ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন সব নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং মাতৃসদন কেন্দ্রে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। 

মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) রাজধানীর গুলশান-২ নগর ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ তথ্য জানান।

সভায় বর্ষা মৌসুমে সম্ভাব্য ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় মশার প্রজনন ও ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণে করণীয় বিষয়ে ডিএনসিসির আওতাধীন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের প্রতিনিধি এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা হয়। সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রশাসক বলেন, “এ বছর আমাদের দেশে গরম শুরুর আগেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ফলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেড়েছে। এই পরিস্থিতি সবাইকে মিলে মোকাবিলা করতে হবে।”

তিনি বলেন, “বাসাবাড়িতেই এডিস মশার লার্ভা জন্মায়। আমাদের কর্মীরা নিরাপত্তার কারণে অনেক সময় বাসায় প্রবেশ করতে পারে না। তাই নাগরিকদের সচেতন হতে হবে, বাসাবাড়ি পরিষ্কার রাখতে হবে এবং আশপাশে পানি জমতে না দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।”

ডিএনসিসি প্রশাসক জানান, আগামী সপ্তাহ থেকে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে সচেতনতা ক্যাম্পেইন শুরু করা হবে। এক সপ্তাহের প্রচারণার পর কোনো বাসাবাড়িতে বা স্থাপনায় লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হবে। তিনি বলেন, “আমরা শুধু জরিমানা করবো না, মানুষকে সচেতন করবো—এটাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।”

মশক নিধন কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিয়ে তিনি বলেন, “আমরা দেখেছি, মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের জন্য বরাদ্দকৃত বিলের বড় অংশ তারা পান না। একেকজন কর্মীর নামেই ১৭-১৮ হাজার টাকা বিল আসে, কিন্তু তারা হাতে পান মাত্র ৬-৮ হাজার টাকা। প্রায় ১০ হাজার টাকা মাঝখানে হারিয়ে যায়। হাজারজন কর্মীর বেলায় এটা কোটি টাকার দুর্নীতি।”

এই সমস্যা সমাধানে সিটি কর্পোরেশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের বিল সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পরিশোধ করা হবে। আউটসোর্সিং কোম্পানিগুলো কেবল কর্মীদের তালিকা, ফোন নম্বর এবং ব্যাংক তথ্য দেবে। এ ছাড়া, যেসব এলাকায় মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, সেই এলাকার সুপারভাইজারদের ফোন নম্বর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। নাগরিকরা সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারবেন।

সভায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা.

বেনজীর আহমেদ বলেন, “ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে অনেকেই জানে না কী করতে হবে। প্রতিটি হাসপাতালে একটি কাউন্সেলিং টিম থাকলে রোগী ও স্বজনরা দিক-নির্দেশনা পাবে।” তিনি সরকারি-বেসরকারি সকল হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা চালুর আহ্বান জানান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, “ডেঙ্গু এখন আর শুধু শহরকেন্দ্রিক নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিরোধ ও চিকিৎসা—দুটোই জরুরি। নির্মাণাধীন ভবনে সাধারণত এডিসের লার্ভা বেশি পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা দরকার।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাসার বলেন, “বিশ্বের অন্য দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এত মানুষের মৃত্যু হয় না। আমাদের দেশে মৃত্যুহার বেশি কেন, তা নিয়ে গবেষণা দরকার। প্রতিটি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং রোগীদের সার্বক্ষণিক মশারির ভিতরে রাখতে হবে।”

সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামান, প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মঈন উদ্দিন, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী এবং বিভিন্ন হাসপাতালের প্রতিনিধি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

ঢাকা/আসাদ/এনএইচ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ড এনস স আম দ র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রম অধিকার ও সুস্থ কর্মপরিবেশ

আজ মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারী মেহনতি মানুষদের স্মরণ করিবার দিন। তৎসহিত সকল শ্রমজীবী মানুষের জন্য মর্যাদাকর জীবন নিশ্চিতকরণের সংগ্রামে নূতন শপথ গ্রহণের দিন।

মে দিবস বিশ্বের শ্রমিকদের সংহতি যদ্রূপ বৃদ্ধি করিয়াছে, তদ্রূপ তাহাদিগকে অধিকার সচেতনও করিয়াছে; প্রেরণা জোগাইয়া চলিয়াছে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে। মে দিবস বাংলাদেশসহ বিশ্বের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়া স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশসমূহের জন্য বিপুল প্রেরণার উৎসরূপে কাজ করিয়াছে।

তাহারই প্রতিফলনস্বরূপ এই সকল দেশে ছুটিসহকারে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত হয়। উন্নত দেশসমূহ এই দিবসে পৃথক ছুটির ব্যবস্থা না করিলেও উহার প্রভাব উপেক্ষা করিতে পারে নাই। তাই ভিন্ন প্রকারে সেই সকল দেশেও দিবসটি পালিত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে আজিকে শ্রমমান লইয়া যে আলোচনা হয়, জাতীয় ন্যূনতম মজুরিসহ শ্রমিকের বহু অধিকার আজিকে যে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বহু দেশে কার্যকর হইয়াছে, উহারও পশ্চাতে রহিয়াছে মে দিবসের চেতনা। তবে ইহা সত্য, বাংলাদেশে ঘটা করিয়া দিবসটি পালিত হইলেও মজুরি ও কর্মপরিবেশ প্রশ্নে খামতি সীমাহীন। প্রাতিষ্ঠানিক খাতসমূহে শ্রমিকদের জন্য এক প্রকার আইনি আশ্রয় থাকিলেও বিশাল অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে উহার লেশমাত্র নাই। শেষোক্ত খাতে কোটি কোটি শ্রমিক উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও অন্যান্য অধিকার হইতে বঞ্চিত। 

এই বৎসর শ্রমিক দিবস এমন সময়ে উপস্থিত, যখন গণঅভ্যুত্থানের ফসলস্বরূপ দেশে নূতন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছে। সেই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসাবে শ্রম খাতের সংস্কারেও উদ্যোগী। তাহাদের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে প্রতিবেদনও দাখিল করিয়াছে, যথায় দেশের সাড়ে সাত কোটি শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক অধিকার-সংক্রান্ত একগুচ্ছ সুপারিশ রহিয়াছে। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক, সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নিয়োজিত সকল শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ ন্যূনতম মানদণ্ডরূপে বিবেচিত হইবে– কমিশনের এই সুপারিশ যুগান্তকারী বলিয়া আমরা মনে করি। উপরন্তু কমিশন ইহাও বলিয়াছে, কোনো খাতের মজুরি কাঠামো নির্ধারণে পরিবারে একক উপার্জনকারী হিসাবে বিবেচনায় লইয়া এমন পরিমাণ নির্ধারণ করিতে হইবে, যাহাতে শ্রমিক তাঁহার পরিবারের প্রয়োজন মিটাইতে পারেন।

বিভিন্ন খাতের শ্রমিকের মজুরি তিন বৎসর অন্তর মূল্যায়ন ও পুনর্নির্ধারণ, মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য আপৎকালীন তহবিল, ট্রেড ইউনিয়ন করিবার শর্ত শিথিল, স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ, নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস এবং স্থায়ী শ্রম কমিশন প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত সুপারিশসমূহও প্রণিধানযোগ্য। একটা সময় ছিল যখন শ্রমিক আন্দোলন বলিতে কারখানা ভাঙচুর ও সম্পদ ধ্বংস বোঝাইত। পরিণামে নিজের রুটি-রুজি লইয়া শ্রমিকদেরই টানাপোড়েনে পড়িতে হইত। ইহার সমাধান দিয়াছিল ট্রেড ইউনিয়ন প্রথা। দুর্ভাগ্যবশত এই দেশে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার বিগত দশকসমূহে ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করে। উহার সহিত সুস্থ ধারার শ্রমিক আন্দোলনও বিরল হইয়া পড়ে।

আমাদের বিশ্বাস, শ্রম সংস্কার কমিশনের ট্রেড ইউনিয়ন-সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ আলোর মুখ দেখিলে শ্রমিক-মালিক উভয়েরই স্বার্থ রক্ষা হইবে। সর্বোপরি দেশের বিকাশমান শিল্প খাত হইবে লাভবান। উৎপাদন ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তিরূপে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে উদ্যোক্তার যদ্রূপ অবদান, তদ্রূপ শ্রমিকেরও অবদান ব্যাপক। তাই শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণে আর কোনো অবহেলা নহে। এইবারের মে দিবসে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করিবে– ইহাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা সমকালের পক্ষ হইতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শ্রমজীবী মানুষকে মে দিবসের অভিনন্দন জানাই।

সম্পর্কিত নিবন্ধ