নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর প্রাকৃতিক বৈরিতায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে মৌলভীবাজার জেলার চা উৎপাদন। চলতি মৌসুমেও টানা পাঁচ মাস ধরে অনাবৃষ্টির ফলে সৃষ্ট খরায় মৌলভীবাজারের বাগানগুলোতে চায়ের উৎপাদন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। দু’একদিন ধরে হালকা বৃষ্টি হলেও তাতে খরা কাটছে না। তীব্র তাপদাহে চা গাছ ধূসর বর্ণ হয়ে গেছে। পাতা পুড়ে যাচ্ছে।
জেলার ৯২টি চা বাগানের বেশির ভাগে সেচ ব্যবস্থা না থাকায় কচি চায়ের পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। খরার কারণে নতুন কুঁড়ি গজাচ্ছে না। ফলে এ বছর চা উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন চা-শিল্পসংশ্লিষ্টরা। সরেজমিন মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জের বিভিন্ন চা বাগান ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র। দীর্ঘ খরায় তাপমাত্রা বেশি থাকায় এবং পর্যাপ্ত শেড ট্রি না থাকায় জেলার প্রায় সব বাগানে চা গাছ ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে। কোথাও কোথাও পাতা ঝরে মরা গাছে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে ভরা চা উৎপাদন মৌসুমে চা গাছে নতুন কুঁড়ি তুলনামূলক কম গজাচ্ছে। ফলে পাতা কর্তন কম হচ্ছে।
কমলগঞ্জের শমশেরনগরের আলীনগর চা বাগানে বসবাস করা কেন্দ্রীয় শ্রমিক নেতা রামভজন কৈরী জানান, তার দীর্ঘ জীবনে এতো লম্বা খরা দেখেননি। প্রাকৃতিক এ বিপর্যয় থেকে রক্ষায় চা শ্রমিকরা কলস ভরে পানি বাগানে ছিটাচ্ছে। সব বাগানের শ্রমিকরা নিজ নিজ ধর্মীয় মতে আচার-অনুষ্ঠান করে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করছেন।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) শ্রীমঙ্গল অফিস ও বিভিন্ন বাগান সূত্রে জানা যায়, গত বছরের নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে বৃষ্টি হয়েছিল। এরপর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, রাজনগর, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলায় বৃষ্টি হয়নি। জানুয়ারি-মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত চা বাগানের পরিচর্যার কার্যক্রম চলে। তখন সপ্তাহে ২-৩ দিন পাতা কর্তন করা হয়। মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। এবারে অনাবৃষ্টির কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় দশ ভাগের এক ভাগও চা উৎপাদন হচ্ছে না।
গত বছর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৮ লাখ কেজি। এবার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি ৩ লাখ কেজি। এর মাঝে জানুয়ারি মাসে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩ লাখ কেজি। ফিনলে নিয়ন্ত্রণাধীন একটি চা বাগানের ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, চা উৎপাদনে ব্যবহৃত জিনিসপত্র, শ্রমমূল্য, কীটনাশক, সারসহ সব কিছুর দাম বাড়ছে তবে চায়ের বাজারে মূল্য কমছে। বিশেষ করে এবারের খরায় চা উৎপাদনে ধস নেমেছে। উৎপাদন মূল্য থেকে ৪০-৫০ টাকা কমমূল্যে প্রতি কেজি চা বিক্রি করতে হচ্ছে। ৮০ হেক্টর চা আবাদ ভূমিতে সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হবে।
বাংলাদেশি চা সংসদ সিলেট শাখার চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী জানান, দীর্ঘ খরার ফলে ছড়া-খালের পানি শুকিয়ে গেছে। চা গাছে পানি দেওয়া যাচ্ছে না। এতে কচি চায়ের পাতা ২০ থেকে ৩০ ভাগ ও পুরোনোগুলো ১০ ভাগের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকার ভর্তুকি দিলে চা শিল্প বিকাশে সহায়ক হতো।
বিটিআরআই সূত্র আরও জানায় জেলার করিমপুর, জেরিন, মধুপুর, গাজীপুর, মির্জাপুরসহ বেশ কিছু চা বাগানে হেক্টরপ্রতি হাজার কেজির বেশি চা উৎপাদন করা হয়। তবে জেলার নিউ সমনবাগ, দেউড়াছড়া, ফুলতলা, হোসনাবাদসহ অনেক বাগানে হেক্টরপ্রতি ৫০০ কেজির নিচে চা পাতা উৎপাদন হওয়ায় অনেক সময় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয় না।
বিটিআরআই শ্রীমঙ্গল দপ্তরের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিট কর্মকর্তা (পিডিইউ) এ.
