তালিকায় ১ হাজার ৪১৫ নদী, এবার কি বাঁচবে
Published: 22nd, April 2025 GMT
১ বৈশাখ ১৪৩২ অর্থাৎ এ বছর ১৪ এপ্রিল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় তাদের ওয়েবসাইটে ১ হাজার ৪১৫টি নদীর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। বাংলা নতুন বছরে এটি নিঃসন্দেহে দারুণ খবর। এবারের বাংলা নববর্ষ নদীকর্মীদের জন্য নদীর সংখ্যা নির্ধারণী বছর।
নদী তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে সিএসসহ (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) অন্যান্য রেকর্ডকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশে ব্রিটিশরা যখন সিএস রেকর্ড প্রস্তুত করে, তখন যে এলাকায় যে প্রবাহকে যে নামে ডাকা হতো, সেই প্রবাহকে রেকর্ডে সেই নাম রাখা হয়েছে। যেমন নদী, খাল, খাঁড়ি, ছড়া, ডারা ইত্যাদি। নদীর মতোই প্রাকৃতিক প্রবাহ ভিন্ন নামে রেকর্ড হয়েছে। নদীর সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হলে খাল, খাঁড়ি, ডারা, ছড়াও অনেকটাই নদীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। বর্তমান সরকার খালেরও তালিকা করছে। সেহেতু বলা যায়, নদীর সরকারি সংজ্ঞা হলে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রাকৃতিক প্রবাহ হিসেবে নদীর সংখ্যা আরও বাড়বে।
নদীর একটি বড় তালিকা পাওয়া গেছে। এখন এই তালিকা ধরে নদী সুরক্ষার কাজ পর্যায়ক্রমে চলতে থাকলে আমাদের নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু করা নদী সুরক্ষার কাজ পরবর্তী সরকার এগিয়ে নেবে, এটাই প্রত্যাশাজাতীয় নদী রক্ষা কমিশন প্রায় চার বছর সময় নিয়ে ২০২৩ সালে ১ হাজার ৮টি নদীর তালিকা প্রকাশ করেছিল। ডিসি-ইউএনওরা এই তালিকা সরবরাহ করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪০০ নদীর তথ্য মোটামুটিভাবে দেওয়া ছিল। এ তথ্যগুলো প্রধানত পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকাশিত বই থেকে নেওয়া। অন্য তথ্যগুলো অনেকটাই অসম্পূর্ণ ও ভুলে ভরা। বাস্তবে যে সংখ্যা দিয়েছিল, তারও পর্যাপ্ত তথ্য ছিল না। অন্য যেকোনো সময়ে নদীর তথ্য সংগ্রহ করার চেয়ে এবার ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। এবারের নদী অনুসন্ধানের কাজে নদীকর্মীদের যুক্ত করা হয়েছে। ফলে তাঁদের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত নদীগুলো তালিকায় এসেছে।
নদ-নদীর এই সংখ্যা হাজির করা অবশ্যই আশাজাগানিয়া। তবে নদীর প্রকৃত সংখ্যা এটি নয়। সুন্দরবন ও পার্বত্য জেলাগুলোতে তালিকা চূড়ান্ত করা কঠিন। এর প্রধান কারণ, এখানে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে না হওয়া। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ সংখ্যাকে চূড়ান্ত বলেননি। তিনিও বলেছেন নতুন নদীর তথ্য পাওয়া গেলে সেটিও যুক্ত হবে। সেই অনুসন্ধান চলতে থাকবে।
নদীগুলোকে পরবর্তী ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নদীর প্রস্থের চেয়ে ছোট যেন সেতু, কালভার্ট তৈরি না হয়, সে বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। নদীসহ যেকোনো জলপ্রবাহ তথা জলাশয়ের জমি যাতে ব্যক্তির নামে লিখিত না হয়, সে বিষয়ে নির্দেশনা জারি করতে হবে। কেউ সরকারের এসব জমি ব্যক্তির নামে লিখে দিলে, খাজনা-খারিজের সঙ্গে যুক্ত থাকলে, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।যে ১ হাজার ৪১৫টি নদী পাওয়া গেছে, সে বিষয়ে এখন সরকারকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। প্রাপ্ত নদীর মধ্যে মোট কতটি ভারত-বাংলাদেশ আন্তসীমান্ত নদী আছে, তা চিহ্নিত করা জরুরি। এরপর সব আন্তসীমান্ত নদী যাতে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন স্বীকৃত হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার নদীর ক্ষেত্রে সংখ্যা পরিবর্তন হলো কি না, দেখতে হবে।
নদীগুলোর অবস্থা অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস জরুরি। শ্রেণিবিশেষে নদীগুলোর কাজ করতে হবে। যে রকম শ্রেণি হতে পারে Ñআন্তসীমান্ত নদী (স্বীকৃত এবং স্বীকৃতির বাইরে), দখলে থাকা নদী, দূষিত থাকা নদী, উৎসমুখ বন্ধ হওয়া নদী, ব্যক্তির নামে জেলা প্রশাসন থেকে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে কবুলিয়ত দেওয়া নদী, অবৈধভাবে লিখিত হওয়া নদী, বিলের নামে লিজ হওয়া নদী, প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া নদী, প্রবাহ স্বাভাবিক থাকা নদী, মৌসুমি নদী, বারোমাসি নদী।
নদীগুলোর জন্য কাজের একটি রোডম্যাপ প্রস্তুত করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার সবটুকু করে যেতে পারবে না। পরবর্তী যাঁরাই দায়িত্বে থাকবেন, তাঁরাই যেন কাজের ধারাবাহিকতায় নদী সুরক্ষায় নিয়োজিত থাকেন।
আরও পড়ুননদী রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের যা করা প্রয়োজন০২ জানুয়ারি ২০২৫স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় নদীর শ্রেণীকরণ, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, দূষণ মুক্তকরণ, অবৈধভাবে মালিকানা বাতিলের কাজ করতে হবে। নদীর মালিক যেহেতু আইনত ব্যক্তি হতে পারে না, তাই কোনো ব্যক্তির নামে অবৈধ মালিকানা, খারিজ, রেকর্ড কিংবা গেজেট হলে তা একটি পরিপত্র জারি করে বাতিল করতে হবে, প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে। নয়তো নদী সুরক্ষার কাজ বাংলাদেশে কোনো দিন বৃহৎ পরিসরে করা যাবে না। স্বল্পমেয়াদি কাজে এটি সম্পন্ন করতে হবে।
