অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অধ্যাদেশ জারি করার সুপারিশ করেছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। অন্তত আইনটি তৈরিতে এখনই উদ্যোগ নিতে সব সম্প্রদায়ের জন্য ঐচ্ছিকভাবে তা প্রয়োগ করতে বলা হয়েছে। সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে সংসদীয় আসন বাড়িয়ে ৬০০ করে সেই আসন থেকে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রেখে সরাসরি নির্বাচনের সুপারিশ করা হয়েছে।

আজ শনিবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে নারী অধিকার রক্ষায় বিশদ সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন।

প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন নারী সংস্কার কমিশনের প্রধান ও অন্য সদস্যরা।

‘সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলুপ্তি এবং নারী–পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণ’ শিরোনামে প্রতিবেদনে নারী বিষয়ক কমিশন প্রতিষ্ঠা, নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, ধর্ষণের শিকার হওয়া অন্য লিঙ্গের মানুষের বিচার ও আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিতে আইনে ধর্ষণ ধারায় সংস্কার আনা, যেকোনো উপস্থাপনায় অহেতুক নারীর প্রসঙ্গ টেনে নারীবিদ্বেষী বয়ান, বক্তব্য ও ছবি পরিবেশন থেকে বিরত থাকা, নারীর প্রতি সম্মানজনক, মর্যাদাপূর্ণ ও যথাযথ সংবেদনশীল আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির লক্ষ্যে সামাজিক সচেতনতা বিষয়ক কর্মসূচি নেওয়া, মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করা, যৌনপেশাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা এবং শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদের (সিডো) দুটি ধারার ওপর সংরক্ষণ প্রত্যাহার, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৮৯ ও ১৯০ অনুচ্ছেদ অনুস্বাক্ষর করা, সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো সব প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ৬ মাস ছুটি দেওয়া এবং পূর্ণ বেতনসহ পিতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া, প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনসহ ৪৩৩টি সুপারিশ রয়েছে প্রতিবেদনে।

গত বছরের ১৮ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ১০ সদস্যের নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। নারীপক্ষ–এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভিন হককে প্রধান করে গঠিত কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো মাহীন সুলতান, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফৌজিয়া করিম ফিরোজ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার, নারী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হালিদা হানুম আখতার, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, নারীপক্ষের পরিচালক কামরুন নাহার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা ফেরদৌসী সুলতানা ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিশিতা জামান নিহা।

বিদেশে অবস্থান করার কারণে ফৌজিয়া করিম ফিরোজ ছাড়া বাকি সদস্যরা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে প্রয়াত কয়েকজন নারী নেত্রী ও জুলাই যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশনের সদস্যরা মোট ৪৩টি বৈঠক করেন। নারী অধিকার বিষয়ক সংগঠন, উন্নয়ন সংস্থা, শ্রমিক সংগঠন, পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ৩৯টি পরামর্শ সভা করা হয়। অন্যান্য সংস্কার কমিশনের সঙ্গে ৯টি সভা করা হয়। পরামর্শ সভাগুলো চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খুলনা, শ্রীমঙ্গল, রংপুর ও ময়মনসিংহে হয়েছে। সুপারিশ তৈরি করা হয়েছে তিন ধাপে— অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে করণীয়, পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের মেয়াদে করণীয় এবং দীর্ঘ নারী আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের ভিত্তিতে।

৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখার প্রস্তাব

সংসদের মোট আসন সংখ্যা ৬০০ করা ও এর মধ্যে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা ও অভিন্ন পারিবারিক আইন তৈরি, স্বতন্ত্র স্থায়ী নারী বিষয়ক কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য। নারী আসন বিষয়ে বলা হয়েছে, সংসদে পুরুষের সমান সংখ্যক নারী প্রতিনিধি সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে আসবেন। সংসদীয় আসন সংখ্যা ৬০০-তে বাড়িয়ে যেখানে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় একটি সাধারণ আসন এবং নারীদের জন্য একটি সরাসরি নির্বাচিত সংরক্ষিত আসন থাকবে। উভয় আসনে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন হবে। উচ্চ কক্ষে ৫০ শতাংশ আসনে আনুপাতিক হারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যে প্রার্থী মনোনয়ন দেবে, তা পুরুষ–নারী পর্যায়ক্রমে জিপার পদ্ধতিতে দিতে হবে, যাতে প্রতিটি দল থেকে সমান সংখ্যক নারী ও পুরুষ মনোনীত হন। জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষে ৫০ শতাংশ আসনে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই প্রস্তাব গৃহীত হলে নারী কমিশনের সম্পূরক প্রস্তাব হলো– নারী সংগঠনের প্রতিনিধিত্বের জন্য কমপক্ষে ৫টি আসন বরাদ্দ করা। জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের প্রতি অনাস্থা প্রকাশে ব্যালটে ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করারও সুপারিশ করা হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক বলেন, ‘দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে জাতীয় সংসদে ৩০০ আসন পর্যাপ্ত নয়। ৬০০ আসন এই জনসংখ্যার তুলনায় খুব বেশি নয়। এটা নিয়ে অনেকে অনেক মন্তব্য করলেও আমাদের কাছে ৬০০ আসন “উদ্ভট” কিছু মনে হচ্ছে ন। আমরা চাই, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হোক, বিতর্ক হোক। আসন বাড়ানোর বিরুদ্ধে কী কী যুক্তি আছে, তা উঠে আসুক। আমরা যদি সত্যিই চাই, নারীর সংসদে বসুক, তাহলে এই সুপারিশ মেনে নিতে হবে। এটা ভালো রাজনীতির জন্য ভালো প্রক্রিয়া তৈরি করবে।’

সদস্য মাহীন সুলতান বলেন, ‘সংরক্ষিত আসন বাড়ানোর বিষয়ে আমরা মানুষকে ভাবাতে চাইছি। যে নারীরা রাজনীতিতে যাবেন, সেটা তাঁদের জন্য পেশা। তাঁদের জন্য স্থায়ী একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে। কারণ তাঁরা নির্বাচন করবেন। আসন বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে সবার আলোচনা করতে হবে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক দলের সব স্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ পদে নারীদের রাখার যে বিধান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) রয়েছে, তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এক নেতা দলীয় কোনো পদে দুইবারের বেশি থাকতে পারবেন না— আরপিওতে এই বাধ্যবাধকতা আরোপের মাধ্যমে দলে নেতৃত্বের বিকাশ নিশ্চিত করার পথ তৈরি করতে হবে।

অভিন্ন পারিবারিক আইন অন্তত শুরু হোক

অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অধ্যাদেশ জারি করার সুপারিশের পাশাপাশি সব সম্প্রদায়ের জন্য আইনটিকে ঐচ্ছিক রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আইন প্রয়োগের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে কি না, জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য কামরুন নাহার বলেন, ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন নিয়ে আমরা অনেকের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। আমরা চাইছি, এটা অন্তত শুরু হোক। ঐচ্ছিক রাখার মাধ্যমে হলেও যেন শুরু করা হয়।’

এ প্রসঙ্গে কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক যোগ করে বলেন, ‘অভিন্ন পারিবারিক আইনের বিষয়ে একটা সিভিল অপশন থাকা দরকার। আমরা রাতারাতি প্রচলিত পারিবারিক আইন বাদ দিতে পারব না।’

শিরীন পারভিন হক বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য অনেক কিছু করতে চায় না। এই সরকারের স্বার্থ নেই। এই সরকারই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, বৈষম্য দূর করার জন্য গণ–অভ্যুত্থান হয়েছে। বৈষম্য দূর করা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়া লক্ষ্য হতে হবে।

সংবিধান ও আইনগত কাঠামো বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সুপারিশের মধ্যে আরও বলা রয়েছে—পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন, ২০১০ এবং বিবাহবিচ্ছেদ আইনটির কার্যকর বাস্তবায়ন এবং শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি, বিবাহবিচ্ছেদের মামলাগুলোর নিষ্পত্তি ৩ বছরের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে। অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০ সংশোধন করে সন্তানের ওপর নারীর জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ২০০৯ সালে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসারে এবং বিভ্রান্তি এড়াতে একটি সুস্পষ্ট ও শক্তিশালী আইন প্রণয়ন করতে হবে। বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫১ সংশোধন করে বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে বিবাহিত বাংলাদেশি নারীদের বিদেশি স্বামীকে নাগরিকত্ব প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করা। সাক্ষী ও ভুক্তভোগী নারীদের পরিচয় গোপন রাখা এবং তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ কার্যকর করে নারীদের সমান সুযোগ ও সুরক্ষা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকারের জন্য বিভিন্ন ধর্মের পারিবারিক আইন সংশোধন করা এবং মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মীয় উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে নারীদের সম্পত্তিতে ৫০–৫০ ভাগ নিশ্চিত করা, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে ধারা ১৭ (১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের বিয়ের সুযোগ রাখা) বাতিল করা, সাক্ষ্য আইনে বৈষম্য দূর করা ইত্যাদি সুপারিশ করা হয়েছে। বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের অবহেলা ও অপমান অবসানে সম্মানসূচক পদক্ষেপ নেওয়া, পাহাড়ি এলাকা ও শরণার্থীশিবিরে যৌন সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও প্রতিকার নিশ্চিত করাসহ সব ক্ষেত্রে নারীর পক্ষে সুপারিশ করা হয়েছে।

গণমাধ্যমে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতের সুপারিশ

কমিশনের প্রতিবেদনে গণমাধ্যমের প্রতিটি শাখা ও স্তরে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪ অনুসরণ করে সব ধরনের গণমাধ্যমে নারীর নেতিবাচক উপস্থাপন বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। গণমাধ্যমে অংশগ্রহণের জন্য নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে ব্যবহার না করা, অহেতুক নারীর প্রসঙ্গ টেনে নারীবিদ্বেষী বয়ান বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।

নারীর স্বার্থ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন, নারী ও মেয়েশিশুর জন্য সহিংসতামুক্ত সমাজ, জনপ্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর অগ্রগতির জন্য শিক্ষা, প্রযুক্তি ও দক্ষতা বাড়ানো, সব বয়সী নারীর জন্য সুস্বাস্থ্য, শ্রমে অংশগ্রহণ ও সম্পদের অধিকার, নারী শ্রমিকের নিরাপদ অভিবাসন, দারিদ্র্য হ্রাসে টেকসই সামাজিক সুরক্ষা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে নারীর অন্তর্ভুক্তি ও বিকাশ, দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা নারীদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা ইত্যাদি সুপারিশ করা হয়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর র স প র শ র স প র শ কর ন র র জন য স ৩০০ আসন প রস ত ব দ র জন য ব ষয়ক স আসন ব ড় সরক র র দ র কর র প রস ত কর র সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

নিয়োগপত্র নেই। এ কারণে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। দেওয়া হয় না পরিচয়পত্র। নেই কর্ম ঘণ্টার হিসাব। তবে রয়েছে মজুরিবৈষম্য ও জীবনের ঝুঁকি। এ চিত্র খুলনার বরফকলে কর্মরত বরফ শ্রমিকদের।

অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত বরফকলের শ্রমিকেরা জানেন না মে দিবসের অর্থ। তারা শুধু এটুকু জানেন, কাজ থাকলে মজুরি পাবেন, অন্যথায় জুটবে না কিছু। খুলনার নতুন বাজার, রূপসা, শিপইয়ার্ড ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বরফ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ঝুঁকি ও বৈষম্যের এই চিত্র।

সরেজমিনে জানা গেছে, লবণ পানি এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংমিশ্রণে বরফের প্রতিটি ক্যান তৈরি হয়। এ কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যুসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এছাড়াও অধিকাংশ সময় হাত-পা ভিজে ঠান্ডা থাকায় ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। এর বাইরে বুকে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় ভোগেন এখানকার শ্রমিকেরা। পাতলা বরফে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। কিন্তু মালিক বা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের অ্যাপ্রোন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন না। তবে দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

আরো পড়ুন:

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মহান মে দিবস: শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কারে জোর সরকারের

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার, নিউমার্কেট, শিপইয়ার্ড, রায়েরমহল এবং রূপসা উপজেলার পূর্ব রূপসা এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি বরফকল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাজার ও পূর্ব রূপসায় সর্বাধিক বরফকল রয়েছে। এসব কলে গড়ে দশ জন হিসেবে দেড় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।

রূপসার নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত ‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করেন মোহাম্মদ রাসেল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি হলেও পরিবার নিয়ে রূপসার জাবুসা এলাকায় বসবাস করেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই বরফকলে কাজ করছেন তিনি। রাসেল জানান, তাদের মাসিক বেতন নেই। নেই নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র। মূলত উৎপাদনের উপর প্রতি পিস বরফের ক্যান অনুযায়ী ১২ টাকা হারে মজুরি পান। নামমাত্র এ মজুরিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে সংসার ঠিকমতো চলে না।

‘‘তিন বছর আগে নির্ধারণ করা মজুরি এখনো চলছে। লোকসানের অজুহাতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে চান না। তাদের মতো শ্রমিকদের কোন বেতন-বোনাস নেই। নো ওয়ার্ক, নো পে অর্থাৎ কাজ থাকলে মজুরি আছে কাজ না থাকলে নেই। মালিকদের এ সিদ্ধান্ত না মানলে চাকরিও থাকে না।’’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন রাসেল হোসেন।

একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘গড়ে প্রতিমাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা মজুরি পাই। কিন্তু মাসিক খাবার খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া বাবদ ৩ হাজার টাকা চলে যায়।’’

তবে জাকির হোসেন ব্যাচেলর হওয়ায় কারখানার মধ্যেই থাকেন। বিয়ের পর এ কাজ করার ইচ্ছা নেই বলে জানান তিনি।

বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১-এ অপারেটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ সেলিম শেখ। তার জন্ম নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা হলেও কর্মসংস্থানের কারণে রুপসার বাগমারা গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি জানান, বর্তমান বয়স ৮৪। ২০ বছর বয়স থেকেই বরফ কারখানার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হেলপার হিসেবে ২৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অপারেটর হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে সবসময় উৎপাদন না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা কারখানায় থাকতে হয়। ছুটি পান না।

‘অ্যামোনিয়া গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। তবে তিনি কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি বলে জানান তিনি।

‘মায়ের দোয়া আইস এন্ড কোল্ড স্টোরেজে’র শ্রমিক জাকারিয়া হাওলাদার বলেন, ‘‘চার বছর বরফকলে কাজ করছি। চাকরির ভবিষ্যৎ নেই। শ্রম দিতে পারলে মজুরি হয়, না হলে হয় না। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেন না মালিকপক্ষ। বেতন বাড়ানোর কথা বললে তারা আমলে নেন না।’’

একই এলাকার ‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করছেন মোঃ মুন্না গাজী ও মোঃ হাসান শেখ। তারা নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তারা দুজনেই মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই।

‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’র ম্যানেজার আশিকুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদাসীন। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার মাঝেমধ্যেই লিক হয়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৩২টি আইস উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। ছয়জন শ্রমিক কাজ করে বলে জানান তিনি।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ- ২'র ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘বরফের মূল ক্রেতা চিংড়ি ও সাদা মাছের ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ ও দোকানে শরবত বিক্রেতারাও কারখানা থেকে বরফ কিনে নেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের ৬ মাস চাহিদা থাকে এবং কিছুটা লাভের মুখ দেখা যায়। তবে শীত মৌসুমের ছয় মাস বরফের চাহিদা কম থাকে। তখন কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি দিয়ে লোকসান গুণতে হয়।’’

জামাল উদ্দিন স্বীকার করেন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও তা এড়াতে কোন সরঞ্জাম নেই। তবে অপারেটরদের অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে মাক্স সরবরাহ করা হয়।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১'র মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রিয়াদ-উল-জান্নাত সৈকত বলেন, ‘‘ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। কখনো লাভ, কখনো লোকসান এভাবেই চলছে। গত বছর কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’’

তবে লাভ হলে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিষয়ে শ্রমিকদের সংগঠন রূপসা বেড়িবাঁধ হ্যান্ডলিং শ্রমজীবী ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রিপন শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি বরফকলের ৪০ জন শ্রমিক তাদের ইউনিয়নের সদস্য। বিগত দেড় বছর আগে মজুরির সমস্যা নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুই একজন শ্রমিক অভিযোগ করলে ইউনিয়নের মাধ্যমে সেটির সমাধান করে দেন তারা। কিন্তু বর্তমানে অভিযোগ নিয়ে কেউ আসে না।’’

বরফকলের শ্রমিকদের নিয়ে তারা মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