়েছে দেশটি।
নিচে ইরানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনার তালিকা দেওয়া হলো, যেগুলো জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক দল নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে:
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র০১. নাতাঞ্জ
তেহরান থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত নাতাঞ্জ ইরানের মূল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। এটি গভীরভাবে সুরক্ষিত (বাংকারযুক্ত) একটি স্থাপনা। কেন্দ্রটির অস্তিত্ব প্রথম সামনে আসে ২০০২ সালে।
নাতাঞ্জের দুটি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে প্রায় ৭০টি সেন্ট্রিফিউজের সারি আছে। এর মধ্যে একটি কেন্দ্রের কার্যক্রম ভূগর্ভে পরিচালিত হয়। সেন্ট্রিফিউজ হলো এমন যন্ত্র, যা ব্যবহার করে ধাপে ধাপে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হয়।
২০২১ সালের এপ্রিলে নাতাঞ্জ পারমাণবিক কর্মসূচি কেন্দ্রে একটি হামলা হয়। এ হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে ইরান।
আজ শুক্রবার ভোররাতে এই কেন্দ্রে হামলা চালায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। কেন্দ্রটির পাশাপাশি সেখানে অবস্থানরত পরমাণুবিজ্ঞানীদেরও নিশানা করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
আইএইএ–এর প্রধান রাফায়েল গ্রোসি নিশ্চিত করেছেন, যেসব স্থান লক্ষ্য করে হামলা করা হয়েছে, তার মধ্যে একটি নাতাঞ্জ।
মধ্য ইরানের পবিত্র শহর কোমের কাছে একটি পাহাড়ের নিচে গোপনে নির্মিত পারমাণবিক কর্মসূচি কেন্দ্র ফোর্ডো ২০০৯ সালে প্রথম প্রকাশ্যে আসে। এটি জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে তৈরি করা হয়।ফোর্ডো
মধ্য ইরানের পবিত্র শহর কোমের কাছে একটি পাহাড়ের নিচে গোপনে নির্মিত পারমাণবিক কর্মসূচি কেন্দ্র ফোর্ডো ২০০৯ সালে প্রথম প্রকাশ্যে আসে। এটি জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে তৈরি করা হয়।
প্রাথমিকভাবে এটিকে ‘জরুরি’ স্থাপনা হিসেবে বর্ণনা করা হলেও পরে ইরান জানায়, এটি একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। সম্ভাব্য বিমান হামলা থেকে রক্ষার জন্য মাটির নিচে এটি নির্মাণ করা হয়। এই কেন্দ্রে প্রায় তিন হাজার সেন্ট্রিফিউজ বসানো সম্ভব।
২০২৩ সালে এই কেন্দ্রে ৮৩ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের কণা পাওয়া যায়। ইরানের দাবি, পরিশোধন প্রক্রিয়ায় অনিচ্ছাকৃত তারতম্যের কারণে এমনটি হয়েছে।
আরও পড়ুনইরানে ইসরায়েলের হামলার লক্ষ্যবস্তু কী, কারা জড়িত, নিহত কারা ৮ ঘণ্টা আগেইরানের বুশেহর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র