কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতে বিপ্লব ঘটাবে, এমন পূর্বাভাস দিয়েছেন মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। তাঁর মতে, বিশ্বজুড়ে চিকিৎসক ও শিক্ষকের সংকট দূর করতে বড় ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে এআই। পাশাপাশি শ্রমনির্ভর আরও কিছু পেশাও এই প্রযুক্তির কারণে ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।

সম্প্রতি ‘পিপল বাই ডব্লিউটিএফ’ নামের একটি পডকাস্টে গেটস বলেন, এআই এসে চিকিৎসাসংক্রান্ত বুদ্ধিমত্তা জোগাবে, তখন আর চিকিৎসকের ঘাটতি থাকবে না। তাঁর মতে, যেসব খাতে দক্ষ জনবলের অভাব প্রকট, সেসব জায়গায় এআই কার্যকর সমাধান হয়ে উঠতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসকের সংকট দিন দিন বাড়ছে। দেশটির আমেরিকান মেডিকেল কলেজের হিসাবে, ২০৩৬ সালের মধ্যে চিকিৎসকের ঘাটতি দাঁড়াতে পারে প্রায় ৮৬ হাজারে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, ভারত ও আফ্রিকার অনেক দেশও দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা খাতে জনবলের সংকটে ভুগছে। এই বাস্তবতায় ‘সুকি’, ‘জেফায়ার এআই’ ও ‘টেনার’–এর মতো এআইভিত্তিক স্টার্টআপগুলো বিপুল অর্থ বিনিয়োগ পাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান এমন সফটওয়্যার তৈরি করছে, যেগুলোর মাধ্যমে রোগনির্ণয়, ক্লিনিক্যাল ডকুমেন্টেশন, বিলিং কিংবা রোগী শনাক্তকরণের কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা যাচ্ছে।

প্রযুক্তি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, কেবল স্বাস্থ্য ও ওষুধশিল্পেই জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি ডলার পর্যন্ত উৎপাদনশীলতা যোগ করতে পারে। শুধু চিকিৎসা নয়, এআইয়ের ব্যাপক প্রভাব পড়ছে শিক্ষা ক্ষেত্রেও। যুক্তরাষ্ট্রের কেএ–১২ পর্যায়ের ৮৬ শতাংশ পাবলিক স্কুল ২০২৩ সালে শিক্ষক নিয়োগে সমস্যা হয়েছে বলে জানিয়েছে। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ স্কুলে শিক্ষকের সংকট রয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্যের ডেভিড গেইম কলেজ পরীক্ষামূলকভাবে চ্যাটজিপিটির মতো এআই টুল ব্যবহার শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ও গণিত শেখাতে ব্যবহার করা হচ্ছে এই প্রযুক্তি। যদিও শিক্ষার্থীদের এআই–নির্ভরতার সমস্যা ও অসদুপায় ব্যবহারের শঙ্কা রয়েছে। শিক্ষকেরা বলছেন, এটি পাঠদানে সময় সাশ্রয় করছে এবং শেখার অভিজ্ঞতাও উন্নত হচ্ছে।

বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ ছাড়া শারীরিক শ্রমনির্ভর পেশাগুলোর ক্ষেত্রেও এআই ও রোবট প্রযুক্তির প্রভাব বাড়ছে বলে জানিয়েছেন গেটস। তিনি বলেন, ‘গুদামে পণ্য ওঠানো, মেঝে পরিষ্কার কিংবা নির্মাণ সাইটে কাজ করার মতো শারীরিক শ্রমও এআই রোবটের মাধ্যমে করা সম্ভব। এসব কাজের জন্য রোবটকে মানুষের মতো দক্ষ “হাত” দরকার। আমরা এখন সেই পর্যায়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।’ প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান এনভিডিয়া ইতিমধ্যে এমন মানবাকৃতির রোবট তৈরির কাজ করছে, যেগুলো গুদাম ও নির্মাণশিল্পে বিভিন্ন শারীরিক কাজ করতে পারবে। এতে শ্রমঘণ্টা ও খরচ কমে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।

বিল গেটস বলেন, ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসতে পারে, যখন মানুষ সপ্তাহে মাত্র ১৫ ঘণ্টা কাজ করলেই চলবে। তিনি অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইন্সের ১৯৩০ সালের একটি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা স্মরণ করিয়ে দেন, যেখানে বলা হয়েছিল, শিল্পায়ন ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে কর্মঘণ্টা কমে আসবে। তবে বাস্তবতা হলো, আজও অধিকাংশ মানুষ সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করছেন। তাঁর মতে, ‘এআই প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার আমাদের কাজ, সময় ও জীবনের ধরন নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। ফলে সামনে আমাদের কর্মসংস্কৃতি ও অবসরের সংজ্ঞাও হয়তো বদলে যাবে।’

সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক ক জ কর

এছাড়াও পড়ুন:

আউটসোর্সিং এবং শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন

আধুনিক শ্রমবাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তৃত খাত হলো আউটসোর্সিং। এ খাতের মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক প্রতিদিন সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। অথচ এই শ্রমিকদের অধিকাংশই শোভন কাজের মৌলিক মানদণ্ড থেকে বঞ্চিত। চাকরির স্থায়িত্ব নেই; সুরক্ষার নিশ্চয়তা নেই; নেই সংগঠনের অধিকার– এমন বাস্তবতায় শ্রমিকরা এক অনিশ্চিত ও অনুৎপাদনশীল পরিবেশে দিন কাটাচ্ছেন।

এ প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি শ্রম সংস্কার কমিশন সরকারের কাছে ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা: শ্রমিক-অধিকার, সুসমন্বিত শিল্প-সম্পর্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি সুপরিকল্পিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনের বিভিন্ন অধ্যায়ে কাজের স্বীকৃতি, অধিকার, নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব নিয়ে যেসব সুপারিশ রাখা হয়েছে, তার মধ্যে আউটসোর্সিং খাতে নিযুক্ত শ্রমিকদের নিয়ে তৎপরতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমানে সরকারের রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত ১২৫০টি ঠিকাদারি সংস্থা জনবল সরবরাহ করছে। এর বাইরেও অগণিত অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকরা কর্মঘণ্টা, মজুরি, ছুটি, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার।
অধিকাংশ আউটসোর্সিং শ্রমিক ন্যূনতম মজুরি পান না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার নির্ধারিত মজুরি না দিয়ে বেতন থেকে অবৈধভাবে টাকা কেটে রাখে; উৎসব ভাতা দেয় না; ওভারটাইমের ভাতা দেয় না। সাম্প্রতিক ২০২৫ সালের আউটসোর্সিং নীতিমালায় উৎসব ভাতা ও বৈশাখী ভাতা অন্তর্ভুক্তিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলা যায়, তবে বাস্তবায়ন ও নজরদারি এখনও দুর্বল।

নীতিমালায় নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি সংক্রান্ত কোনো অর্থনৈতিক সুরক্ষা না থাকায় তারা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে অন্তঃসত্ত্বা হলেই চাকরিচ্যুতির শঙ্কা থাকে। বেসরকারি খাতে এ অবস্থা আরও ভয়াবহ। নতুন নীতিমালায় ৪৫ দিনের প্রসূতিকালীন ছুটি সংযুক্ত করা হয়েছে, যা বিদ্যমান শ্রম আইনের ১১২ দিনের বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আউটসোর্সিং শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার পথ রুদ্ধ। তারা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন না। করলে চাকরিচ্যুতির শিকার হন। ফলে শ্রমিকস্বার্থে কোনো সামাজিক সংলাপ বা দরকষাকষির সুযোগ থাকে না।
বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্য, ওয়াসা, নিরাপত্তা খাতে কর্মরত হাজার হাজার আউটসোর্সিং শ্রমিক পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। করোনা মহামারিতে তারা সম্মুখ সারিতে থেকেও কোনো রকম ক্ষতিপূরণ পাননি। শ্রম বিধিমালার ১৬(৩) অনুযায়ী মালিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ দুর্বল।

সে জন্য শ্রম সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে আউটসোর্সিং শ্রমিকদের জন্য যেসব সুপারিশ করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে এ খাতে শোভন কাজের নিশ্চয়তা আসবে। আউটসোর্সিং খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের শোভন কাজ, মৌলিক অধিকার এবং কর্মস্থলে সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।   
আমি মনে করি, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, করপোরেশন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ করতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থায়ী জনবল কাঠামো হালনাগাদ করে আইনের ধারা ও বিধি অনুসরণপূর্বক প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা দরকার। ঠিকাদারের মাধ্যমে সার্ভিস চার্জ বা কমিশনের ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সরাসরি নিয়োগ প্রদান নিশ্চিত করা দরকার। যারা ৫-১০ বছর বা তদূর্ধ্ব সময় ধরে কর্মরত থেকে দক্ষতা অর্জন করেছেন, তাদের শ্রম আইন অনুযায়ী অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মূল মালিককে দায়বদ্ধ করা দরকার।

শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত কাজ করতে রাজি না হলে তাদের চাকরিচ্যুত বা ভয়ভীতি প্রদর্শন করা যাবে না। এ বিষয়ে শ্রম পরিদর্শন দপ্তর কঠোর নজরদারি করবে।  রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, দপ্তর ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আউটসোর্সিং বন্ধ করতে হবে। যেসব দপ্তর ও সেবা খাতে ইতোমধ্যে আউটসোর্সিং করা হয়েছে, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে স্থায়ী নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যাশা একটাই– শোভন কাজের বাস্তবায়ন। এ খাতের বৈষম্য কমাতে হলে সরকারের নীতিগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপ দরকার। একই সঙ্গে সমাজকেও সচেতন হতে হবে, যাতে মানুষ সস্তা সেবার পেছনে শ্রমের শোষণকে গুরুত্ব দিতে শেখে।

মো. মাছুম বিল্লাহ: আইন কর্মকর্তা, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আউটসোর্সিং এবং শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন