তিয়ানশির জালে কুমিল্লার শিক্ষার্থীরা, স্বপ্ন দেখিয়ে প্রতারণা
Published: 15th, April 2025 GMT
মাত্র ছয় বছর বয়সে বাবাকে হারান ফামিদুল হাসান। কিশোর বয়স থেকে পরিবার চালানোর দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। গ্রামের বাড়ি চৌদ্দগ্রাম থেকে স্বপ্ন নিয়ে কুমিল্লা শহরে এসেছেন, ভর্তি হয়েছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগে। ক্লাস শেষে ছুটে বেড়ান টিউশনি করতে, সেই টাকায় চলে থাকা, পড়াশোনা, আর অসুস্থ মায়ের ওষুধ কেনা।
ভালো চাকরি করে মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর আশাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু সেই স্বপ্নটাই এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে ঘুরপাক খায় ফামিদুলের মনে। কারণ, ‘ভালো চাকুরি’ ও ‘লাখপতি হওয়ার’ প্রলোভনে পড়ে নিজের টিউশনির টাকা দিয়ে বিনিয়োগ করেন ‘তিয়ানশি’ নামের এক তথাকথিত চাইনিজ কোম্পানিতে।
প্রতিবেদককে ফামিদুল বলেন, “আমি শুধু একটা ভালো জীবন চেয়েছিলাম। মাকে ভালো রাখতে চেয়েছিলাম। এখন তো তাকে বলতেও পারি না— ওই টাকাটা আমি হারিয়ে ফেলেছি…”
আরো পড়ুন:
কুয়েটের ৫ হলের তালা ভাঙলেন শিক্ষার্থীরা, ভিসির পদত্যাগের একদফা
রাজশাহীতে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ
এই গল্প শুধু ফামিদুলের একার নয়। তাঁর মতো শত শত শিক্ষার্থী আজ একই প্রতারণার শিকার। নিষিদ্ধ মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি ‘তিয়ানশি’ আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে কুমিল্লায়। নগরীর কান্দিরপাড় এলাকার খন্দকার টাওয়ারের ৮ম তলায় চলছে নিয়মিত সভা, প্রশিক্ষণ ও পণ্যের প্রচার। সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চক্রটি রীতিমতো ‘চাকরি ও বিদেশ’–এর নামে ফাঁদ পাতছে শিক্ষার্থীদের জন্য।
২০১৫ সালে সরকার বাংলাদেশে এমএলএম ব্যবসা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তিয়ানশি তার কার্যক্রম বন্ধ করলেও, সম্প্রতি আবার ‘চাইনিজ হেলথ প্রোডাক্ট’ এর মোড়কে চালু করেছে প্রতারণা। প্রতিষ্ঠানটি সদস্য সংগ্রহে ব্যবহার করছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত মুখ, ‘বড় ভাই’ বা ‘আপু’দের। শুরুতে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা ‘ইনভেস্টমেন্ট’ চাওয়া হয়, পরে ধাপে ধাপে আদায় করা হয় আরও হাজার হাজার টাকা।
ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী নুসরাত জাহান বলেন, ‘‘মেসে ওঠার পর এক আপু পরিচয় দেয় তিয়ানশির। সেমিনারে গিয়ে শুনি বিদেশে যাওয়ার সুযোগ, লাখপতি হওয়ার স্বপ্ন। আমি ২০ হাজার টাকা দিয়েছি। এখন বুঝতে পারছি, এ তো একটা ফাঁদ ছিল।”
তিয়ানশির পণ্যের মধ্যে রয়েছে হারবাল চা, ব্যথানাশক তেল, দাঁতের পেস্ট, ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ইত্যাদি। এসব পণ্য স্থানীয় বাজারে ৩০-৫০ টাকা মূল্যের হলেও বিক্রি করা হয় ৪০০-৫০০ টাকায়। নেই কোনো প্রমাণিত গুণগত মান, বিএসটিআই অনুমোদনও মেলে না।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তামান্না আক্তার বলেন, “তিয়ানশির মতো চক্র কেবল টাকা নয়, শিক্ষার্থীদের স্বপ্নও ছিনিয়ে নেয়। আমরা যারা পরিবারকে সাহায্য করতে চাই, জীবনে কিছু হতে চাই, তাদের জন্য এসব প্রলোভন ভয়ানক। একবার ঢুকে গেলে বের হওয়া মুশকিল।”
তিয়ানশির স্থানীয় এক কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমরা প্রোডাক্ট বিক্রি করি, কেউ চাইলে মেম্বার হয়। জোর করে টাকা নেই না। তিয়ানশি ৩৩ বছর ধরে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করছে।”
তবে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান রওনক আরা বেগম বলেন,
“এই চক্রগুলো তরুণদের এমনভাবে আকৃষ্ট করে যেন জীবন বদলে যাবে। বাস্তবে তারা হারায় অর্থ, সময় আর আত্মবিশ্বাস। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসন ও অভিভাবকদের সমন্বয়ে এদের থামাতে হবে।”
বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক ডা.
জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমাদের কাছে কিছু তথ্য এসেছে। যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. সাইফুল মালিক বলেন, “তিয়ানশির বিষয়ে আমরা এখনো কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।”
ঢাকা/বকুল
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিষ্ঠার দেড় যুগ পর ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছে বেরোবি
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ব্রাকসু) নিয়ে অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চলেছে শিক্ষার্থীদের। গত ২৮ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মাধ্যমে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের গেজেট প্রকাশ হয়ছে গঠনতন্ত্র।
এরই মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৭ বছর পর হতে যাচ্ছে কাঙিক্ষত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ তথা ব্যাকসু নির্বাচন। তবে এর জন্য আমরণ অনশন থেকে শুরু করে সব ধরনের কর্মসুচিই পালন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
আরো পড়ুন:
‘আমরা একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করতে চাই’
বেরোবিতে শহীদ আবু সাঈদ স্মৃতিস্তম্ভের মডেল প্রদর্শন
জুলাই অভ্যুত্থান পর গণরুম ও গেস্ট রুমের যে সাংস্কৃতি ছিল, তা এখন বন্ধ হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের কমকাণ্ডে সামিল হওয়াও বাধ্যতামুলক নয়।
তাই শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ ছাত্র সংসদ। যাতে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষিত হবে।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বেরোবির বিধিমালা অনুযায়ী, ১৩টি পদে সরাসরি নির্বাচন ও হল সংসদে নয়টি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে সব ধরনের কথা তুলে ধরতে পারবেন।
পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী শেখর রায় বলেন, “সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও লেজুরবিত্তিক রাজনীতি ব্যতীত একটি নির্বাচন হোক। যোগ্য, আদর্শ, উত্তম চরিত্র ও মনের প্রার্থী বিজয়ী হোক। নির্বাচিত হয়ে তারা হয়ে উঠুক বেরোবির একেকজন যোগ্য প্রতিনিধি। তারা ন্যায়ের পক্ষে থাকুক । তাদের হাত ধরেই এগিয়ে যাক বেরোবি।”
গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী জাওয়াদ সাজিদ বলেন, “ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের দাবি, অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার প্রধান মঞ্চ। এটি প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে, যাতে প্রতিটি শিক্ষার্থীর কণ্ঠ পৌঁছে যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের টেবিলে। কিন্তু এজন্য সংসদকে দলীয় প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে। প্রকৃত অর্থে ছাত্র সংসদ তখনই সফল, যখন তা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হয়ে তাদের সমস্যার সমাধান ও কল্যাণে কাজ করে।”
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান বলেন, “আমরা এমন ছাত্র সংসদ চাই, যেখানে যোগ্য নেতৃত্ব আসবে এবং সব শিক্ষার্থীর সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার হয়ে কাজ করবে। সবমিলিয়ে সবার বিশ্বস্ত জায়গা হবে এই ছাত্র সংসদ।”
ঢাকা/সাজ্জাদ/মেহেদী