মধ্যপ্রাচ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার’ হচ্ছে গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করা—বলছে হোয়াইট হাউস। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট চলতি সপ্তাহে যখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে স্বাগত জানালেন, তখন দুই নেতাই একে অপরের প্রশংসা করেছেন।

এদিকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজায় ইসরায়েল হামলা অব্যাহত রেখেছে। উপত্যকাটিতে এ পর্যন্ত ৫৭ হাজার ৫৭৫ জনের বেশি নিহত হয়েছেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্প যদি সত্যিই গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চান, তাঁকে ইসরায়েলকে দেওয়া মার্কিন সামরিক সহায়তা কাজে লাগিয়ে নেতানিয়াহুর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ব্রায়ান ফিনুকেন ট্রাম্পের বার্তাকে তাঁর পূর্বসুরি জো বাইডেনের দ্ব্যর্থপূর্ণ বার্তার সঙ্গে তুলনা করেছেন। ফিনুকিন বলেন, দুজনই যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছিলেন; কিন্তু যুদ্ধ বন্ধে ইসরায়েলকে চাপ দিতে তাঁরা অনিচ্ছুক।

এ যেন বাইডেন প্রশাসনের পুরোনো দৃশ্যপটের পুনরাবৃত্তি। আপনি হোয়াইট হাউস থেকে একই ধরনের ঘোষণা শুনবেন; কিন্তু বাস্তবে দৃশ্যপট বদলায় না। যুদ্ধবিরতিই যদি সত্যি হোয়াইট হাউসের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হয়, তবে তা কার্যকর করার জন্য তাদের যথেষ্ট চাপ প্রয়োগের ক্ষমতাও আছে।ব্রায়ান ফিনুকেন, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা

ফিনুকেন বলেন, ‘এ যেন বাইডেন প্রশাসনের পুরোনো দৃশ্যপটের পুনরাবৃত্তি। আপনি হোয়াইট হাউস থেকে একই ধরনের ঘোষণা শুনবেন; কিন্তু বাস্তবে দৃশ্যপট বদলায় না। যুদ্ধবিরতিই যদি সত্যি হোয়াইট হাউসের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হয়, তবে তা কার্যকর করার জন্য তাদের যথেষ্ট চাপ প্রয়োগের ক্ষমতাও আছে।’

যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দেয় এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে কূটনৈতিকভাবে তাদের পক্ষ নেয়।

যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা চলতি সপ্তাহে গাজায় ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেছেন। এটা স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দিকে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। তবে ওয়াশিংটনে নেতানিয়াহু সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘গাজায় কাজ এখনো শেষ হয়নি। হামাসকে নির্মূল করতেই হবে।’

শুরু থেকেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ট্রাম্পের অহমিকাকে তুষ্ট করার কৌশল নেন। ওই দিন রাতে হোয়াইট হাউসের নৈশভোজে তিনি ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়েছেন বলে ঘোষণা করেন।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক আইনজীবী ফিনুকেন নেতানিয়াহুর এ মন্তব্যকে ‘খুবই বাগাড়ম্বরপূর্ণ’ ও ‘অস্পষ্ট’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ট্রাম্প চাইলে ইসরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধ করতে চাপ দিতে পারেন। সামরিক সহায়তা স্থগিত করার হুমকিও ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি হবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে এবং প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক সাফল্য অর্জনের জন্যও সহায়ক।

ট্রাম্প–নেতানিয়াহুর একই সুর

নেতানিয়াহু গত সোমবার ওয়াশিংটনে পৌঁছানোর পর ট্রাম্পের সঙ্গে একজোট হয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার জন্য ‘বিজয় উদ্‌যাপন’ করেছেন।

শুরু থেকেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ট্রাম্পের অহমিকাকে তুষ্ট করার কৌশল নেন। ওই দিন রাতে হোয়াইট হাউসের নৈশভোজে বসে তিনি ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়েছেন বলে ঘোষণা করেন।

শুধু মৌখিকভাবে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে গাজায় নৃশংসতা বন্ধ করা যাবে না। যদি এর সঙ্গে পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, যেমন ইসরায়েলকে সাহায্য বা অস্ত্রের সরবরাহ স্থগিত করা; তবে নেতানিয়াহুর শান্তি আলোচনায় গুরুত্বের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।ন্যান্সি ওকাইল, সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির (সিআইপি) সভাপতি

পরদিন মঙ্গলবার এ দুই নেতা আবারও সাক্ষাৎ করেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, তাঁদের আলোচনা গাজা ও যুদ্ধবিরতি নিয়ে। এর এক দিন পর নেতানিয়াহু বলেন, তাঁরা গাজা নিয়ে পুরোপুরি ‘একমত’।

নেতানিয়াহু বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি সমঝোতা চান; তবে যেকোনো মূল্যে নয়। আমিও একটি সমঝোতা চাই; কিন্তু যেকোনো মূল্যে নয়। ইসরায়েলের নিরাপত্তা চাহিদা আছে এবং আমরা একসঙ্গে তা সমাধানের চেষ্টা করছি।’

মার্কিন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্র্যাফটের রিসার্চ ফেলো অ্যানেল শেলিন বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির পথে প্রধান বাধা প্রকৃতপক্ষে ইসরায়েল। হামাস ইতিমধ্যে যুদ্ধের স্থায়ী সমাপ্তির দাবি জানিয়েছে, যেটা ট্রাম্প প্রশাসন চাইছে।’

অ্যানেল শেলিন বলেন, ‘ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির কথা বললেও এখনো পর্যন্ত আমরা দেখিনি যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক প্রভাব কাজে লাগিয়ে তা কার্যকরের জন্য চাপ দিচ্ছেন।’

বরং ট্রাম্প প্রশাসন গর্ব করে বলছে, তারা ভারী বোমার চালান আবারও চালু করেছে। এটি বাইডেন সাময়িকভাবে স্থগিত করেছিলেন।

গাজার ভয়াবহ পরিস্থিতি

যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চললেও গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনকে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছে।

হাসপাতালগুলোর জ্বালানি ফুরিয়ে যাচ্ছে, প্রতিরোধযোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, খাদ্যসংকট চরমে উঠেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত বেসরকারি ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে খাদ্য নিতে গিয়েও শত শত ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের গুলিতে নিহত হচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈদেশিক নীতি গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির (সিআইপি) সভাপতি ন্যান্সি ওকাইল বলেন, ট্রাম্প গাজা যুদ্ধবিরতিতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে; কারণ তিনি শান্তিরক্ষী হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি বাড়ানো ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতে চান।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় ট্রাম্প ইরাক ও আফগান যুদ্ধের পর মার্কিনদের ক্লান্তির কথা বলে বিশ্বে শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে এখন পর্যন্ত তিনি ইউক্রেন ও গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ ছাড়া তিনি ইসরায়েল–ইরান সংঘাতের তত্ত্বাবধান করেছিলেন; এমনকি এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রকে এতে অংশ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ওকাইল বলেন, শুধু মৌখিকভাবে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে গাজায় নৃশংসতা বন্ধ করা যাবে না। তিনি বলেন, ‘যদি এর সঙ্গে পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, যেমন ইসরায়েলকে সাহায্য বা অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত করা; তবে নেতানিয়াহুর শান্তি আলোচনায গুরুত্বের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।’

নেতানিয়াহুর বাস্তুচ্যুতির কৌশল

৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি যদি কার্যকরও হয়, তবু অধিকারকর্মীরা উদ্বিগ্ন। কারণ, সে সময় হয়তো ইসরায়েল গাজাবাসীকে বিতাড়িত ও দখলদারত্ব আরও ব্যাপক করতে চাইবে।

ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস বুধবার জানিয়েছে, তারা প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে ১০ জন ইসরায়েলি বন্দীকে মুক্তি দিতে রাজি। তবে এখনো মূল অচলাবস্থা গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতির নিশ্চয়তা নিয়ে।

ইসরায়েলের হারেৎস পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনে যাওয়ার আগে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ দক্ষিণ গাজায় ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি বন্দিশিবির তৈরির পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেন, ইসরায়েল ‘বহির্গমন পরিকল্পনা’ (ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন) কার্যকর করতে চায়।

মানবাধিকারকর্মীদের মতে, এটি জাতিগত নির্মূলের শামিল ও মানবতাবিরোধী অপরাধ।

গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার এ ধারণা নতুন নয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েলের উগ্রপন্থী মন্ত্রীরা তা প্রকাশ্যে বলে আসছেন। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প গাজাকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরা’ (অবকাশকেন্দ্র বা সাগরসৈকতের শহর) বানানোর স্বপ্নের কথা বলার পর বিশ্বসম্প্রদায় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে শুরু করে।

নেতানিয়াহু এবার সফরের সময়ও বলেছেন, ‘গাজার মানুষ চাইলে অন্য কোথাও চলে যেতে পারে।’

জবরদস্তিমূলক স্থানান্তর

যদিও ট্রাম্প প্রশাসন এ সপ্তাহে গাজায় জাতিগত নির্মূলের পরিকল্পনার প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানায়নি, তবে হোয়াইট হাউস থেকে বক্তব্য এসেছে—ফিলিস্তিনিদের আর গাজায় থাকার উপায় নেই।

ট্রাম্পের মুখপাত্র ক্যারোলিন লেভিট সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ জায়গা এখন মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে এবং প্রেসিডেন্টের হৃদয় অনেক বড়। তিনি চান, এটি একটি নিরাপদ ও সমৃদ্ধ অঞ্চল হোক; যেখানে পরিবারগুলো উন্নতি করতে পারে।’

তবে অধিকারকর্মীরা জোর দিয়ে বলছেন, বোমাবর্ষণের মধ্যেও মৌলিক চাহিদা পূরণের সুযোগ না থাকা মানুষের থাকার কিংবা স্থান ত্যাগ করার ‘স্বাধীন’ পছন্দ থাকতে পারে না।

অ্যানেল শেলিন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আশঙ্কা, ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু গাজায় জাতিগত নির্মূল ও সেখানকার বাসিন্দাদের অন্যত্র স্থানান্তর করার জন্য কাজ করছেন।’

শেলিন আরও বলেন, ‘অনেকেই ধারণা করেছিলেন, হয়তো ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরায়েলকে সহায়তার বিনিময়ে গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য ট্রাম্প চাপ প্রয়োগ (ইসরায়েলের ওপর) করবেন; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তিনি যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে গাজাবাসীকে জোর করে বিতাড়িত করতে চাইছেন।’

ওকাইল বলেন, বোমাবর্ষণ ও অনাহারের হুমকিতে মানুষকে গাজা ছাড়তে বাধ্য করার মানে তাঁদের বন্দুকের মুখে তাড়িয়ে দেওয়া। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির নামে যদি দখলদারি বাড়ানো ও জাতিগত নির্মূলই হয় তাদের উদ্দেশ্য, তবে তারা আদৌ কোনো যুদ্ধবিরতি চায় না; বরং সেটি ধ্বংস করতে চায়।’

আরও পড়ুনআরও ১০ ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিতে রাজি হামাস, হামলায় নিহত ৭৪২২ ঘণ্টা আগেআরও পড়ুনগাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়ানোর পুরোনো খেলায় ট্রাম্প–নেতানিয়াহু০৮ জুলাই ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ ত গত ন র ম ল য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র প য দ ধ বন ধ কর ছ ল ন র র জন য ক র যকর দ শ যপট প রক শ কর ছ ন মন ত র ন বল ন ইসর য ন ইসর

এছাড়াও পড়ুন:

তরুণ ভোটারদের পৃথক বুথের প্রস্তাব সংবিধানসম্মত নয়  

আগের তিন নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় ১৮ থেকে ৩৩ বছর বয়সী ভোটারদের জন্য পৃথক ভোটার তালিকা ও বুথ স্থাপনের প্রস্তাব সংবিধানসম্মত নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এমন নজির বিশ্বের কোথাও নেই। পাশাপাশি এর ফলে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এমনকি নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

গত বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বরাত দিয়ে তাঁর প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৮ থেকে ৩৩ বছর বয়সী ভোটারদের জন্য পৃথক তালিকা ও বুথ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়– তা খতিয়ে দেখতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। যারা প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, যাতে প্রথম ভোটে ভালো স্মৃতি হয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের কোনো দেশেই তরুণ ভোটারদের জন্য ভোটকেন্দ্রে বাড়তি সুবিধা রাখা হয় না। বয়স্ক, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য কিছু সুবিধা রাখা হয়।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণির জন্য পৃথক বুথের অনেক নেতিবাচক দিক রয়েছে। যে কারণে সংবিধানের সপ্তম ভাগে নির্বাচনসংক্রান্ত অনুচ্ছেদে (১২১) বলা আছে, ‘সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রত্যেক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার একটি করে ভোটার তালিকা থাকবে এবং ধর্ম, জাত, বর্ণ ও নারী-পুরুষভেদে ভোটারদের বিন্যস্ত করে কোনো বিশেষ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা যাবে না।’

ভোট গ্রহণ কাজে অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা জানান, সংবিধানের এই নির্দেশনার অনেকগুলো যৌক্তিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, একজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পরে যদি তিনি চিহ্নিত করতে পারেন যে, বিশেষ কোনো ধর্ম, বর্ণ বা পেশার মানুষ তাকে ভোট দিয়েছেন অথবা দেননি তাহলে তিনি সবার ওপর সমান আচরণ করবেন না। এতে নির্বাচনের মূল্য উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।     

ইসি সচিবালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ভোট গ্রহণের সুবিধার্থে কেন্দ্রভিত্তিক নারী ও পুরুষ ভোটারদের পৃথক তালিকা করা হয়। কিন্তু এটাকে নির্বাচনী এলাকার জন্য একটি ভোটার তালিকা হিসেবেই গণ্য করা হয়ে থাকে। তিনি আরও জানান, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের জন্য ১০ জুলাইয়ের মধ্যে মাঠ পর্যায় থেকে ইসি সচিবালয়ের তালিকা পাঠানোর নির্দেশনা ছিল। সে অনুযায়ী ইতোমধ্যেই তালিকা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সাধারণত তিন থেকে পাঁচ হাজার ভোটারের জন্য একটি কেন্দ্র এবং ৪০০ থেকে ৬০০ ভোটারের জন্য একটি বুথ তৈরি করা হয়। ব্যালট পেপারে প্রতি মিনিটে গড়ে একটি করে ভোট গ্রহণ করা হবে– এমন হিসাব ধরে ৮ ঘণ্টায় ৪৮০ মিনিটে প্রায় ৫০০ ভোট নেওয়া সম্ভব বলে ওই কর্মকর্তা জানান। তিনি বলেন, বয়স্ক ভোটার এবং অন্তঃসত্ত্বাদের ভোটের লাইনে আগে দেওয়ার একটি নির্দেশনা থাকে। এর বাইরে বিশেষ কোনো বয়সের ভোটারদের জন্য পৃথক বুথ তৈরির বাস্তবতা নেই।
   
নির্বাচন-সংশ্লিষ্টদের মতে, বিশ্বের কোনো দেশে প্রথম ভোটার বা ৩৩ বছর বয়স পর্যন্ত ভোটারদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা রাখার তথ্য পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশসহ অনেক দেশে নারীদের জন্য পৃথক লাইনের ব্যবস্থা রাখা হয়। নারীরা যাতে ভোট দিতে আগ্রহী হন, সে জন্য বিশেষ প্রচারণা চালানো হয়। উন্নত দেশে বয়স্কদের জন্য বিশেষ প্রবেশপথ, স্বেচ্ছাসেবী, হুইলচেয়ার, ভোটকেন্দ্রে র‍্যাম্প, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল ব্যালট, বড় আকারের ব্যালট পেপার, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সুবিধা এমনকি বাড়িতে গিয়ে ভোট গ্রহণেরও ব্যবস্থা আছে। পোস্টাল ভোটদান এবং অনলাইনে ভোটদানের ব্যবস্থাও আছে কিছু দেশে। দূতাবাসে কর্মরত বা প্রবাসী নাগরিকদের জন্য ভোটের বিশেষ ব্যবস্থা আছে। ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশে প্রক্সি ভোটের ব্যবস্থা আছে।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ভোটের প্রধান বিষয় হলো ভোটকেন্দ্র যেন শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর হয় এবং ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী, বয়স্ক বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য কিছু বাড়তি সুবিধা রাখা প্রয়োজন। কিন্তু বয়স ধরে বিশেষ ব্যবস্থা বাস্তবসম্মত নয়। নির্বাচন কমিশন সংস্কার প্রস্তাবেও এ রকম কিছু তারা বলেননি।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলিম বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে জন্ম নেওয়া দেশগুলোতে অনলাইনে ভোট দেওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসীরা অনলাইনে ভোট দিতে পারেন। ফ্রান্সে মনোনীত ব্যক্তিকে দিয়ে প্রক্সি ভোট দেওয়ার বিধান আছে। বয়স্ক, প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক জায়গায় অনেক সুবিধা আছে। কিন্তু ১৮ থেকে ৩৩ বছর বয়সী ভোটারদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা কখনও শুনিনি।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘এটা শুনে অবাক হয়েছি। বিষয়টি রহস্যজনক। বিশেষ উদ্দেশ্যে এটা করা হতে পারে। এটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডেরও (সবার জন্য সমান সুযোগ) অন্তরায়। এটা সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। একজন শোষকের ভোটেরও যে মূল্য, শোষিতের ভোটেরও একই মূল্য। ধনী বা শ্রমিকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। 

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক বলেন, ‘এ ধরনের কথা আমি জীবনেও শুনিনি। নিয়ম হলো, যারা বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে পড়েছে তাদের জন্য সুবিধা দেওয়া। এ রকম উদ্ভট চিন্তাভাবনা দুনিয়ার কোথাও নেই। এভাবে করলে অনেক প্রশ্ন আসবে– কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলকে সুবিধা দেওয়ার জন্য এটা করা হচ্ছে কিনা।’

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব সমকালকে বলেন, ‘বিগত নির্বাচনগুলোতে যুবকরা ভোট দিতে পারেনি। এ কারণে হয়তো তাদের উৎসাহিত করতে এটা করা হতে পারে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