আইন সংশোধন করা কিংবা পরিপত্র জারি করা, দুটিই সহজ কাজ। সদিচ্ছা থাকলেই হবে। এ কাজ ভূমি মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের কাজ হলেও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও এখানে ভূমি রাখতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় নিশ্চিহ্ন হওয়া নদীতে প্রবাহ ফেরাতে হবে। নদীগুলোর ভাঙনরোধের কাজ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় যে কটি নদীকে দখল-দূষণ থেকে মুক্ত করা যাবে না, সে কটি নদীর কাজ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় নিতে হবে। আমাদের নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জলমহাল, বিল, হাওরসহ যে নিম্নাঞ্চল আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে হবে। নদীর যে জমি ডিসিরা ব্যক্তির নামে কবুলিয়ত দিয়েছেন, সেগুলো এক নোটিশে বাতিল করতে হবে।
নদীগুলোকে পরবর্তী ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নদীর প্রস্থের চেয়ে ছোট যেন সেতু, কালভার্ট তৈরি না হয়, সে বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। নদীসহ যেকোনো জলপ্রবাহ তথা জলাশয়ের জমি যাতে ব্যক্তির নামে লিখিত না হয়, সে বিষয়ে নির্দেশনা জারি করতে হবে। কেউ সরকারের এসব জমি ব্যক্তির নামে লিখে দিলে, খাজনা-খারিজের সঙ্গে যুক্ত থাকলে, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
নদীর একটি বড় তালিকা পাওয়া গেছে। এখন এই তালিকা ধরে নদী সুরক্ষার কাজ পর্যায়ক্রমে চলতে থাকলে আমাদের নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু করা নদী সুরক্ষার কাজ পরবর্তী সরকার এগিয়ে নেবে, এটাই প্রত্যাশা।
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: নদ গ ল র নদ গ ল ক সরক র র ক জ করত পরবর ত নদ র স নদ র ত র জন য র কর ড আম দ র প রব হ র একট
এছাড়াও পড়ুন:
‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নিয়ে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের পরবর্তী শুনানি বুধবার
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ নিয়ে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আবেদনের (রিভিউ) ওপর পরবর্তী শুনানির জন্য আগামীকাল বুধবার দিন রেখেছেন আপিল বিভাগ। আজ মঙ্গলবার শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের বেঞ্চ পরবর্তী ওই দিন ধার্য করেন।
এর আগে গত ১৮ মে শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ শুনানির জন্য ১ জুলাই দিন ধার্য করেছিলেন। ধার্য তারিখে বিষয়টি শুনানির জন্য রিভিউ আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবীর সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ ১৫ জুলাই পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন। আজ বিষয়টি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকার ৭ নম্বর ক্রমিকে ওঠে।
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন করে ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রায় দেন। পরে ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদধারীদের পদক্রম ওপরের দিকে রাখা ও অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়। পাশাপাশি জেলা জজদের পদক্রম আট ধাপ উন্নীত করে সচিবদের সমান করা হয়।
আপিল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতির পদক্রম এক ধাপ উন্নীত করে জাতীয় সংসদের স্পিকারের সমান এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণ করে যে মুক্তিযোদ্ধারা বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন) পদক্রমে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে উল্লেখ করা হয়।
ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তৎকালীন চেয়ারম্যান ২০১৭ সালে পৃথক আবেদন করেন। রিভিউ আবেদনে রাষ্ট্রের ৯০ জন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পক্ষভুক্ত হন। পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা আবেদনের ওপর গত ২৭ এপ্রিল শুনানি শুরু হয়।
আজ আদালতে রিভিউ আবেদনকারী মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সালাহ উদ্দিন দোলন শুনানি করেন। রিট আবেদনকারী পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলদের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম শুনানিতে অংশ নেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরি করে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তা জারি করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে তা সংশোধন করা হয়।
সর্বশেষ সংশোধন করা হয় ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে। সংশোধিত এই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরির ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদ, সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত ও সংজ্ঞায়িত পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিচের ক্রমিকে রাখা হয়েছে—এমন উল্লেখ করে এর বৈধতা নিয়ে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মো. আতাউর রহমান ২০০৬ সালে রিট করেন।
রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট আট দফা নির্দেশনাসহ ১৯৮৬ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (সংশোধিত) অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ২০১১ সালে আপিল করে। এ আপিলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রায় দেন। এ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০১৭ সালে করা আবেদনের ওপর শুনানি চলছে।