সরকারি মালিকানাধীন এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত চা কোম্পানি ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) আর্থিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সমাপ্তিতে কোম্পানিটির লোকসানের অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ১১৯ কোটি টাকায়। শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১০৭ টাকা ৪৯ পয়সা। বিগত সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন দলের সুবিধাভোগীদের নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকে কোম্পানির কার্যক্রমে ব্যাপক অনিয়ম শুরু হয়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
অক্সিডেন্টাল টাকা নিয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণ পায়নি স্থানীয়রা
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ২৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ শনিবার। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে মাগুরছড়ার ফুলবাড়ী চা বাগানের সম্মুখভাগে অবস্থিত ১ নম্বর গ্যাস অনুসন্ধান কূপে খননকালে ভয়াবহ ওই বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল আশপাশের এলাকা। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আগুনের লেলিহান শিখা ৬০০ ফুট উচ্চতায় উঠে যায়। পুড়ে কয়লা হয়ে যায় লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনের আশপাশের গাছপালা, মারা যায় বহু পশুপাখি। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় চা বাগান, বিদ্যুৎ লাইন, রেলপথ, গ্যাস পাইপলাইন, গ্যাসকূপ, রিজার্ভ গ্যাস, পরিবেশ প্রতিবেশ ও ভূমিস্থ পানিসম্পদ। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য আজও ভাসে মৌলভীবাজার জেলাবাসীর মনে। অথচ সেই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কূপ খননকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান অক্সিডেন্টালের কাছ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেনি সরকার। উল্টো নিজেদের যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার বীমার টাকা তুলে ভেগেছে অক্সিডেন্টাল।
১৯৯৫ সালে বৃহত্তর সিলেটের ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয় মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল অব বাংলাদেশ লিমিটেডের। অনুসন্ধান শুরুর পর তেল-গ্যাসে সমৃদ্ধ হবে এলাকা– এই ভেবে কমলগঞ্জ তথা মৌলভীবাজারের মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়। তেল-গ্যাসের সন্ধানে ৩ হাজার ৭০০ মিটার কূপ খননের লক্ষ্য নিয়ে কাজও শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ৮৪০ মিটার খননের পরই ঘটে দুর্ঘটনা। টানা ১৫ দিন আগুন জ্বলার পর যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনের ইন্টারন্যাশনাল অয়েল কোম্পানির বিশেষজ্ঞ রিচার্ড চাইল্ড রিসহ চার সদস্যের একটি দল আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে পুরো কূপের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে প্রায় ছয় মাস।
বিভিন্ন সময় তেল-গ্যাস বিশেষজ্ঞরা মাগুরছড়া বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করতে চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে, মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ উত্তোলনযোগ্য ২৪৫ দশমিক ৮৬ বিসিএফ গ্যাস পুড়ে যায়; যার দাম ছিল প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষতি ছিল আরও ১১ হাজার কোটি টাকার। বর্তমান বাজারমূল্য হিসাব করলে মোট ক্ষতির পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অগ্নিকাণ্ডে মাগুরছড়া ও আশপাশের ৮৭ দশমিক ৫০ একর এলাকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের গবেষণায় দেখা গেছে, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণে ২৯টি চা বাগানের ৪৬ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩০ টাকার ক্ষতি হয়। লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৬৯ দশমিক ৫ হেক্টর এলাকার ২৫ হাজার ৬৫০টি পূর্ণবয়স্ক গাছ পুড়ে যাওয়ায় ক্ষতি হয় প্রায় ৩৩ কোটি ৬১ লাখ টাকার। ওই ঘটনার সরকারি তদন্তে ক্ষতি বাবদ ধরা হয় ৫০৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। এ ছাড়া বনাঞ্চলের সম্ভাব্য ক্ষতি হয়েছে ৪০ হেক্টর ভূমি এবং ১৫ হাজার ৪৫০টি বৃক্ষ। ধারণা করা হয়, আগুনের কারণে ১০ বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৮৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ, বনাঞ্চলের মোট ক্ষতি ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৫৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। বিস্ফোরণের ফলে ২ হাজার ফুট রেলপথও ধ্বংস হয়। এতে রাজস্ব ছাড়া ক্ষতি হয়েছে ৮১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯৫ টাকা। সড়কপথের ক্ষতি ২১ কোটি টাকা। গ্যাস পাইপলাইনের ক্ষতি ১৩ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ লাইনের ক্ষতি ১ কোটি ৩৫ লাখ ৯ হাজার ১৮৬ টাকা। মাগুরছড়া খাসিয়া পানপুঞ্জির অধিবাসীদের পানের বরজগুলোতে প্রতিদিন ৪৭ হাজার ৭৫০ টাকা হারে মোট ক্ষতি হয় ১২ লাখ টাকা।
১৯৯৭ সালের ১৪ জুন বিস্ফোরণের পর জ্বলতে থাকা কূপের উৎস মুখ বন্ধ করার কাজ সম্পন্ন হয় পরের বছর ৯ জানুয়ারি। তার আগেই ১৯৯৭ সালের ২০ ডিসেম্বর অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া থেকে বিদায় নেয়। এতে দেশজুড়ে দেখা দেয় তীব্র প্রতিক্রিয়া।
মাগুরছড়া তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, মাগুরছড়া অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারি যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, তারা এক মাসের মধ্যেই তাদের প্রতিবেদন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন বীমা কোম্পানিতে জমা দিয়ে সেই সময়ই অক্সিডেন্টাল তাদের বীমাকৃত যন্ত্রাংশ, রিগ ইত্যাদির ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেয়। অথচ যে অক্সিডেন্টালের কারণে এত বড় ক্ষতি হলো, তাদের কাছ থেকে সরকার বা এলাকাবাসী এখনও কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বনের ক্ষতি নিরূপণ করা হলেও এ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কখনও পুষিয়ে ওঠার নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারে আগের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
এদিকে মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ২৮তম বার্ষিকী উপলক্ষে আজ কমলগঞ্জে মানববন্ধন করবে পাহাড় রক্ষা উন্নয়ন সোসাইটি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি, কমলগঞ্জ উন্নয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। মাগুরছড়া বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও কমলগঞ্জের ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগের দাবি জানিয়েছে তারা।