ছয় মাসে কী অর্থনৈতিক সংস্কার করা হয়েছে, প্রশ্ন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের
Published: 17th, April 2025 GMT
দেশে সংবিধান, পুলিশ, স্থানীয় সরকার, নির্বাচন, বিচারব্যবস্থাসহ বিভিন্ন খাতে নানা সংস্কারের আলাপ হয়েছে। কিন্তু গত ছয় মাসে অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে খুব বেশি কিছু করা হয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এই (অন্তর্বর্তী) সরকার গত (আওয়ামী লীগ) সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা স্থগিত করেছে। কিন্তু এর বিপরীতে কোনো মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়নি। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না। এমনকি যে নীতিগুলো এখন নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর ধারাবাহিকতা থাকবে কি না, সেটি নিয়েও তারা সংশয়ে আছেন।
আজ বৃহস্পতিবার ‘৬ষ্ঠ বাংলাদেশ ইকোনমিকস সামিট, ২০২৫’-এর শেষ অধিবেশনে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অর্থনীতি অধ্যয়ন কেন্দ্র বা ইকোনমিকস স্টাডি সেন্টারের আয়োজনে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বিশেষ অতিথি ছিলেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারপারসন মাসুদা ইয়াসমিন এবং অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।
অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানান, শ্বেতপত্র ও টাস্কফোর্স কমিটির প্রতিবেদনে অর্থনীতির নানা দিকের ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে; মান রেখা (বেঞ্চমার্ক) স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এই মান রেখা থেকে আগামী ছয় মাস বা এক বছরে আমরা কোথায় উপনীত হব, সে বিষয়ে কোনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এই (অন্তর্বর্তী) সরকার যে বাজেট নিয়ে কাজ করছে, সেটি আগের সরকারের বাজেট। এটাকে বদল করে এমন কিছু দেওয়া হয়নি, যার ভিত্তিতে তাকে (অন্তর্বর্তী সরকারকে) আমি মূল্যায়ন করতে পারব।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে অন্তত দুই বছরের জন্য একটি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল বলে জানান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, একটি মধ্যমেয়াদি, লক্ষ্য নির্দিষ্ট ও সুস্থির নীতিকাঠামো না থাকলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ হয় না। এখন ব্যক্তি খাতের সবাই বলছেন, এই সরকার কত দিন আছে, তা তো জানি না। তাই এখন কীভাবে বিনিয়োগ করব। এমনকি যে নীতিগুলো হচ্ছে, সেগুলোর ধারাবাহিকতা থাকবে কি থাকবে না, সেটিও ঠিকভাবে বলতে পারছেন না তাঁরা।
অনুষ্ঠানে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জুলাই আন্দোলনের পেছনে অন্যতম কারণ বা চালিকা শক্তি ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য। বিগত সরকারের সময়ে অর্থনৈতিক সুবিধা হিসাব না করে অনেক বিনিয়োগ করা হয়েছিল; প্রকল্পের ব্যয় বহু গুণ বাড়ানো হয়েছিল। অথচ উন্নয়ন বাজেটের প্রায় পুরোটাই ছিল ঋণনির্ভর। এসব নিয়ে তখন প্রশ্ন করা যায়নি। তবে সুশাসনের প্রয়োজনে ভবিষ্যতে এসব নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অতীতে দেখা যেত টাকা চুরি করে তা দেশেই রাখা হতো। তবে বিগত সরকারের সময় চুরি করা অর্থ নানা উপায়ে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। হয়তো তারা (আওয়ামী লীগ সরকার) অনুমান করতে পেরেছিল, যেকোনো একসময় ৫ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটবে। এ জন্যই নানা উপায়ে তারা দেশ থেকে টাকা বের করে নিয়ে গেছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র
এছাড়াও পড়ুন:
সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস
বাবা সন্তানের ওপর ছায়ার মতো স্নেহময় এক উপস্থিতি। নিঃশর্ত ভরসার প্রতীক। সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনের প্রয়োজনে নিজের বর্তমান, এমনকি নিজের স্বপ্নও নীরবে উৎসর্গ করে দিতে পারেন যিনি– আজ তাদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর দিন। বাবা দিবস উপলক্ষে সমতা’র বিশেষ আয়োজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা বৃহত্তর বরিশালে। এখন সেই জায়গাটা পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি পৌরসভার সমুদয়কাঠি গ্রাম। তখনকার সামাজিক পরিসরে আমাদের পরিবারের অবস্থা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভালো ছিল। আমার বাবা বিজয় কুমার আইচ তখন পিরোজপুরে কাজ করতেন। তাঁর রেশনের দোকান ছিল। প্রতি শনিবার বাড়ি আসতেন। আমরা বাবার আশায় বসে থাকতাম। এটি ছিল আমাদের জন্য একরকম আশীর্বাদের মতো।
বাবার একটি ব্যবসাও ছিল। এ থেকে মূলত আমাদের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের চেয়ে সম্ভবত বাবার জ্ঞান বা বোধ উন্নততর ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য দশ গ্রামের লোকজন তাঁকে মানত। গ্রামে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকত। বাবার সঙ্গে কথা না বলে কেউ থানা-পুলিশ করতে যেত না। বাবা সবাইকে খুব বুঝিয়ে বলত– মামলা করলে কে জিতবে, কে হারবে– এটি অনেক পরের কথা। মামলা নিয়ে বরিশাল-পিরোজপুরে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে দুই পক্ষই নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তারচেয়ে বরং তোমরা নিজেরা মিটমাট করে ফেল।
গ্রামের পণ্ডিতরা তখন তালপাতায় অ-আ-ক-খ শেখাতেন হাত ধরে ধরে। আমার সেটি একদম পছন্দ হতো না। বাবা কী করলেন, তিনি একটা স্লেট ও পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। অ-আ-ক-খ দিয়ে যত ছবি আঁকা হয়, তা শেখাতেন। এর মধ্যে আমার যে ছবিটা পছন্দ হতো, সেটি আমি মনের মধ্যে গেঁথে নিতাম। যার ফলে বাবার মাধ্যমে অত্যন্ত আনন্দদায়ক এক শিক্ষা পেয়েছি আমি।
আমার বাবারা ছিলেন ৪ ভাই। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দু’জন পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আমার বাবা ও এক কাকা বাড়ি ছেড়ে যাননি। আমরা ছিলাম ৬ ভাই ৩ বোন। কাকাতো ভাই ৪ জন, বোন একজন। মোট ১৪ ভাইবোন। কাকা কম বয়সেই গত হন। বিলাসী জীবন আমাদের ছিল না। তবে গ্রামের মানুষের কাছে আমরা ছিলাম বড়লোক। পরিবারে অনেক সদস্য থাকলেও খাবারের অভাব হতো না কখনোই। এমনকি দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থায়ও খাবারের কষ্ট করতে হয়নি। আমাদের একটা গুদামঘর ছিল। সেখানে বাবা পাশের বন্দর কাউখালী থেকে সারা বছরের চাল, ডাল, পাউডার দুধ, চিনি, লবণ, গুড় এনে ড্রামে ভরে রাখতেন। বাইরে যত সংকটই থাকুক না কেন, বছরজুড়ে খাবারের অভাব হতো না। সমস্যা হতো ঝড়ের সময়। উপকূলীয় অঞ্চলে এমন ঝড় মাঝে মাঝেই আসত। কখনও ঘরের চাল উড়ে গেলে আমরা সমস্যায় পড়ে যেতাম।
অন্যদের সামনে বাবা নিজের অবস্থানের জন্যই বেশি হাসি-তামাশা করতেন না। যখন আমাদের সঙ্গে থাকতেন, তখন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো হাসি-খুশি থাকতেন। তখনকার বাবাদের আমরা মারধর করতে দেখেছি, এমনকি খড়ম দিয়ে পেটাতে দেখেছি। বাবা আমার গালে জীবনেও একটা চড় মারেনি। কোনো ভাইবোনকেও মারধর করতে দেখিনি। তখন হয়তো আরও এমন বাবা ছিলেন। তবে গ্রামে আমি এমন বাবা আর দেখিনি। সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলেও তিনি কখনও জিজ্ঞেস করতেন না, কেন দেরি করে ঘরে ফিরেছি।