ফেব্রুয়ারি মাস গত হলেই বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের আলাপ-আলোচনা ম্রিয়মাণ হতে শুরু করে। অথচ বাংলা ভাষা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা, যেটি বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মুখের ভাষা। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে রক্ত দিয়ে অর্জিত হলেও এই ভাষা আজও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যথাযথ মর্যাদা পায়নি। উচ্চশিক্ষা, প্রশাসন ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইংরেজির আধিপত্য বাংলার ব্যবহারকে করছে সংকুচিত। অথচ জাপান, জার্মানি বা ফ্রান্সের মতো দেশ তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশাসন চালিয়ে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। অথচ এত বছরে আমরা কেন তা পারিনি? বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জগুলো কী? তা উত্তরণের কৌশলগুলো কী, এটি নিয়েই আজকের আলাপ। 

এক.


ইউনেস্কোর ২০০৩ সালের প্রতিবেদন ‘এডুকেশন ইন আ মাল্টিলিংগুয়াল ওয়ার্ল্ড’ অনুযায়ী, মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা শিশুর জ্ঞানার্জনের ভিত্তি তৈরি করে। জাপান, জার্মানি ও ফ্রান্স এ নীতিকে কাজে লাগিয়েছে। জাপানের ৯০ শতাংশ উচ্চশিক্ষা কোর্স জাপানি ভাষায় পরিচালিত হয়, যা তাদের জিডিপিকে ৫.১ ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে গেছে (বিশ্বব্যাংক, ২০২২)। জার্মানির ৮৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় কোর্স জার্মান ভাষায় পরিচালনা করা হয়, ফ্রান্সে এ হার ৮০ শতাংশ। এই দেশগুলোর সাফল্য প্রমাণ করে, মাতৃভাষায় শিক্ষা ও গবেষণা জাতীয় উন্নয়নের চাবিকাঠি। অথচ বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় বাংলার ব্যবহার মাত্র ১০-১৫ শতাংশ (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, ২০২১)।  
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ৯৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে বাংলায় শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালিত হলেও উচ্চশিক্ষায় এই চিত্র ভিন্ন। গবেষণা বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকসের (ব্যানবেইস) ২০২০ সালের জরিপ অনুযায়ী, প্রকৌশল ও চিকিৎসা শিক্ষার ৯০ শতাংশ কোর্স ইংরেজিতে পরিচালিত হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় সব প্রোগ্রামের শিক্ষাক্রমই ইংরেজি মাধ্যমে প্রণীত এবং সে মাধ্যমেই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সর্বস্তরে এই ইংরেজি ব্যবহারের প্রধান কারণের মধ্যে রয়েছে– আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চাপ, বাংলায় শিক্ষা উপকরণের অভাব এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক নির্ভরতা। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক তৌফিক রহমান তাঁর গ্রন্থ ‘ল্যাঙ্গুয়েজ পলিসি অ্যান্ড এডুকেশন ইন সাউথ এশিয়া’ (২০১০)-তে উল্লেখ করেছেন, ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতা ও বিশ্বায়নের চাপে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মাতৃভাষাকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে।’ কিন্তু বাংলা ভাষার যে প্রাণপ্রাচুর্য, তা কি বিশ্বদরবারে সম্মুখভাগে অবস্থানের যোগ্য নয়!
যেমন– বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ইতিহাস আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম, তার অন্যতম প্রমাণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’। যার ইংরেজি অনুবাদ নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম, জহির রায়হান, বুদ্ধদেব বসু, অমিতাভ ঘোষ, মহাশ্বেতা দেবী, ঝুম্পা লাহিড়ী, হুমায়ূন আহমেদ, সমরেশ মজুমদার বা সৈয়দ শামসুল হকের রচনা বিশ্বসাহিত্যে যে প্রভাব ফেলেছে, তা তুলনায় সীমিত। ইউনেস্কোর তথ্যমতে, বিশ্বের ৪০ শতাংশ ভাষা আজ বিলুপ্তির পথে। কিন্তু বাংলা এই তালিকায় নেই। বরং বাউল সংগীত ২০০৫ সালে ইউনেস্কোর ‘অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ তালিকায় স্থান পেয়েছে। 

দুই.
বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলার এই অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশ কিছু কৌশল প্রয়োগ করে সুফল পেতে পারি। বাংলাদেশ সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক বইমেলা, চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলার উপস্থাপনা বাড়াতে পারে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসব, ওপেন অ্যাকসেস মিডিয়া কিংবা নেটফ্লিক্সের মতো জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মে ‘সত্যজিৎ রায়ের ক্ল্যাসিকস’ থেকে শুরু করে ‘মাটির ময়না’, ‘রেহানা মারিয়াম নুর’, ‘মুক্তধারা’ বা ‘ডুব’-এর মতো বাংলা চলচ্চিত্রে সাবটাইটেল যুক্ত প্রদর্শনী বরাবরের মতো বিশ্বের দর্শকের কাছে বাংলা সংস্কৃতি পৌঁছে দিতে পারে; সঙ্গে প্রযুক্তিগত উদ্যোগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুগলের তথ্য অনুসারে, ইন্টারনেটে বাংলা কনটেন্টের পরিমাণ গত দশকে ৩০০ শতাংশ বাড়লেও এখনও মোট কনটেন্টের ০.১ শতাংশের কম বাংলায় রয়েছে। উইকিপিডিয়ায় বাংলা নিবন্ধের সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার, যা ইংরেজির (৬৫ লাখ) তুলনায় নগণ্য। এ অবস্থায় এআইভিত্তিক টুল যেমন– বাংলা এনপিএল (প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ) উন্নয়ন করে বাংলা ভাষার ডিজিটাল রিসোর্স বাড়ানো যেতে পারে। ডুয়োলিঙ্গর ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এআই প্ল্যাটফর্মে বাংলা ভাষা শেখার মডিউল যুক্ত হলে ১০ লাখ ব্যবহারকারী এতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। এ ছাড়া গুগল আর্টস অ্যান্ড কালচারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, বিভিন্ন গণঅভ্যুত্থান, বিপ্লবের সাহসী গল্প, ইতিহাস এবং ঐতিহ্য ঘেরা বিভিন্ন স্থাপনার ভার্চুয়াল গ্যালারি আকারে উপস্থাপন করা গেলে আন্তর্জাতিক ব্যবহারকারীদের কাছে বাংলার ইতিহাস পৌঁছাবে।  


অন্যদিকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে যুক্ত করার দাবি দীর্ঘদিনের। বর্তমানে বাংলা ইউএনের ‘ইনফরমাল ডে’ পালন করে, কিন্তু আরবি বা স্প্যানিশের মতো দাপ্তরিক মর্যাদা পায়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই লক্ষ্যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করতে পারে। ইউনেস্কোর ‘অ্যাটলাস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ ‘ল্যাঙ্গুয়েজেস ইনডেঞ্জার’ (২০১৭) অনুযায়ী, বাংলা ‘নিরাপদ ভাষা’র তালিকায় থাকলেও এর আন্তর্জাতিকীকরণে রাষ্ট্রীয় নীতির অভাব স্পষ্ট। অথচ ফ্রান্স তাদের ভাষা প্রচারে বিশ্বজুড়ে ‘আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ’ প্রতিষ্ঠা করেছে। একই মডেলে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে ‘বাংলা কালচারাল সেন্টার’ চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে এক কোটির বেশি বাংলাভাষী প্রবাসী আছেন, যাদের মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক বা যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বাংলা বইমেলা, নাট্যোৎসব বা কবিতা পাঠের আয়োজন করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সাংস্কৃতিক বন্ধন তৈরি করা যায়। প্রবাসী লেখক ঝুম্পা লাহিড়ী যেমন তাঁর লেখনীতে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আন্তর্জাতিক পাঠকদের কাছে বাংলার গল্প পৌঁছে দিয়েছেন। তেমনিভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বাংলা কালচারাল অ্যাম্বাসাডর’ প্রোগ্রাম চালু করে প্রবাসীদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।  

তিন.
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় বাংলা মাধ্যম ব্যবহারের যে অনীহা, তা দূর করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমেও বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক তাৎপর্য বাড়ানো যেতে পারে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রেক্ষিত পর্যালোচনা করে আন্তরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলায় পাঠ পরিচালনার হার বাড়াতে ‘বাংলা মিডিয়াম একাডেমিক এক্সিলেন্স প্রোগ্রাম’ চালু করা যেতে পারে। 


এ ক্ষেত্রে সরকারি এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয় বই-পুস্তক ও উপকরণ বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। এর জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। একই সঙ্গে দেশে বাংলা ভাষা জানা লোকদের সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষিতে সব অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা যেভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে এবং বাংলা জানা লোকেরা পিছিয়ে পড়ছে, তা রোধ করতে উদ্যোগ নিতে হবে। আইইইই বা স্প্রিংগারের মতো প্রকাশনীর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাংলা গবেষণাপত্রের ডিজিটাল লাইব্রেরি তৈরি করা যেতে পারে। এমনকি হার্ভার্ড বা অক্সফোর্ডের মতো বিশ্বনন্দিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘বাংলা স্টাডিজ’ বিভাগ চালু হলে পশ্চিমা শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা ও ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন। 


হার্ভার্ড বা অক্সফোর্ডের মতো বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা স্টাডিজ বিভাগ চালু করা একেবারে অসম্ভব নয়, তবে এটি নির্ভর করে একাডেমিক অগ্রাধিকার, ফান্ডিং এবং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের ওপর। ২০২৩ সালের তথ্যমতে, হার্ভার্ডে ৮০টির বেশি ভাষা শেখার সুযোগ আছে, যার মধ্যে বাংলাও অন্তর্ভুক্ত। আবার অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে এশিয়ান অ্যান্ড মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ ফ্যাকাল্টিতে দক্ষিণ এশিয়া, চীন, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যের ভাষা ও সংস্কৃতি পড়ানো হয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে চায়নিজ স্টাডিজ, আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ, অক্সফোর্ডের জাপানি স্টাডিজ বিভাগগুলো প্রতিষ্ঠার পেছনে ওই দেশগুলোর অর্থনৈতিক শক্তি, সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রধান ভূমিকা রেখেছে। 
এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে কয়েকটি করণীয় নির্ধারণ করা যেতে পারে। এক. বাংলাদেশ সরকার শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে হার্ভার্ড/অক্সফোর্ডের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সম্পাদন করতে পারে এবং ‘বাংলা বিভাগ’ প্রতিষ্ঠার জন্য বার্ষিক ফান্ড বরাদ্দ করে ভূমিকা রাখতে পারে।


চার.
বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতিষ্ঠা করতে সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও কূটনীতির সমন্বয়ে বহুমুখী উদ্যোগ প্রয়োজন। সরকারি নীতি নির্ধারণ, বেসরকারি সংস্থার অংশগ্রহণ এবং বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টাই শুধু এ লক্ষ্য অর্জন করতে পারে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গ্লোবাল প্রোফাইল এবং বাংলার সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যেমনটি বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘যেখানে সেখানে ডাল ভাঙিসনে ভাই, ফুল ফুটতে দে...’– বাংলা ভাষার ফুলকে বিশ্বমঞ্চে ফুটতে দিতে এই প্রচেষ্টাই হতে পারে প্রথম পদক্ষেপ।

শারীফ অনির্বাণ: পিএইচডি গবেষক, দকুজ এয়লুল ইউনিভার্সিটি, ইজমির, তুরস্ক ও প্রভাষক, শিক্ষা বিভাগ, প্রাইম ইউনিভার্সিটি
sharifulislam@primeuniversity.edu.bd 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইউন স ক র পর চ ল ত ব সরক র ব যবহ র মন ত র অন য য় গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

ছয় কোটি শ্রমিক রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে

দেশের মোট শ্রমিকের ৮৪ দশমিক ১ শতাংশের কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না রাষ্ট্র । শ্রমিক হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। কোনো রকম আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা নেই। কর্মস্থলের পরিচয়পত্র নেই। কাজের ক্ষেত্রে অন্যায়ের শিকার হলে তাদের শ্রম আদালতে মামলা করার সুযোগও নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী,  অপ্রাতিষ্ঠানিক এই শ্রমিকের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার।

বিশালসংখ্যক শ্রমিকের প্রতি রাষ্ট্রের এ রকম অবহেলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত ২১ এপ্রিল পেশ করা কমিশনের ২৫ সুপারিশের মধ্যে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। 

দেশের শ্রম খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং শ্রমিকের অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত ১৯ সদস্যের কমিশনপ্রধান ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমরা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। শ্রম আইনে অন্য সব শ্রমিকের মতো একই অধিকার এবং সুযোগসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছি। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তাদের জন্য ভাতার কথা বলেছি। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের জন্য এ সুবিধার সুপারিশ করা হয়নি। কারণ, তারা চাকরি শেষে কমবেশি কিছু আর্থিক সুবিধা পান।’ 

কমিশনের এ সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে নিয়মিত নজরদারি রাখার কথাও জানান তিনি। 

এ বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার মহান শ্রমিক দিবস পালন করা হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটি থাকবে। এ দিনও কাজ করতে হবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দিবসটি পালনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’। 

বিবিএসের গত নভেম্বরে প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১২ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার। তাদের মধ্যে শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। 

দেশে শ্রমশক্তি বলতে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে যারা কর্মে নিয়োজিত এবং বেকার জনগোষ্ঠীর সমষ্টিকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর মানদণ্ড অনুযায়ী, যারা সাত দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টার বেতন, মজুরি বা মুনাফার বিনিময় অথবা পরিবারের নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদনের কাজ করেছেন জরিপে তাদের কর্মে নিয়োজিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার যারা কর্মক্ষম কিন্তু কোনো কাজে নিয়োজিত নন, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ খুঁজে বেড়ান এবং ওই সময়ে কাজের সুযোগ পেলে সে কাজ করতে প্রস্তুত তাদের বেকার বলা হয়েছে। এ হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার। 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক কারা 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যানবিদের সম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব লেবার স্ট্যাটিসিয়ান্স–আইসিএলসির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেসরকারি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা খানামালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর আইনি সত্তা নেই, পরিপূর্ণ হিসাব নেই, উৎপাদনের হিসাব দিতে হয় না এবং বেসরকারি ও অনিবন্ধিত–এরকম খাতকে অনানুষ্ঠানিক খাত এবং এ খাতের শ্রমিকদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক বলা হয়। 

মূলত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক বেশি। কৃষিতে ৯৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। শিল্প খাতে ৮২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বড় অংশই গ্রামে থাকেন। 

বিবিএস বলছে, গ্রামের মোট শ্রমিকের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সংখ্যায় তারা ৪ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার। শহরের শ্রমিকদের এ হার কিছুটা কম। ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সংখ্যায় এক কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার। নারী শ্রমিকদের ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকেন।

শ্রম আইনে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ কমিশনের 

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহশ্রমিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য শ্রম আইনে সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে শ্রমিকদের কাজের স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র, নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, এসব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা হিসেবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সব অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলাদা অফিস অথবা ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সব ধরনের তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার করা, পরিচয়পত্র দেওয়া এবং অবসর ভাতা চালুসহ বেশ কিছু সুপারিশ করে কমিশন। 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রবীণ শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতার সুপারিশ 

রাষ্ট্রের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের আওতায় বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা। অবসরের পরও কিছু সুবিধা পান তারা। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা সারা জীবন খাটুনির পর প্রবীণ বয়সে আরও কষ্টে থাকেন। কারণ সামান্যতম কোনো সুবিধা পান না তারা। এ বিবেচনা থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতা বা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণের কথা বলা হয় এতে। দরিদ্র বেকার শ্রমিকদের বয়স্কভাতা এবং তাদের প্রতিদিনের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও অন্যান্য চাহিদা বিবেচনায় বয়স্কভাতার পরিমাণ নির্ধারণের কথা বলেছে কমিশন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের পেশা ও খাত অনুযায়ী সংগঠিত হওয়া, প্রতিনিধিত্ব করা ও নিয়োগকারী, তাদের সমিতি করার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয় কমিশনের সুপারিশে। 

প্রাতিষ্ঠানিকের ৫৫ খাতেও ন্যূনতম মজুরি নেই 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। এখনও অনেক শিল্প খাতকে ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর আওতায় আনা হয়নি। মালিকপক্ষ যা দেয়, তা মেনে নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। এরকম অন্তত ৫৫টি খাতে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়নি। 

শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের স্বীকৃত শিল্প আছে ১০২টি। 

টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের মজুরি বোর্ড হয় সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে। অর্থাৎ, গত তিন যুগ ধরে একই মজুরি চলছে এ খাতে। জানতে চাইলে সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা ইসলাম গতকাল সমকালকে বলেন, ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে বর্তমানে ৪৭টি শিল্প রয়েছে। নতুন করে দুটি শিল্পকে ন্যূনতম মজুরির আওতায় আনা হবে। আরও ২০ শিল্পকে এর আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি পুনঃনির্ধারণে বোর্ড গঠন হয়েছে। মালিক পক্ষ এ-সংক্রান্ত সভায় আসছে না। এ অবস্থায় করণীয় জানতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়েছে মজুরি বোর্ড। 

টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পে তিন যুগ ধরে একই মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে রাইসা ইসলাম বলেন, টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের আর অস্তিত্ব নেই। খাতটি হয়তো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