বাংলা নববর্ষ ১৪৩২; সোমবার সকাল ৯টা। শেরপুর শহরের বেসরকারি একতা স্পেশালাইজড হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার থেকে তোয়ালে মোড়া সদ্যোজাত এক শিশুকে বের করে নিয়ে এলেন চিকিৎসক। নতুন পৃথিবীর নতুন আলোতে তখনও ছেলে শিশুটি ধাতস্ত হতে পারেনি; চোখ পিটপিট করছে তার। সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের ধকলে শিশুটির মা জামেনা খাতুন তখনও অচেতন। চিকিৎসক অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষারত বাবা মো.

মিজানের হাতে তুলে দিলেন সন্তানকে। তারপর যা হলো, সেটি সত্যি পৃথিবীর সেরা দৃশ্যগুলোর একটি হতে পারে। কাঁদতে কাঁদতে বাবা মিজান চুমু খেলেন সদ্যোজাত সন্তানের তুলতুলে হাতে। ওদিকে আজান দিলেন মিজানের ছোট বোনের স্বামী মো. মাসুদ। 

শেরপুর সদর উপজেলার বলাইয়েরচর ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে প্রত্যন্ত গ্রাম পাইকারতলার বাসিন্দা মিজান ও জামেনা। জেলার সবজিভান্ডার হিসেবে খ্যাত এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষিকাজ। এর বাইরে রাজমিস্ত্রি ও টাইলস মিস্ত্রির কাজ করেন অনেক যুবক। শিক্ষায় অনগ্রসর এ গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব ভালো না। যোগাযোগ ব্যবস্থা নাজুক। প্রসূতি মায়েদের স্বাস্থ্যসেবার সুব্যবস্থা না থাকায় যেতে হয় শহরে। ফলে অনেকেই গ্রামের ধাত্রী বা দাই দিয়ে প্রসব করান। এতে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার এ গ্রামে বেশি বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা শাজাহান মেম্বার। তবে পেশায় রাজমিস্ত্রির সহকারী মিজান সংসারে শত অভাবের মধ্যেও স্ত্রী জামেনার ব্যাপারে ছিলেন সচেতন। 

মিজান জানান, রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে দৈনিক ৬০০ টাকা বেতন পান। তাঁর বাবা জালাল উদ্দিনও একই কাজ করেন। বাবা-মাকে নিয়ে তাদের যৌথ পরিবার। সংসারে অভাব অনটন লেগে আছে। তাদের প্রথম সন্তান জোবায়েদের বয়স ৫ বছর। স্ত্রী দ্বিতীয়বারের মতো যখন অন্তঃসত্ত্বা হলেন, তখন নানা অভাব অনটন সত্ত্বেও তাঁকে সর্বোচ্চ যত্নে রেখেছিলেন। প্রত্যন্ত গ্রামে অন্তঃসত্ত্বাদের স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ খুব কম। তাই স্ত্রীকে শেরপুর নিয়ে নিয়মিত চেকআপ করিয়েছেন। গর্ভধারণের পর টিকাসহ চিকিৎসকের পরামর্শে সব ধরনের চিকিৎসা ও পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। সীমিত আয় থেকে একটু একটু সঞ্চয় করে সিজারের জন্য টাকা জমিয়েছেন। এসব করতে গিয়ে কষ্ট হয়েছে। এখন সেসব ভুলে গেছেন সন্তানের মুখ দেখে। 

মিজান আরও জানান, রোববার রাত ২টার দিকে জামেনা খাতুনের প্রসব বেদনা ওঠে। প্রতিবেশী এক আত্মীয়ের ইজিবাইক ভাড়া করে ফজরের নামাজের সময় স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হন শেরপুরের উদ্দেশে। সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন, তাঁর স্বামী ও জ্যাঠাতো ভাইয়ের বউ। প্রায় ১৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তিনি যান নারায়ণপুরের একতা হাসপাতালে। ১০ হাজার টাকা চুক্তিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঠিক সকাল ৯টায় সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করায়। 

দুই ছেলেকেই মাদ্রাসায় লেখাপড়া করানোর ইচ্ছা পোষণ করে মিজান বলেন, তাঁর স্বপ্ন ওরা দু’জনই ভবিষ্যতে নামকরা আলেম হবে। শিশুর কি নাম রেখেছেন জানতে চাইলে মিজান জানান, তাঁর ছোট ভাই মাদ্রাসার হুজুরের সঙ্গে কথা বলে নাম ঠিক করবেন। বাড়ি যাওয়ার পর নাম রাখা হবে। 

