‘ছোট্ট অতিথি’: গাজায় হারিয়ে যাওয়া শিশু মায়ার বন্ধনে বাঁধল দুই পরিবারকে
Published: 22nd, April 2025 GMT
ছোট মোহাম্মদ এখন তার বাবার দুই বাহুর মাঝে। সে নিখোঁজ হওয়ার পর যে পরিবারটি তার দেখভাল করেছে, তাঁদের সঙ্গে সে খুশি মনে খেলছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর আগ্রাসনের মুখে একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল মোহাম্মদের পরিবার। প্রায় ১৬ মাস আগে ওই স্কুলে বোমা হামলা চালান ইসরায়েলি সেনারা। হামলার পর চারপাশে পড়ে ছিল হতাহত মানুষের দেহ। এর মধ্যেই মাত্র ১৩ মাস বয়সী মোহাম্মদ তার মায়ের নিথর দেহের পাশে বসে কাঁদছিল।
সে দিন বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো যখন আতঙ্ক আর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মধ্যে পালাচ্ছিল, তখন মোহাম্মদ সেখান থেকে হারিয়ে যায়।
তার বাবা তারেক আবু জাবাল এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মোহাম্মদকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। অথচ তিনি জানতেন না, ওই স্কুলে থাকা আরেকজন মানুষ তারেককে খুঁজে ফিরছিলেন।
‘একটি ছোট্ট অতিথি’
রাসেম নাবহান ও তার পরিবারও বাস্তুচ্যুত হয়ে উত্তর গাজার জাবালিয়ায় আল-রাফেই স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে দুটি ইসরায়েলি বোমা সে স্কুলে আঘাত হানে।
৪১ বছর বয়সী রাসেম বলেন, ‘আমরা ভীষণ আতঙ্কিত ছিলাম, বাচ্চারা চিৎকার করছিল। কয়েক মুহূর্ত পর সেখানে একটি ড্রোন এসে হাজির হয়। সেখান থেকে সবাইকে সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা জারি করা হচ্ছিল। চারদিক থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসছিল।’
এই পরিবারের বাস্তুচ্যুত হওয়ার কাহিনি দীর্ঘ ও জটিল—স্কুল থেকে একটি বাস্তুচ্যুত শিবির, সেখান থেকে একটি তাঁবুতে খুব কঠিন পরিবেশে মাসের পর মাস ঘুমাতে হয়েছে।রাসেম প্রথমে তাঁর স্ত্রী ও সাত সন্তানকে অন্য নারী ও শিশুদের সঙ্গে স্কুল থেকে বের করে দেন। তারপর দৌড়ে দগ্ধ শ্রেণিকক্ষগুলোতে ফিরে যান আগুন নেভাতে এবং কেউ বেঁচে আছে কি না, সেটি দেখতে।
রাসেম বলেন, ‘দেয়ালগুলো রক্তে ভিজে গিয়েছিল। আহত ও নিহত ব্যক্তিদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চারপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়েছিল। ওই দৃশ্য ভাষায় বর্ণনা করার মতো না।’
এই গাজার বাসিন্দা বলেন, ‘এই বিভীষিকার মধ্যেই আমি দেখতে পেলাম, এক শিশু কাঁদছে। তার পাশে পড়ে আছে এক নারীর দেহ। তাঁর মাথা আর পেট ছিন্নভিন্ন। শরীর রক্তে ভেজা। মনে হলো, ওই নারীই শিশুটির মা।’
কিছু না ভেবেই রাসেম শিশুটিকে তুলে নিয়ে ছুটে যান। তিনি বলেন, ‘শিশুটির মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। সে এত জোরে কাঁদছিল যে, দম নিতে পারছিল না।’
রাসেম বলেন, ‘আমি আশপাশের সবাইকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, ‘এই শিশুকে কেউ চিনো? তার মাকে মেরে ফেলা হয়েছে। কিন্তু কেউ চিনতে পারেনি। এটি ছিল দুঃসহ অভিজ্ঞতা। আমার কাছে মনে হয়েছিল কেয়ামত ঘটে যাচ্ছে। সন্তানদের আঁকড়ে ধরে সবাই ছুটে পালাচ্ছে।’
রাসেম বলেন, ততক্ষণে কিছু ট্যাংক স্কুলটিকে ঘিরে ফেলেছিল। সবাইকে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে বাধ্য করা হচ্ছিল। তিনি শিশুটিকে কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে সড়কের পাশে অপেক্ষা করতে থাকা তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে পৌঁছান। তিনি বলেন, ‘আমি শিশুটিকে আমার স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে বললাম, তাকে আমি স্কুলে পেয়েছি। তার মাকে মেরে ফেলা হয়েছে।’
রাসেমের স্ত্রী ৩৪ বছর বয়সী ফাওয়াকেহ নাবহান শিশুটিকে কোলে তুলে নেন। তাদের দুই মেয়ে ইসলাম (১৯) ও আমিনা (১৮) শিশুটিকে কোলে নেওয়ার জন্য উত্সাহিত হয়ে ওঠে।
ফাওয়াকেহ বলেন, ‘এক মুহূর্তের জন্য সব ভয় মুছে গেল। আমরা ছোট্ট অতিথিটিকে স্বাগত জানালাম। তার মুখটা ছিল অপূর্ব সুন্দর। আমি সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি গভীর টান অনুভব করলাম।’
রাসেম যখন কথা বলছিলেন, তখন পাশে বসে ছিলেন মোহাম্মদের বাবা তারেক (৩৫)। ছোট ছেলেটিকে মায়াভরা চোখে দেখছিলেন তিনি। তাঁর মুখে লেগে ছিল মৃদু হাসি।এই দম্পতি শিশুটির নাম রাখেন হামুদ, যা মোহাম্মদ ও আহমেদের আদুরে রূপ। শিশুটিকে নিয়েই তাঁরা দক্ষিণে রাসিদ সড়কের দিকে হাঁটতে থাকেন, পেরিয়ে যান ইসরায়েলি বাহিনীর নেতসারিম তল্লাশিচৌকি।
শিশুটিকে কোলে নেওয়ার দায়িত্ব ভাগ করে নেন রাসেম, ফাওয়াকেহ এবং তাঁদের দুই মেয়ে।
ফাওয়াকেহ বলেন, ‘সে আমাদের কোলেই ঘুমিয়ে পড়ত আবার জেগে উঠত। অন্য যেকোনো শিশু যেমনটি করে। সে জানত না, তার চারপাশে কী ঘটছে।’
আপন হয়ে ওঠা
শিশুটির বয়স ঠিক কত ছিল, তা পরিবারটি জানত না। তবে তার গড়ন ও ওজন দেখে তারা অনুমান করেছিল, সে সাত থেকে নয় মাস বয়সী হবে।
ফাওয়াকেহ বলেন, ‘আমরা তাকে এর আগে কখনো স্কুলে দেখিনি। তার প্রকৃত বয়স বা জন্মদিন সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না।
রাসেম ও তাঁর পরিবার হেঁটে গাজা উপত্যকার মাঝামাঝি অঞ্চলের দেইর আল-বালাহতে পৌঁছান এবং কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর দক্ষিণের খান ইউনিসের দিকে রওনা হন। সেখানকার আরেকটি স্কুল–আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু জায়গা খালি আছে বলে তাঁরা শুনেছিলেন।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার খান ইউনিস এলাকায় আহত এক শিশুকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র স ম বল ন ম হ ম মদ পর ব র
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েলে ইরানের ভয়াবহ হামলায় নিহত ৭, আহত শতাধিক
ইসরায়েলে নতুন করে হামলা চালিয়েছে ইরান। রোববারের হামলায় অন্তত সাতজন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ।
ইসরায়েলের পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার গভীর রাতে দেশটির উত্তরাঞ্চলে একটি ক্ষেপণাস্ত্র পড়ে চারজন নিহত হয়েছেন। জাতীয় জরুরি পরিষেবা ম্যাগেন ডেভিড অ্যাডম (এমডিএ) এর আগে তিনজনের মৃত্যুর সংখ্যা জানিয়েছিল।
পুলিশ জানিয়েছে, সরাসরি আঘাতে অস্ত্র পড়ে ৪০ বছর বয়সী দুই নারী, ২০ বছর বয়সী এক নারী এবং ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরী নিহত হয়েছেন। তারা আরও জানিয়েছে, অনেক বাসিন্দা আহত হয়েছেন, জরুরি উদ্ধারকারীরা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়াদের খুঁজতে ঘটনাস্থলে রয়েছেন।
এমডিএ এবং ইসরায়েলি পুলিশের মতে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরবর্তী ঢেউয়ে, মধ্য ইসরায়েলের বাত ইয়াম শহরে তিনজন নিহত হয়েছেন। এমডিএ জানিয়েছে, একটি ভবনে আঘাত হানার সময় প্রায় ৬০ বছর বয়সী এক নারী হয়েছেন, এবং এর আশেপাশের অনেক ভবনের ক্ষতি হয়েছে। এই হামলার পর মধ্য ইসরায়েলের বিভিন্ন অঞ্চলে ১০০ জনেরও বেশি লোক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।