মিজানের মা রোকেয়া বেগম সোমবার বিকেলে এসেছিলেন নাতি দেখতে। ফুটফুটে নাতিকে কোলে নিয়ে বলছিলেন, ‘ছেলের চেহারা আমার শ্বশুরের মতো হয়েছে। তিনি খুব ভালো মানুষ আছিলেন। নাতি আমার খুব ভাগ্যবান হবো। বছরের প্রথম দিন জন্ম নিছে। এইডা আল্লাহর রহমত। আল্লাহ ওরে সুস্থ রাখুক এই দোয়া করি।’ 

সোমবার রাতে কথা হয় জামেনা খাতুনের সঙ্গে। তিনি জানান, সোমবার যে বৈশাখের প্রথম দিন অর্থাৎ নববর্ষ ছিল জানতেন না। জ্ঞান ফেরার পর যখন নার্সের কাছে শুনলেন, নতুন বছরের প্রথম দিনে তিনি ওই হাসপাতালে প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, তখন কুব ভালো লেগেছে। মাশাআল্লাহ বলে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন। 

জামেনা আরও বলেন, অভাবের সংসারে তাঁকে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি অনেক যত্নে রেখেছিলেন। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর কোনো বাড়তি কাজের চাপ দেননি। সময় মতো ডাক্তার দিয়ে চেকআপ করেছেন। সবজির পাশাপাশি কষ্ট হলেও ডিম, দুধ, কলা খেয়েছেন নিয়মিত। 
হাসপাতালের চিকিৎসক মাহবুবা কবীর স্বপ্না বলেন, মা ও শিশু দু’জনই ভালো আছে। শিশুটির ওজন হয়েছে ৩ কেজি ৭০০ গ্রাম। মায়ের জ্ঞান ফেরার পর শিশুকে শাল দুধ খাওয়ানো হয়েছে। চারদিন পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক র প রথম স মব র প রসব

এছাড়াও পড়ুন:

যেকোনো উৎসবকে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখার আহ্বান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের

কেবল বাংলা নববর্ষই নয়, যেকোনো উৎসবকে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। 

মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে "বাংলা নববর্ষ: ইতিহাস, সংস্কৃতি ও উত্তরাধিকার" শীর্ষক এক সেমিনারে বাংলা নববর্ষের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ও সামাজিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ অনুরোধ করেন।

সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, কেবল বাংলা নববর্ষই নয়, যেকোনো উৎসবকে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখা জরুরি। রাজনীতির সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্ক সঠিকভাবে গড়ে উঠলে কোনো উৎসবই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয় না। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনার যে স্বকীয়তা রয়েছে, তা অক্ষুণ্ন রাখাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। বুদ্ধিভিত্তিক ও সচেতন উদ্যোগের মাধ্যমে ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। বাংলা নববর্ষের প্রতি জনগণের গভীর অনুরাগ রয়েছে, তাই এটিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।

সেমিনারে আইআরডিসি’র সাধারণ সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হকের সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন 
আইআরডিসি-এর সভাপতি ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিলাল হোসাইন।

সেমিনারে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. নাছির আহমেদ তার মূল প্রবন্ধে বাংলা নববর্ষের ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং নববর্ষ উদযাপনের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার নিয়ে দুই পর্বে বিশদ আলোচনা করেন। তিনি বলেন, বাংলা নববর্ষ কেবল বাঙালিদের উৎসব নয়, বরং এটি ধর্ম, গোত্র ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বাংলাদেশির একটি সমন্বিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়া, বাংলা সনের উৎপত্তি, এর অর্থনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মাত্রা নিয়েও তিনি গভীরভাবে আলোকপাত করেন।

এছাড়াও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. রইছ উদ্‌দীন এবং বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফজলে এলাহি চৌধুরী প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন। তাঁরা বাংলা নববর্ষের আন্তর্জাতিক ও  সামাজিক সংহতি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশে এর ভূমিকা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেন। একইসাথে বাংলা নববর্ষের বহুমাত্রিক তাৎপর্য ও এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করেন।

এসময় সেমিনারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গবেষক উপস্থিত ছিলেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • উপহার পেল পহেলা বৈশাখে জন্ম নেওয়া জেরিনের পরিবার
  • ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে উৎসবকে রাজনীতি মুক্ত রাখতে হবে: মোহাম্মদ আজম
  • দৃশ্যপটে ‘আনন্দ’, মঙ্গল কোথায়
  • যেকোনো উৎসবকে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখার আহ্বান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের